বিজয়-মুহূর্তের পরম গাথা

মতিউর রহমান তাঁর সম্পাদিত এ বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের এ বিজয় সহজে আসেনি। বিভিন্ন স্তরে বিচিত্র ধারায় নানা মানুষের যে কর্মযজ্ঞ চলেছিল, সেটিই পরিণতি পায় বিজয়ে। তাই মুক্তিযুদ্ধের মতো বিজয়ের সেই দিনটির গল্পও বিচিত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যিনি যেখানে ছিলেন, তাঁর কাছেই অনন্য হয়ে ধরা পড়েছিল বিজয়ের সেই স্বর্ণমণ্ডিত মুহূর্তটি।’

সত্যিই তাই। আমরা যখন পর্যায়ক্রমে আলোচ্য বইয়ে সংকলিত লেখাগুলো পড়ি, আবেগে আপ্লুত না হয়ে পারি না। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে সেই ঐতিহাসিক দিনক্ষণটির কথা। নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাই অন্যদের কাতারে, বিশেষ করে সেই ২২ বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতিটি লেখায় ব্যক্ত অনুভূতি হয়ে ওঠে আমারও আবেগ, আমারও আনন্দ, আমারও বেদনা। এই বই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তীকালের প্রজন্ম—উভয়কেই সমানভাবে আকর্ষণ করবে। এর মূলে বিজয় দিবসের প্রতিটি মুহূর্তের নিজস্ব অনুভূতি তাঁরা যে আন্তরিকতা নিয়ে প্রকাশ করেছেন, তা এতটাই মানবিক আর প্রগাঢ় যে তা বয়সনির্বিশেষে পাঠকমাত্রেই স্পর্শ না করে পারবে না।

বইটির লেখক তালিকায় আছেন কবি সুফিয়া কামাল, এ কে খন্দকার বীর উত্তম, কে এম সফিউল্লাহ বীর প্রতীক, শহীদজননী জাহানারা ইমাম, কবি শামসুর রাহমান, চিন্তাবিদ সরদার ফজলুল করিম, সাংবাদিক আবদুল গাফ্​ফার চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিত, রবীন্দ্র-গবেষক সন্​জীদা খাতুন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা শামসুদ্দীন আহমেদ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, গাজী মো. রহমতউল্লাহ বীর প্রতীক, সাবেক সাংসদ পান্না কায়সার, শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি।

এ বইয়ে স্থান করে নেওয়া লেখক-লেখিকাদের কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তে ছিলেন গৃহবন্দী, কেউ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কেউ–বা ছিলেন প্রবাসে, আবার কেউ হয়তো তখনকার রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ক্ষণটিকে। ফলে নানা প্রেক্ষাপট আর দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা পড়েছে বিজয়ের দিনক্ষণ এবং প্রকাশ ঘটেছে এ–সংক্রান্ত আবেগ ও অনুভূতির কথা।

যেমন কবি বেগম সুফিয়া কামাল নিজের দুই মেয়েকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকটি মেয়েকেও পাঠান তিনি। ‘দিনটা কেটেছে বেদনায়, কষ্টে’ শিরোনামের তাঁর লেখায় নিজের অনুভূতির কথা সুফিয়া কামাল জানাচ্ছেন এভাবে, ‘“যুদ্ধ শেষ” কথাটা শুনলেই থেকে থেকে মনে পড়ছিল মেয়েদের কথা। মায়ের মন তো...। কেবলি মনে হচ্ছিল, ওরা কেমন আছে, কোথায় আছে...? কখন ওদের দেখব। “আমরা বিজয় লাভ করেছি”—খবরটা ছড়িয়ে যাওয়ার পরপরই রাস্তা থেকে যেমন আনন্দোল্লাস শোনা যাচ্ছিল, তেমন গুলির আওয়াজও।’

এ কে খন্দকার তখনকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, ‘বিমানবন্দর থেকে আমরা জিপে করে রমনা রেসকোর্সে উপস্থিত হই। রাস্তার দুই ধারে এবং রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডের ওপর বহু মানুষ হাত তুলে এবং নানা প্রকার স্লোগান দিয়ে স্বাগত জানান আমাদের। রেসকোর্সে এসে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের ভেতরেই একটি মাঝারি ধরনের সমাবেশ বিশাল সমাবেশে পরিণত হয়। সেই ময়দানে আনুমানিক বিকেল চারটায় জেনারেল নিয়াজি তাঁর দখলদার বাহিনীসহ আত্মসমর্পণ করেন।...রমনা রেসকোর্স ময়দানে অসংখ্য লোকের সঙ্গে আমাকে কোলাকুলি করতে হয়েছে। এর মধ্যেও ছিল মানুষের অনাবিল আনন্দ এবং স্বস্তির অভিব্যক্তি। বেশ কজন আমাকে সেদিন বলেছেন, “আজ রাত থেকে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাব।” বহু মানুষকে তিনি বিজয়ের আনন্দে কাঁদতেও দেখেছেন। 

আমি নিশ্চিত, পাঠক জাহানারা ইমাম ও পান্না কায়সারের লেখা দুটি পড়ে নিজেদের আবেগকে বশে রাখতে পারবেন না। মনের অজন্তে তাঁরা কখন যে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠবেন, টেরও পাবেন না। তেমনি অন্য লেখকদের লেখায় বিজয়ের মুহূর্তের বিবরণ পড়েও তাঁরা স্পন্দিত হবেন। 

আমার জানামতে, শুধু মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মুহূর্ত বা দিনক্ষণের বিবরণ নিয়ে এটিই প্রথম বই। তাই এ বইয়ের দালিলিক মর্যাদা অপরিসীম। এবং এর পুরো কৃতিত্ব সম্পাদক হিসেবে মতিউর রহমানের। তাঁকে অভিনন্দন এমন একটি বই সম্পাদনার জন্য। 

বিজয়ের মাসে বিজয়ের মুহূর্তের বিবরণ পাঠ করে পাঠক উদ্বেল ও অভিভূত হবেন। বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ এমনই এক পরম আধারস্বরূপ গ্রন্থ।

বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১

সম্পাদক: মতিউর রহমান

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জুন ২০১৯, ১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।