একাত্তরের পত্রপত্রিকায় বিজয়ের সংবাদ

১৯৭১–এর ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বরের ইত্তেফাক
১৯৭১–এর ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বরের ইত্তেফাক

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এসেছিল আমাদের বিজয়ের মুহূর্ত। এক সাগর রক্ত পেরিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ছিল বিপুল আনন্দ ও হর্ষের। তবে এই হর্ষের পেছনে ছিল মানুষের আত্মত্যাগের অঢেল কাহিনি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশের বিজয়ের সংবাদ যখন প্রকাশিত হচ্ছিল পত্রপত্রিকায়, সেই সময় বিজয়ের আনন্দের মধ্যে এই সব আত্মদানের গল্পগুলোও ফিরেছিল মানুষের মুখে মুখে।

মুক্তিযুদ্ধের নানামাত্রিক খবর তৎকালীন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় অবরুদ্ধ দেশের সংবাদপত্র এবং ভারত ও অন্যান্য দেশের খবরের কাগজ ভরে উঠত মুক্তিযুদ্ধের নানান খবরে। এমনকি বাংলাদেশের সংগ্রামী তরুণ, রাজনৈতিক নেতারা ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে পত্রিকা প্রকাশ করে শত্রুকবলিত দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে গঠিত হয়েছে জনমত। এভাবে মুক্তিসংগ্রাম এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। 

কিন্তু কেমন ছিল বিজয়ের আনন্দ-সংবাদ? মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সংবাদে মানুষ কীভাবে উদ্বেলিত হয়েছিল, কেমন করে গ্রহণ করেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে?

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী পত্রপত্রিকাগুলোর সংবাদ-প্রতিবেদনে বিষয়টি শিল্পিতরূপে ধৃত হয়েছিল। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে ১৯৭১–এর ১৬ ডিসেম্বর দেশে অনেকগুলো দৈনিক প্রকাশিত হয়নি। সেই সময়ের প্রধান দৈনিক ইত্তেফাকও প্রকাশিত হয় বিজয়ের একদিন পর—১৭ ডিসেম্বর। এদিন পত্রিকাটি প্রকাশ করে বিজয়ের সংবাদ। ‘দখলদার পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণ, সোনার বাংলা মুক্ত’ শিরোনামে প্রধান ওই সংবাদে বলা হয়, ‘এই আত্মসমর্পণের ভিতর দিয়াই সোনার বাংলা এবং তার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জীবন হইতে বিভীষিকাময় তিমিরের অবসান ঘটিয়াছে। রক্তস্নাত বাংলা দেশের পূর্ব দিগন্তে আজ স্বাধীনতার অম্লান সূর্য উদ্ভাসিত। আজিকার এই শুভলগ্নে আমরা স্মরণ করিতেছি সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যাঁরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দাবী আদায়ের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়া দিয়াছেন, সান্তনা দিতেছি সন্তানহারা মাকে, স্বামীহারা স্ত্রীকে, পিতৃ-মাতৃহারা এতিমের সন্তানদের। এই সংগে স্মরণ করিতেছি স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি আজকের এই মুহূর্তে পর্যন্তও পাক সেনাবাহিনীর কারাগারে অন্ধ-প্রকোষ্ঠে আটক। সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ তাই তাঁকে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান।’ 

বোঝাই যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির অপেক্ষায় তখন অধীর ছিল গোটা দেশ।

১৮ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এর প্রধান সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড, ঢাকার শতাধিক সাংবাদিক সাহিত্যিক অধ্যাপক চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী নিহত।’ ওই প্রতিবেদনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামোল্লেখ করে বলা হয়, ‘দখলদার পাক বাহিনীর শেষ নৃশংস গণহত্যার নির্মম শিকার সোনার বাংলা দেশের বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ঢাকার শহরতলী রায়ের বাজারের অদূরবর্তী খানা-খন্দ, ইটের গাদা ও গর্তে ইতিহাসের সেই জঘন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের সবগুলিই পেছনে হাত বাঁধা এবং বুক ও মাথায় গুলি ও বেয়োনেটের আঘাতের চিহ্ন। অনেকগুলির চোখ উপড়ানো। অনেকগুলি মৃতদেহ শকুন, শৃগাল, কাক ও কুকুরের আহার্যে পরিণত হইয়াছে। অনেকগুলির শুধু কংকাল ছড়াইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। সমগ্র এলাকা পুঁতিগন্ধে বিষাক্ত।’ বুদ্ধিজীবী হত্যা বিজয়ের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছিল।

আগেই বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেমন, আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে বের হত জয়বাংলা, কমিউনিস্ট পাটির মুখপত্র হিসেবে বের হতো মুক্তিযুদ্ধ, কবি ও সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর বের করতেন অভিযান। এই ছোট ছোট পত্রিকাগুলো সে সময় যেমন দারুণ ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেও সচল ছিল তাদের কলম। মুক্তিযুদ্ধ ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশ করে  ‘আনন্দে বেদনার সুর’ শিরোনামে একটি খবর। বঙ্গবন্ধুর বন্দিমুক্তির প্রশ্নে ওই সংবাদে বলা হয়, ‘বাঙলাদেশের রাহুমুক্তিতে প্রতিটি দেশবাসী আনন্দে উদ্বেল হইয়া উঠিলেও এই আনন্দের মধ্যেই বাজিতেছে বেদনার সুর। বাঙলাদেশের জনগণের প্রিয় নেতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মধ্যে নাই। তিনি কসাই ইয়াহিয়ার নির্জন কারাগারে বন্দী। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কেহ জানে না। শেখ সাহেবের অনুপস্থিতি সকল আনন্দ উৎসবকে ম্লান করিয়া দিতেছে।’

যশোর মুক্ত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর। সেখানে এক জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। জনসভায় কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধ আদালত গঠন এবং এই আদালতে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার। (অভিযান, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১)। একই জনসভায় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাংলাদেশের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় (মুক্তিযুদ্ধ, ১৯ ডিসেম্বর)

ভারতের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতেও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশের বিজয়ের খবর। কলকাতার দৈনিক যুগান্তর-এর ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যার সংবাদ ‘রাহুমুক্ত বাংলাদেশ’-এ বলা হয়, ‘যে-মাটিতে পড়েছে শহীদের পূত শোণিতধারা, সে-মাটি নেবে না পিশাচের দূষিত রক্ত। তবে পাইকারী হারে ছাড়া পাবে না দেশদ্রোহী এবং সমাজদ্রোহী ঘাতকের দল। গণআদালতে তাদের বিচার অবশ্য কাম্য। যারা অপরাধী, তারা পেতে পারে না ক্ষমা—পেতে পারে না নিষ্কৃতি। যে-আগুন জ্বলছে আজ বাংলাদেশের বুকে, তা নিভানোর জন্যই দরকার উপযুক্ত বিচার। নইলে শান্ত হবে না বাঙালীর অশান্ত আত্মা। সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে না সমাজ।’ 

মুক্তিযুদ্ধে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ত্রিপুরা রাজ্য। ত্রিপুরার আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ বাংলাদেশের বিজয়ের খবরের শিরোনাম করেছিল বেশ দীর্ঘ করে। ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তারা লিখেছিল, ‘অবশেষে শত্রুসেনা নতজানু, আজন্ম লালিত সেই পবিত্র মুখ উদ্ভাসিত, বাঙলাদেশ শত্রুমুক্ত, মিত্র বাহিনীর কাছে দখলদার পাক সেনা বাহিনীর নিঃশর্ত্ত আত্মসমর্পণ, ঢাকা মুক্ত, নতজানু শত্রু সেনাপতি, সোনার বাঙলার শ্যামল প্রান্তরে মানুষের বিজয় বৈজয়ন্তী, মাতৃদেহে লক্ষ লক্ষ সন্তানের রক্তে কর্দ্দমাক্ত করে, বাঙলার বাতাসকে কান্নায় ভরিয়ে দিয়ে যে সেনাবাহিনী সভ্যতার বিজয় রথকে পিছিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল তারা আজ ক্ষমাপ্রার্থী, আজন্মলালিত স্বপ্নের সেই পবিত্র মুখ আজ উদ্ভাসিত, আজ আবার সেই নিঃশব্দ পাখীর কণ্ঠে গান, সেই পুণ্যতোয়া জীবনের আপ্লুত কলতান, কোটি প্রাণ আজ বাঙলার মুখ দেখেছে, আজ স্বজন হারানো শ্মশানে শত্রুর বহ্নিমান চিতা, বাঙলা আজ মুক্ত, ঢাকা আজ উন্মুক্ত।’ 

একই পত্রিকার ১৭ ডিসেম্বরের আরেকটি সংবাদ ‘রাজধানী আগরতলায় বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার’-এ বলা হয়, ‘২৬শে মার্চের মধ্যাহ্নে যে রাজধানী আগরতলা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল বাংলাদেশের বুকে জঙ্গী শাহীর উন্মত্ত বর্বরতার প্রতিবাদে, আজ পূর্ণ বিজয়ের আনন্দে সন্ধ্যার রাজধানী প্রাণোচ্ছ্বল। বাংলাদেশ মুক্ত, ঢাকা স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মুক্ত রাজধানী-আকাশবাণীর এই ঘোষাণাটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহর আগরতলায় উচ্ছ্বসিত আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। আনন্দের প্রাবল্যে জনসাধারণ রাস্তায় বাজি ফাটিয়ে, জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে তোলেন। অনেককেই উচ্ছ্বাসের কান্নায় প্রিয়জনদের মিষ্টি মুখ করিয়ে আলিঙ্গন করতেও দেখা যায়।’

এই ডিসেম্বরেই কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ থেকে পাওয়া যায় ঢাকার বাইরে মফস্বলের শত্রুমুক্তির খবর এবং মানুষের আনন্দের চিত্র। কুমিল্লা মুক্ত হয়েছিল ৮ ডিসেম্বর। ‘বাংলার বিভিন্ন এলাকার সহিত কুমিল্লাও শত্রুমুক্ত’—১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত এই সংবাদে বলা হয়, ‘গত ৮ই ডিসেম্বর বুধবার প্রত্যুষে শহরবাসী কুমিল্লা শহরকেও যেন হালকা, স্বচ্ছ ও পবিত্র বলিয়া দেখিতে পায়। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই জানিতে পারে কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত এবং মুক্তি ও মিত্র বাহিনী কুমিল্লা শহরে পৌঁছিতেছে। এই আনন্দে জনগণ আনন্দ উল্লাসে একে অন্যের সহিত আলিঙ্গন ও জয়বাংলা ধ্বনি দিতে থাকে।’ 

৭ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লা বিমানবন্দরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং পরাস্ত হয় পাকিস্তানিরা। অনেক মৃত সৈনিক পড়ে থাকে এখানে-সেখানে। ১৬ ডিসেম্বরে আমোদ-এর আরেকটি সংবাদ ‘বিমানবন্দরে জয়োল্লাস’-এ সম্পর্কে বলা হয়, ‘এই দৃশ্য (পাকিস্তানিরা মরে পড়ে আছে) দেখিবার জন্য হাজার হাজার বাঙ্গালী জনতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া বিজয় উল্লাসে মিত্রবাহিনীর সৈনিক দিগকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে, সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত পাঞ্জাবী সৈনিকদের প্রতি ধিক্কার জানাইতে থাকে। বাঙ্গালী জনতার এই আনন্দ উল্লাস এবং মিত্রবাহিনীর প্রতি অভিনন্দনে তাহারা উপলব্ধি করে যে, খান সেনারা জনগণের প্রতি যে কতদূর অত্যাচার চালাইয়াছিল।’ 

বিজয়ের আনন্দ ছিল আনন্দ ও বেদনার। একই সঙ্গে জিজ্ঞাসা জমেছিল অনেক বিষয়ে। ১৯৭১-এর বিজয়ের মাসে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় এর পরিচয় মেলে। অন্যদিকে জাতীয় জীবনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছিল তখন। প্রথমত, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সেনাবাহিনীর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন; তৃতীয়ত গণহত্যা-নির্যাতন তথা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার; চতুর্থত, বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শে গড়ে তোলা এবং দেশ পুনর্গঠন প্রভৃতি। এই সব বিষয়ে নানা ধরনের সংবাদ ১৭ ডিসেম্বর এবং তার পরবর্তী কয়েক দিনের পত্রপত্রিকায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। 

ফলে সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত খবরসমূহ ঘেঁটে এ কথা বলা যায় যে  হর্ষ-বিষাদের হাত ধরে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করে বাঙালি দৃষ্টি মেলেছে দূর পানে।

এই নিবন্ধের যেসব জায়গায় তৎকালীন পত্রপত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে বানান রীতির ক্ষেত্রে ওই সব পত্রিকায় সংবাদগুলো যে বানানে এবং যেভাবে ছাপা হয়েছিল, অবিকল সেভাবেই রাখা হয়েছে।