চিরগৌরবের বীরত্বগাথা

যুদ্ধগাথা ১৯৭১: ২৬টি বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বয়ান সম্পাদক: মুহাম্মদ লুৎফুল হক প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা: ১৩১, দাম: ২০০ টাকা।
যুদ্ধগাথা ১৯৭১: ২৬টি বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বয়ান সম্পাদক: মুহাম্মদ লুৎফুল হক প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা: ১৩১, দাম: ২০০ টাকা।

যুদ্ধগাথা ১৯৭১: ২৬টি বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বয়ান নামের এই বই নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ; এবং সেটা এ কারণেই যে স্বল্পায়তনের যে ২৬টি লেখা নিয়ে এ বইয়ের বিন্যাস, তাতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা তুলে ধরা হয়েছে প্রাঞ্জল ভাষায়। এখানে আছে সাত বীরশ্রেষ্ঠর সাহসী আত্মদানের কথাও।

২০১১ সালের মার্চ মাসের ২৬ দিন ধরে এই বইয়ের লেখাগুলো ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়। এগুলো লিখেছিলেন বইটির সম্পাদক মুহাম্মদ লুৎফুল হক ও তৈমুর রেজা। সেই রচনাগুলোই বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে চলতি বছরের একুশের বইমেলায়।

বইয়ের প্রথম রচনাটির শিরোনাম ‘প্রথম প্রতিরোধ ও শুভ বার্তা’। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার পর ২৬ মার্চ তাদের একটি কনভয় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ এই সেনা দলকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি বাড়বকুণ্ডে সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তুলে লড়াই করতে সাহায্য করেছেন এবং নিজেরাও সে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন, সেসবের বিস্তারিত বিবরণ চোখের সামনে যেন জীবন্ত করে তোলে। প্রতিরোধযুদ্ধের প্রথম শহীদ বাদশা মিয়া। তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। কিন্তু এই ঘটনাই পাল্টে দিল এখানকার মুক্তিযুদ্ধের হিসাব-নিকাশ।

দ্বিতীয় গতিরোধ গড়ে উঠল কুমিরায়। পাহাড়ঘেরা কুমিরা থমথমে। পথের ওপর ফেলে রাখা গাছের গুঁড়িগুলো সরানোর জন্য পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নামতেই একসঙ্গে গর্জে উঠল প্রতিরোধকারীদের মেশিনগান ও মর্টার। তুমুল যুদ্ধ দুই পক্ষের মধ্যে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটল। মাত্র ১০০ মুক্তিসেনার হাতে ভয়ংকর মার খেল তারা। এ যুদ্ধে ১৫২টি লাশ পড়েছে তাদের। নিহত হয়েছে একজন সেনানায়ক। অতঃপর দুই ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে শত্রুবাহিনী পালিয়েছে পাহাড়ের আড়ালে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর শিবিরেও দেখা দিল শোকের ছায়া। কারণ, এই যুদ্ধে ‘১৪ জন বাঙালি বীরের মতো প্রাণ দিয়েছেন’।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তারপরও লেখক বলেছেন, ‘...বাঙালি জাতি এই যুদ্ধের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে। এটাই ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধগুলোর একটি। মাত্র ১০০ লোক সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। এই সংবাদ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণে বার্তা রটিয়ে দিয়েছিল—বিজয় আসবেই।’

‘কুষ্টিয়ায় সিপাহি-জনতার যুদ্ধ’, ‘সাদিপুর-শেরপুর দখল’, ‘রিয়াল টাইগার’, ‘আগুনের দিন’, ‘টিক্কা খানের ফানুস’, ‘অপারেশন জ্যাকপট’, ‘লোহারপুল অ্যামবুশ’, ‘কিলো ফ্লাইট’, ‘বিজয়ীদের বরণ করল বৃষ্টি’, ‘নয়াদীঘি মুক্তির গান’, ‘বিজয়ের পথে পা চালিয়ে’, ‘জ্বলছে পাক বে ডকইয়ার্ড’, ‘অনুষ্ঠান ছেড়ে পালাল সবাই’, ‘সুরমার তীরে জয়ভেরি’, ‘আগুনের দিন’, ‘শত্রুমুক্ত হলো সালদা নদী’, ‘বিজয়ের সুবাতাস’ এবং ‘নাজেহাল রাক্ষস’ শিরোনামের লেখাগুলোর পাশাপাশি সাত বীরশ্রেষ্ঠর অসীমসাহসী আত্মদানের বিবরণ পাঠ করলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বাঙালি কেন সত্যিকারের বীরের জাতি।

উল্লিখিত লেখাগুলো পাঠ করলেই আমরা পেয়ে যাব সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তুলেছেন, সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, গেরিলাযুদ্ধ করেছেন, আহত ও নিহত হয়েছেন এবং ‘ভেতো আর ভিতু বাঙালি’ বলে তাঁদের যে বদনাম, সেই বদনাম মোচনে কী পরিমাণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা।

আলোচ্য বইয়ের প্রতিটি লেখার পাঠ মানেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে আসা। শুধু ঘোরাই নয়, যুদ্ধকালের ৯ মাসজুড়ে বাঙালির বীরত্বের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী-সহচর হওয়া এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার প্রায় সম্যক চিত্রও মনে গেঁথে নেওয়া। পাশাপাশি বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে সাতটি লেখা এই বোধ আমাদের মনে গভীরভাবে সঞ্চারিত করে যে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ, সিপাহি হামিদুর রহমান, সিপাহি মোস্তফা কামাল, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ, ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার মো. রুহুল আমিন ও ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এমনিতেই বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পাননি, শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও নির্ভীক আত্মদানই তাঁদের আকাশসমান সম্মানে ভূষিত হওয়ার নেপথ্য কারণ।

 যুদ্ধগাথা ১৯৭১ সব বয়সীদের জন্য সহজ-সরল ভাষায় লেখা এমন এক বই, যা পাঠ্যতালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্বের কথা সংক্ষিপ্তাকারে জানতে হলে বইটির বিকল্প নেই।