সারেং বৌ ও ইংরেজি অনুবাদ

শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ ও অনূদিত আ সি ম্যান’স ওয়াইফ–এর প্রচ্ছদ
শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ ও অনূদিত আ সি ম্যান’স ওয়াইফ–এর প্রচ্ছদ

কিছু মানুষের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে দেশ, মা, মাটি, গণমানুষ, সংস্কৃতি, স্বাজাত্যবোধ—এ রকম কিছু শব্দ ঠেলাঠেলি ভিড় বাধিয়ে দেয় ওই নামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-১৯৭১) তেমনি এক নাম। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর যাঁদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথ তৈরি হয়েছিল, একটি জাতি এগিয়ে যাচ্ছিল মুক্তির দিকে, শহীদুল্লা কায়সার তাঁদের অন্যতম। ছাত্রজীবন থেকেই সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন একটি উদার অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার। স্বপ্ন দেখেই শুধু ক্ষান্ত হননি, এ জন্য আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গিয়েছেন। কাজ করতে গিয়ে নিজের নামটি পর্যন্ত প্রায়শ মুখে নিতে পারেননি, ছাপতে পারেননি নিজের চিন্তাকর্মের পাশে। কখনো ‘বিশ্বকর্মা’ কখনো ‘দেশপ্রেমিক’ কখনোবা ‘তালেব ভাই’ নামে আড়াল করেছেন নিজের নামটি। স্বপ্নের দেশ যখন অর্জিত হয়ে যাচ্ছে, তখন আর তাঁর শেষ রক্ষা হলো না। বিজয় দিবসের মাত্র দুই দিন আগে জীবন দিয়ে বিজয় দিবসে স্বনামে ফিরলেন। ফিরলেন মা, মাটি আর স্বদেশের লাল-সবুজ পতাকায়।

শহীদুল্লা কায়সারের সত্তার দুই কামরা। এক কামরায় তাঁর রাজনীতি আর অন্য কামরায় তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম। সারেং বৌ আর সংশপ্তক উপন্যাস দুটি তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যপ্রতিভার উত্তুঙ্গ প্রকাশ। যদিও এগুলো তাঁর রাজনৈতিকতারই অন্য প্রান্ত। সারেং বৌ শহীদুল্লা কায়সারের জনপ্রিয়তম উপন্যাস। কারণ, উপন্যাসটিতে সারেং কদম আলী আর তার স্ত্রী নবিতুনের সংগ্রামের চিত্তাকর্ষক আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে। তবে ‘সারেং বৌ নবিতুনের জীবনসংগ্রাম’কে আনিসুজ্জামান এই উপন্যাসের মূল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু উপন্যাসটি কি শুধুই তাই!

শহীদুল্লা কায়সার (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭-১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিখোঁজ)
শহীদুল্লা কায়সার (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭-১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিখোঁজ)

সমকালীন দেশকালের রাজনীতির মধ্যে বাঙালির সংগ্রাম আর সোনালি সকাল কি আভাসিত হয়নি নবিতুন ও কদমের সংগ্রামের রূপকের মধ্য দিয়ে! আনিসুজ্জামানই যেমনটি বলেছেন, ‘নবিতুন বাংলা সাহিত্যের আরেকজন সতীসাধ্বী নয়, নিজের অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষায় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধরত নারী, পরিণামে তার মুখে সদ্য জাগা পলির স্নিগ্ধতা, বিজয়িনীর গৌরব। ’ যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সারেং বউ এক ঢিলে দুই পাখি মারার শিল্পকর্ম বটে। উপন্যাসটির অন্য একটি প্রান্তও আছে। সেটি হচ্ছে পূর্ববঙ্গের ভাষাসমেত এর জনজীবনের গভীর তলকে স্পর্শ করার ক্ষমতা। উপন্যাসটিতে পূর্ব বাংলার জনজীবনের এমন একটি গভীর স্বরকে শহীদুল্লা কায়সার তুলে ধরেছেন যে, এই উপন্যাসটির কোনো অনুবাদ হয় না। অনুবাদে পূর্ব বাংলার জনজীবনের স্বকীয় স্বরটি তুলে আনা অসম্ভব। তবু উপন্যাসটির একটি ইংরেজি অনুবাদ আছে। অনুবাদটি করেছেন কূটনৈতিক ও লেখক সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম (১৯২৫-১৯৯৯। অনুবাদে তিনি এর নাম দিয়েছেন আ সিম্যান’স ওয়াইফ। অনুবাদ অসম্ভব উপন্যাসটির অনুবাদ কীভাবে হলো তা একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে।

সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম শহীদুল্লা কায়সারের প্রায় সমসাময়িক ছিলেন। তিনি ও শহীদুল্লা কায়সার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে পড়তেন। একই বছর ১৯৪৬ সালে নাজমুদ্দীনও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স পাস করেন। উভয়েরই কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল। সেই সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কে গড়িয়েছিল। আ সিম্যানস ওয়াইফ এই পারিবারিক বন্ধুত্ব ও জাতির জন্য শহীদুল্লা কায়সারের রক্তের ঋণস্বীকারের চেষ্টা বললে খুব ভুল হবে না বলেই মনে হয়।

সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম (১ জুন ১৯২৫—১৮ জুলাই ১৯৯৯)
সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম (১ জুন ১৯২৫—১৮ জুলাই ১৯৯৯)
অনেক কাল আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের বিখ্যাত উপন্যাস সারেং বৌ–এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন কূটনৈতিক ও লেখক সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম। তাঁর অনূদিত সেই বই আ সি ম্যান’স ওয়াইফ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। বিজয়ের মাসে এই বইটিকে ধরে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট, লেখক ও অনুবাদ প্রসঙ্গ—সবকিছু মিলিয়ে লিখেছেন কুদরত–ই–হুদা।

আসলে যেকোনো খাঁটি সাহিত্যকর্মের মধ্যেই একটা দেশাল ব্যাপার থাকে। স্থানীয় মাটির গন্ধ লেগে থাকে। ওই নিজস্ব ‘সেন্ট’ বা বাসনার অনুবাদ হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কঙ্কাল বা কাঠামোগত একটা ভাষান্তর হয় মাত্র। উপন্যাসের ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশি সত্য। কারণ, একটা উপন্যাস মানে শুধু একটা কাহিনি নয়। একটা উপন্যাস মানে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বহু মানুষের বিচিত্র স্বর আর সংস্কৃতির জমজমাট আখ্যান। এর পুরোপুরি অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। তার ওপর আবার উপন্যাসটা যদি হয় সারেং বৌ তাহলে তো আরও জটিল। কারণ, এই উপন্যাসে বাংলাদেশের ‘কোনো এক পানি এলাকা’র একেবারে আঁতের সংস্কৃতি উঠে এসেছে। এই বিশেষ সংস্কৃতির আকাঁড়া বাস্তবকে তুলে ধরতে গিয়ে শহীদুল্লা কায়সার প্রায়শ এমন এক ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করেছেন, যার স্বরভঙ্গি বা টোনের সঙ্গে ওই সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই টোন বা স্বরভঙ্গি অন্য ভাষায় তুলে আনা প্রায় অসম্ভব। সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম সেই অসাধ্যকে সাধন করার সাহস দেখিয়েছেন।তাঁর ইংরেজি অনুবাদ পড়ে বেশ বোঝা যায়, তিনি কাহিনি-কঙ্কাল অনুবাদ করতে চাননি। তিনি তাঁর অনুবাদে মূল উপন্যাসটির প্রাণের স্পন্দন সঞ্চার করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ মূল উপন্যাসে বিধৃত সংস্কৃতির উদ্বায়ী অধরা সুগন্ধকে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য তিনি ‘বরই’কে ‘প্লাম’ বা অন্য কোনো ইংরেজি শব্দে অনুবাদ করেননি। ‘সের’কে কেজি বা ‘বিড়ি’কে ‘সিগারেট’-এ অনুবাদ করেননি। এ তো গেল শব্দগত বিষয়াদির কথা। এবার ভাষা আর তার ভঙ্গির একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘গুঁজাবুড়ি কুটনী বুড়ি, গুঁজাবুড়ি পুবপাড়ার লুন্দর শেখের কুটনী মাগি, গুঁজাবুড়ি নবিতুনের নয়ন জ্বালা, গায়ের জ্বালা, গলার বিষ। ’ বাংলা ভাষার বাগ্ধারা ও বাগ্বিধি দিয়ে ভরা এই বর্ণনার মধ্যেকার টোন আর অন্তর্নিহিত অনুভবের অনুবাদ কী করে সম্ভব!

 কিন্তু নাজমুদ্দীন হাশেম বেশ সফলতার সঙ্গে এসবের অনুবাদ করেছেন তাঁর আ সিম্যান’স ওয়াইফ অনুবাদটিতে।

নাজমুদ্দীন ইংরেজি বিষয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি ইউরোপ-আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ইংরেজি ভাষায় গভীর দখল ছিল। এ জন্য সফল অনুবাদ করতে পেরেছেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি পেরেছেন, কারণ তিনি বাঙালি। কোনো বিদেশির পক্ষে এ কাজ প্রায় অসম্ভব। নাজমুদ্দীন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির হাঁড়ির খবর জানেন। তিনি নিজেও সাহিত্যিক ছিলেন। এ কারণে কাজটি তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাই তিনি আ সিম্যান’স ওয়াইফ-এ সারেং বৌ উপন্যাসের প্রাণস্পন্দনটা ধরতে পেরেছেন। তা ছাড়া বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের প্যাশন তাঁর বরাবরই ছিল। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও শামসুর রাহমানের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের কৃতিত্ব তাঁর সফলতার খুঁতিতে আগে থেকেই জমা ছিল।

১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে দেশপ্রেমের দায়ে শহীদ হন শহীদুল্লা কায়সার। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থেকে আমৃত্যু তিনি লড়াই করেছেন পাকিস্তানি শোষণ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপরও দাঁড় করিয়েছেন। প্রথমা প্রকাশন শহীদুল্লা কায়সারের শহীদ হওয়ার দিনে ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশ করেছে তাঁর সারেং বৌ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের করা এই অনুবাদের মধ্য দিয়ে শহীদুল্লা কায়সারের বাঙালি সংস্কৃতি-সাধনার ফসল ছড়িয়ে যাবে বিশ্বদরবারে। শহীদুল্লা কায়সারের রক্তের ঋণ শোধ করা এই জাতির পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু ঋণস্বীকারের এই উদ্যোগ বাঙালিকে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে সাহায্য করবে।