শব্দের, চিত্রকল্পের কারিগরি

মাইকেল মধুসূদনের মতে ‘শব্দের সঙ্গে শব্দের বিয়ে দেন’ যিনি, তিনি কবি। কবি কি তাহলে ঘটক, নাকি বিষযজ্ঞের পুরোহিত? এ প্রশ্ন শুনলে মধুসূদন হয়তো বলতেন, দুটোই। তিনি যে ঐতিহ্যের কবি ছিলেন, তাতে শব্দের ওজন ছিল, ব্যঞ্জনা-দ্যোতনা-অভিঘাতের আবশ্যকতা ছিল। শব্দের সঙ্গে শব্দ মেলানো পূত কাজ ছিল। বাংলা সাহিত্যে ইউরোপীয় ধারার আধুনিকতার আত্মপ্রকাশ, গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই, শব্দ নিয়ে কবির চিন্তা বদলে দিল। বিবাহযোগ্য শব্দের পরিবর্তে প্রতিদিনের ব্যবহৃত আটপৌরে শব্দ; বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সক্রিয়তার নানা অঞ্চলের শব্দ ঢুকে পড়ল কবিতায়। কবির উদ্দিষ্ট (অর্থাৎ ‘যথাশব্দ’) হওয়ার পরিবর্তে শব্দ হয়ে দাঁড়াল চিহ্ন, যার সংযুক্তির সুতা ছড়ানো মনঃস্তত্ত্ব থেকে নিয়ে নৃতত্ত্বের অঞ্চলে, নিশ্চিত অর্থের বাইরে অনিশ্চিত অর্থহীনতায়ও। তারপরও এসব শব্দকে সাজিয়ে-বাজিয়ে যখন কবিতায় অনিবার্য করে নিয়ে আসেন কবি—সকলেই নন, কেউ কেউ—তাঁরা আমাদের কিছু অবাক-পাঠ উপহার দেন।

কবিতা পড়ার আনন্দ ফিরিয়ে দেন। এই সময়ে বেশ কিছু তরুণ কবি এই কাজ করছেন। তাঁরা কবিতা নিয়ে ভাবেন, শব্দের গহিনে যান, কবিতার হয়ে ওঠাকে এক কাঙ্ক্ষিত রসায়নের বিষয় করে তোলেন।

ক্ষুধা ও রেস্তোরাঁর প্রতিবেশী
ক্ষুধা ও রেস্তোরাঁর প্রতিবেশী
ক্ষুধা ও রেস্তোরাঁর প্রতিবেশী
পিয়াস মজিদ
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য,
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা,
প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৯
৪৭ পৃষ্ঠা,
দাম: ১৫০ টাকা।

এই তরুণদের একজন পিয়াস মজিদ। তাঁর ক্ষুধা ও রেস্তোরাঁর প্রতিবেশী পড়ে মনে হলো, শব্দের সঙ্গে শব্দ জুড়ে দেওয়ায় তাঁর কুশলতা এক বড় গুণ, শব্দ/শব্দগুচ্ছকে চিহ্নের অঞ্চল থেকে নিয়ে চিত্রকল্পের অঞ্চলে স্থাপন করার শক্তিটি তাঁর স্বভাবজাত।
কবিতার ভেতরের যে পৃথিবী, যা কবির কাছেও কখনো কখনো অচেনা মনে হতে পারে, তাতে পা রেখে তিনি অনেক অভাব অনুভব করেন—সংগীতের অথবা সঙ্গীর যেমন অথবা সুস্থিতির। সেগুলো তিনি পূরণ করেন চিন্তা ও বোধের নানা দৃশ্যপট রচনা করে, চেনা দৃশ্যের ওপর অচেনা আলো ফেলে সেগুলো বদলে দিয়ে।

পিয়াস মজিদের কবিতা লিরিকধর্মী, অন্তর্মুখী। সময় তাঁকে তাড়ায়, বাস্তব তাঁকে যে ভাষা দেয় (সাংবাদিকতার, প্রযুক্তির, বাজারের), তাকে ঘনবদ্ধ একটা রূপ দিয়ে তিনি তাঁর কবিতা নির্মাণ করেন। তাঁর সহজ প্রকাশ হ্রস্ব কবিতায়, দীর্ঘ কবিতায় নয়, যেমন ‘জীবনানন্দ: আমার অসুখ ও আরোগ্য’–তে কবিতার নিপাট ভাবটি নেই, কিছুটা যেন প্রলম্বিত। তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বর্ণনাধর্মী কবিতায় নয়, বরং বর্ণনাকে সংক্ষিপ্ত এবং নিরেট একটি রূপ দিয়ে চিত্রকল্পের আদলে বিষয়কে প্রকাশ করায়:

‘আর দেখি

জল ও এত আগুন উজিয়ে

বুকের ভেতরের পরানপদ্মে

তুমিই চলেছ জ্বলে

শ্যাওলা-সবুজে।’

(মনোনীল)

অথবা

‘থেকে থেকে

এই পাষাণপ্রহর

জানায় আমাকে,

মৃত্যু মূলত মিউজিক

প্রতিটি কফিনে

কিছু সুর লেগে থাকে।’

(মৃত্যু মূলত মিউজিক)

এ রকম প্রকাশকুশলতার নিদর্শন। শব্দকল্প নির্মাণে পিয়াস মজিদের স্ফূর্তির কথা উল্লেখ করেছি, কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক: ‘হৃৎচড়ুই’, ‘আকাশকান্না’, ‘উড়ালশকুনি’, ‘স্তন-স্তনান্তরে’, ‘কুহুক্লান্ত কোকিল’, ‘পাষাণপ্রহর’। তা ছাড়া ‘মৃত্যুতম দিন’, ‘প্রোজপোয়েমের অন্ধকার’, ‘শয়তানের বায়োপিক’ অথবা ‘লিবিডোর ফুল’ আমাদের ভাবায়। প্রযুক্তিও আছে:

প্রেম ও পানির বিল

বিরহ ও বিদ্যুৎ বিল

এফবি, হোয়াটসআপ,

ভাইবারের ভার-সমেত

খোলা রাস্তায় এসে দাঁড়াই।

(শুভ নববর্ষ)

মৃত্যু নিয়ে পিয়াসের ভাবনা অনেক, তবে শেষ বিচারে মৃত্যু হচ্ছে সংগীত। অনেক কবিতায় সংগীত এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এবং উপস্থিতি মল্লার থেকে নিয়ে সাহানা অথবা বেহাগ তাঁর কবিতায় বেজে যায়। বেলাল চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে লেখা দ্বিতীয় এলিজিটি কয়েকজন কবির ভাষ্যে তৈরি এক চমৎকার কথা-কোলাজ:

‘তুষার রায়  :  শেষ নৌকা রেডি, বেলাল কোথায় তুমি?

সুনীল      : যৌবনজ্যোৎস্না-জলে হবে নাকি ফের

                কুমিরের চাষ?

শ্যামল     : স্বর্গে ঢুকব তিন পাপী আমরা, নাকি

                দাঁড়াব গিয়ে নীল নরকের দরজায়?

সন্দীপন   : কলকাতার কোন গোরস্তানে আমাদের

                সেইসব রাত্রি শুয়ে আছে?

শক্তি       :  আমরা তো নেই, এখনও কি আমাদের

                সুরে ও সুরায় সন্ধ্যা নামে খালাসিটোলায়

                কিংবা কক্সবাজারে?

কমলকুমার  :  এই নভোমণ্ডল আমাদের মৃত্যুফলে নীলাভ হলো আলো আসার কত দূর বলো?’

(এলিজি বেলাল চৌধুরী)

এই বইয়ে চমক আছে ক্ষুধা, খাদ্য ও শস্যের ভাষাকে মাঝেমধ্যেই সরব করাতে, বুদ্ধদেব বসু আর জীবনানন্দ দাশকে তাঁদের উপমা-উৎপ্রেক্ষার মধ্য দিয়ে কবিতার ভেতরে নিয়ে আসাতে। এই দুই কবি পিয়াস মজিদের মনোবিশ্ব গড়ে দিয়েছেন কিন্তু তাঁদের কবিতা, কবিতার সুর থেকে দূরে থাকাটা তাঁর দূরযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয়।