উদয়াস্ত

‘শামসুল শায়ের’ নামে প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের অগ্রন্থিত গল্প
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঠিক গলি ওটা নয়, তবে গলির বিশেষত্বই ওতে আছে। চওড়া হলে হবে কি, চারদিকে অসম্ভব রকম ঘিঞ্জি হয়ে কতগুলো দোতলা, আর তার আশপাশে মেলা একতলা, টিনের ঘর। নোনাপড়া, ইটখসা দোতলাগুলো গলিটার হাড় বের করা চিবুকের মতো দেখতে। বড্ড বিশ্রী! তার ওপর পথে হাজারো রকম আবর্জনার ভিড়, আর তা থেকে বেরুচ্ছে অসহনীয় ভাপসা গন্ধ। লোমওঠা কতগুলো কুকুরের আস্তানা হয়েছে পথের খোদলগুলোয়। এমনিতেই ও রকম, তার ওপর মিউনিসিপ্যালিটির গরুটানা জলের গাড়ি যখন জল ছিটায়, তখন আরও বিশ্রী হয়ে ওঠে। পথচলাই দুষ্কর। মনে হয়, এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে না। আন্তাবলও তো এর চেয়ে ঢের ঢের ভালো। কিন্তু তবু এখানে মানুষ থাকে, আর তারা আমাদেরই মতো রক্ত–মাংসের মানুষ, তাদেরও রক্ত বয়ে চলে, হৃৎস্পন্দিত হয়।

কিছুক্ষণ আগে পথে একচোট জল ছিটানো হয়ে গেছে। লায়লা পথের রকম দেখে থিতিয়ে যায়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, লম্বা, মিহি সিল্কের শাড়ি প্লেন করে পরা, ঘড়িও হাতে আছে, গহনা বাহুল্যবোধে বিশেষ নেই। এমনি এক তরুণীর পক্ষে আঠালো কাদামাখা পথ পেরোনো অসুবিধা বৈকি। ও যে ফিরে যাবে, তা–ও পারে না। যার খোঁজে সে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা না করলেই নয়। কে জানে বেঁচেই আছে কি না। সে আজ বারো বছরের কথা, প্রথম প্রথমে সে চিঠি দিত কিন্তু পরে আর দেয়নি। ওর ঠিকানা জোগাড় করতে কী কষ্টটাই না করতে হয়েছে! লায়লার ভ্রু দুটোর ওপর ফোঁটা ফোঁটা ঘামও জমে ওঠে, মাঘ–ফাল্গুন সন্ধিক্ষণে। ও সপ্রতিভ হয়েই এগোয়। অনেক নেমপ্লেটই চোখে পড়ে, কিন্তু তারটাই যেন ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে এদিকে–ওদিকে তাকায়। চারপাশ দিয়ে মেলাই লোক যাচ্ছে–আসছে, কিন্তু প্রশ্ন করবার মতো উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পেল না। ভাবে, আচ্ছা এমনি যদি হতো যে সে পথ চলতে চলতে ওর সামনে পড়ে গেল। কেউ কাউকে চিনতে পারল না প্রথমে, কিন্তু যেন দুজনারই দুজনকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। তারপর তার চিন্তা ভেঙে যায় কোনো এক অপরিচিত স্বরে। এমন এক তরুণীকে এমন বিপাকে দেখে আকৃষ্ট হয়েছে, বিচিত্র কিছু নয়।

কাকে চান?

আচ্ছা, নাসির সাহেবকে চেনেন? এখানে এই গলিতেই থাকেন।

নাসির সাহেব? লোকটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। নাসির সাহেব। দেখুন নাম্বার–টাম্বার না হলে কে কাকে চেনে, বলুন?

লায়লা সংশোধনের সুরে বলে, হ্যাঁ সে ঠিক। তবে এ অঞ্চলে সবাই তার বাবাকে চিনত অন্তত। আরেকজন বেশ মাস্টারি গোছের ভদ্রলোক ওর কথার মাঝখানে খনখনে গলায় বলে উঠল, কণ্ঠে তার তিক্ততার আভাস, আজ্ঞে ও রকম নামডাকি মানুষ তো কতই ছিল, এখন আর তাদের গন্ধটুকুও পাওয়া যায় না। কোত্থেকে ভুঁইফোড় সব শরিফ একেকজন হয়েছেন, তাদের দাপটে...বলতে বলতে লোকটা চলে গেল, দাঁড়াবার সময়টুকু নেই।

লায়লার চারপাশে তখন বেশ ছোটখাটো ভিড় জমে উঠেছে। ওদের মধ্যে কে এক তরুণ, বেশ ফিটফাট, হাবভাব দেখে মনে হয় লেখেটেখে বোধ হয়—হবেও–বা—আজকাল তো আর কবি–সাহিত্যিকের অভাব নেই, পথেঘাটে সব গজাচ্ছে—এগিয়ে এল, ও আপনি নাসির সাহেবকে চান, আসুন, আমার সাথে আসুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।

লায়লা যেন এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারল। যে বদ্ধ আবহাওয়া! পথে যেতে যেতে তরুণটি বলে, নাসির সাহেব এককালে নাকি খুব নামকরা ছিলেন, এখন তো তার গন্ধটুকুও নেই। নেহাৎ আমরা মানুষের ঘরের খবরাখবর খুঁজে বেড়াই কিনা! হ্যাঁ, কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, ভদ্রলোককে নিয়ে একটা নভেল লিখছি, সত্যি ট্র্যাজেডিভরা জীবন।

কথাগুলো লায়লার কানে যায়নি। তরুণ একবার বাঁকা চোখে চেয়ে দেখল, ঢোঁক গিলে বলল, এই যে এসে গেছি, আসুন এই দরজা দিয়ে ভেতরে গিয়ে দোতলায় উঠে খোঁজ করুন। তাকে ঠিকানাটা বাতলে দিয়ে চলে যায়। লায়লা সন্তর্পণে দরজার দিকে এগোয়। বার-দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে এক মাঝারি রকমের উঠানে গিয়ে পড়ল। উঠানটা হয়তো কবে ইট দিয়ে বাঁধানো হয়েছিল, তারই স্মৃতি বয়ে দু–এক টুকরো ইট মাথা বের করে পড়ে আছে। একধারে একটা জলের কল। কলসি ঠিক মুখের নিচে বসতে পারে না বলে খানিকটা জায়গা কুঁদে নেওয়া হয়েছে। একটার পর একটা কলসি ভরে নিয়ে যাচ্ছে, তবে নির্বিবাদে নয়, ঝগড়া হচ্ছে বৈকি। কে লাইন ভেঙেছে, ওলট–পালট করছে, ফলে অশ্লীল গালাগালের ছড়াছড়ি চলছে।

নিচের বারান্দাটা ঘেরা দিয়ে নিয়ে কমসে কম আটটা রান্নাঘর করা হয়েছে। প্রচুর ধোঁয়া বেরোচ্ছে—দেয়াল মলিন করে নিশ্বাস বন্ধ করে দিয়ে তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে। দোতলাতেও এমনই, তবে সংখ্যায় কম। নিচে কে এক বুড়ো ভদ্রলোক তখনো একমনে খবরের কাগজ পড়ছে এক্কেবারে চোখের ওপর ধরে—পয়সা নেই চশমা কিনবে, কিন্তু পড়বার শখ প্রচুর। এরা এমনই পাঠক যে মায় প্রকাশক, মুদ্রাকরের নামটা পর্যন্ত পড়ে। ওধার থেকে এক ছোট ছেলে কেঁদে উঠল। অসহায় মা ঠাস করে চড় কষিয়ে দেয়।

দোতলার জলের পাইপগুলো জলে জলে ক্লেদাক্ত হয়ে মাসের পর মাস তরকারি, মাছ, চাল-ধোয়া জলে বিশ্রী রকম শেওলা তৈরি হয়েছে। বাঁ ধারে দুটো ছেলেমেয়ে মাদুরে বসে, ওরা কিছুতেই এত কম খাবার নিতে চাইছে না, মা ক্রমে ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠছে—হাতে পয়সা প্রচুর নেই যে তাদের হাতে দুটো বেশি তুলে দেবে।

লায়লা দোরগোড়ার দাড়িয়ে একমুহূর্তে সব দেখেশুনে নিল। এটাই তবে নাসিরের আস্তানা, অথচ সে তো বড় জমিদারের ছেলে। চারপাশ থেকে পথের মতোই প্রশ্ন হতে থাকে, যেন কোনো দর্শনীয় বস্তু আরকি।

আচ্ছা, নাসির সাহেব এখানেই কোথায় থাকেন, বলতে পারেন কি?

নাক তার জ্বালা করছে। কোনো দিক কোনো রকমের জবাব নেই। অস্বস্তিকর মনে হয়। এক খুনখুনে বুড়ো কাঁপতে কাঁপতে শুধায়, কে গা? মালিকানি এয়েছ বুঝি? তা বাপু তোমাকেই বলছি, এমন বাড়িতে মানুষ থাকে? আগেই অল্পে বেশ ছিনু, কজনকে না উঠিয়ে দিলে আর হচ্ছে না। এটা কি গোয়াল পেয়েছ? দুটো যে ধর্মকর্ম করব! কয়েকজন বুড়োর দিকে হাঁ হাঁ করে এগিয়ে এল। লায়লা বলতে যায় যে সে মালকানি নয়। কিন্তু তার আগেই সেই বুড়ো নিশানা বলে দেয়। লায়লা এগিয়ে যায়, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। সিঁড়িটা কী নোংরা আর জলে জলে পেছল! পেছনে সব্বাই তার দিকে তাকিয়ে। লায়লা ততক্ষণে উঠে গেছে। নম্বর মিলিয়ে দরজায় টোকা দেয়। একটা ছোট ছেলে—উলঙ্গ, শীর্ণ—বেরিয়ে আসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে চলে যায়।

এবার বোধ হয় ওর মা আসে।

এটা কি নাসির সাহেবের বাসা নাকি?

হ্যাঁ ভাই, তা আপনি কাকে খোঁজ করছেন? মাথায় আঁচল তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে।

ওই নাসির সাহেবকেই। আঙুল তুলতে গিয়ে লায়লার সরু লম্বা আঙুলগুলোয় একসাথে তিন–তিনটি আংটি ঝিকমিক করে ওঠে ম্লান আলোতেও। বউটি ম্লান হয়ে যায়, মিইয়ে পড়ে।

না তিনি তো এখন নেই, বাইরে আছেন, এক্ষুনি আসছেন। তা বসুন না। এটুকু বলে হাঁপিয়ে পড়ে।

না থাক, আর বসছিনে, আর একদিন আসব, বাড়ি তো চিনেই গেলাম।

সে কি হয়?

নিশ্চয়ই হয়।

কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না, উনি এলে বলব খন।

লায়লা মৃদু হেসে বলে, সে অনেক কথা, লম্বা পরিচয়। এককথায় কি বুঝবেন? উনিই ঠিক চিনতে পারেন কি না কে জানে?

বউটি হাসতে চায়, কিন্তু পারে না, থেমে যায়। ততক্ষণে লায়লার গালে টোল পড়েছে।

আপনি?

আমি ওর স্ত্রী।

ও।

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে, আসুন না।

না আর না, আচ্ছা। লঘু পদক্ষেপে লায়লা নেমে যায়। উঠোনটা আধ মিনিটেই পার হয়ে যায়। গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে। এখনো ল্যাম্পগুলো জ্বালেনি। লায়লা দ্রুত পা ফেলে, এই বুকচাপা আঁধার এড়াতে।

ঠিক পরের দিনই লায়লা এসে হাজির হয়। বিকেলবেলার শেষ দিকে। তখনো বাড়িটায় নিস্তব্ধতা নেমে আসেনি। রান্নাঘর থেকে ভাজাপোড়ার ছ্যাঁকছ্যাঁকানি শব্দ আর ছেলেদের ক্লান্ত কোলাহল ভেসে আসছে। লায়লা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। বউটি হঠাৎ হলুদবাটামাখা হাত নিয়ে লায়লার সামনে পড়ে যায়।

স্নিগ্ধ স্বরে ও প্রশ্ন করে,Ñকী আপা, আজকে আবার এলুম, উনি আছেন তো?

এলোমেলো চুলগুলো হাতের মুঠো দিয়ে ঠিক করতে করতে জবাব দেয়, হ্যাঁ আছেন, আপনার কথা ওঁকে বলেছিলুম, আসুন। বউটির কথাবার্তা–চালচলনে চেহারার কোথাও এতটুকু মাধুর্য নেই। তবে বোধ হয় কোনো দিন ছিল? ওর সাথে যেন এই বাড়িটার এক বড় রকমের মিল আছে।

দরজা দিয়ে এগোয়। বউটি রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। পর্দা ঠেলে ভেতরে যেতে ওর ইচ্ছে করে না, যে নোংরা পর্দাটা, বাপ রে! বাঁ হাত দিয়ে সরাতে লায়লার গা ঘিনঘিন করে। ফাঁক দিয়ে নজর চালিয়ে দেখে, ভেতরে কে বসে বসে গেঞ্জি সেলাই করছে আর গুনগুন করে সুর ভাঁজছে। এক্কেবারে নাসিরের গলা। ঠাসাঠাসি–গাদাগাদি বস্তা, ট্রাঙ্ক, লেপ, কলসি আরও শতেক রকম তৈজসপত্র। কোনো দিকে মাকড়সা জাল বুনে বুনে ঠাস করে ফেলেছে। দুই–এক টুকরা চুনসুরকি ছাদ থেকে খুলে মেঝেয় পড়েছে। দেয়ালে পেরেক মেরে মেরে দড়ি টাঙানো হয়েছে আলনার কাজ চালাতে। মেঝেতে একটা মোড়ায় বসে নাসির একমনে সেলাই করেছে। একনিশ্বাসে লায়লা গোটা ছবিটা গিলে ফেলে। আশ্চর্য হয় ও। তবে কি সে সবই কর্পূর ছিল? কে জানে।

নাসিরের কোনো সাড়া না পেয়ে ওকে গলা খাঁকারি দিতে হয়। নাসির হঠাৎ করে পেছনে তাকিয়ে থিতিয়ে যায়, একটু ভ্রু কুঁচকায়। লায়লার মুখে হাসি।

কি, আমাকে চিনতে পারছেন না?

না তো। স্মৃতির পাতায় খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। ওকে চেনা চেনা বলে মনে হচ্ছে।

তা চিনবেন কী করে, ভাঁড়াচ্ছেন নিশ্চয়, আলবৎ। ভেবেছিলেন খুব লুকিয়ে ছিলেন, কিন্তু তা তো আর হলো না, বের করে ফেললামই, কী বলেন?

দেখুন আপনাকে চিনি না, অথচ আপনি আমায় চেনেন, আশ্চর্য তো?

আশ্চর্যই তো, বউটি পাশের ঘর থেকে টিপ্পনি কাটে, বলেছিলেন যে একটুতেই চিনতে পারবে, কই! সুরে একটা চাপা করুণতার আভাস! নাসির চমকে ওঠে।

তাড়াতাড়ি রান্না সেরে শুয়ে পড়ো তো চটপট। অসুখবিসুখ শরীর। এমনেই তো ওতে আমার অর্ধেক করে কমাচ্ছ। তা–ও যদি সার্থক হতো। লায়লার দিকে ফিরে নাসির মুখে প্রসন্নতা ফিরিয়ে আনে।

কী অসুখ ওঁর?

অসুখ? তার কি আর অন্ত আছে! আজ জ্বর, কাল বাত, পরশু মাথাব্যথা, দাঁতব্যথা, হেনতেন। এক্কেবারে অস্থির করে তুলেছে। আর হয়েছে কী, জানেন?Ñআজকাল আমাদের মতো সব্বার বউয়েরই ওই একই অসুখ। কিছু বোঝবার উপায় নেই। রাত হলেই সব উপসর্গ একে একে হাজির হয়।

তা, ভালো ডাক্তার দেখালেই পারেন।

হুঁ, ডাক্তার! যা পাই তাতে ডাক্তার, তার আবার ভালো। বেশ বলেছেন আপনি।

লায়লা কী বলতে চায়, কিন্তু নাসির বাধা দেয়, থাক ওসব ঘরোয় কথা বাদ দিন।

কেন ঘরোয়া কথা কি আমার সাথে কইতে মানা? অথচ একদিন...

রেখে দিন, রেখে দিন। আরে বসুন, এ কী, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যে।

ও মোড়াটায় বসে পড়ল।

নাসির চলে গেল। নিজে চা তৈরি করল অনেকক্ষণ ধরে সাধ্য করে। তা যত্ন করে কোনোমতে একটা পেয়ালায় ঢেলে লায়লার সামনে তুলে ধরে।

এ কী করছেন? চা তো খাই না বিশেষ।

তবু খেতে হয়।

লায়লা অবশেষে পেয়ালা হাতে নিতে নিতে বলে, আপনি?

আপনি খান, আমার কথা পরে।

বাধ্য হয়ে চুমুক দিতে হয়। নাসির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, পাশের ঘরে খোকা কেঁদে ওঠে, নাসির এগিয়ে যায় শান্ত করতে।

লায়লা চা শেষ করে, পেয়ালা নিয়ে সোজা ভেতরে যায়। কিন্তু ভেতরের দৃশ্য দেখে আর ভাবতে পারে না। দশ বছর আগে যা ছিল, আজ তা এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে? চকমিলান দালান, লোকজনের বাড়ি গমগম, বিরাট পাকশালা, একে একে মনে পড়ে যায়! ক্লান্তভাবে একবার এদিক ওদিক চায়। দেখে যেন মনে হয়, কোথায় এর ভাঙা বীজ এখনো রয়েছে। তা যা–ও আছে, সব শেষ করে দিয়ে যাবে।

পেছন থেকে নাসির এসে পেয়ালাটা কেড়ে নেয়। হেসে বলে, চলুন বাইরে, আপনারা সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের মানুষ। এখানে কি ভালো লাগবে?

লায়লা প্রতিবাদ করে, কেন, এখানেই ভালো আছি। উঁহু, সত্যি কথা বলুন। নাসির লায়লার হাত ধরে টান দেয়, আসুন।

একবার আপার সাথে দেখা করলাম না, কী ভাববে, বলুন তো?

দেখুন, আমাদের কাছে লৌকিকতার কোনো দাম নেই, আসুন। যা ছিল তা কবে খোয়া গেছে।

একরকম জোর করে নাসির লায়লাকে টেনে বের করে নিয়ে যায়। আশপাশের লোকগুলো চেয়ে থাকে চল্লিশোর্ধ্ব লোকটার সাথে ওকে দেখে।

পথে যেতে যেতে নাসির বলে, দাঁড়াও। পানের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে নেয়। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে একবার বিড়িটার দিকে চেয়ে দেখে। লায়লা বিড়ির কটু গন্ধে বিরক্ত হয়ে গেছিল, কিন্তু এখন আর না হেসে পারল না। নাসির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, কী, হাসলে যে?

এমনি। যাহোক, তাহলে আপনি আমায় চিনতে পেরেছেন।

কেমন করে?

যেমন করেই হোক, কিন্তু আপনি যে এত মেধাবী, তা তো জানতাম না আগে।

নাসির হাসে, মরণের দোর থেকে যেন। লায়লা বিব্রত হয়ে যায়। অবশেষে ওরা গলি ছাড়িয়ে রাজপথে এসে পড়ে। ও জিজ্ঞেস করে, চুপ করে যে, আরে যাচ্ছেন কোথা?

চলো না, কোথাও বসা যাক। কি–না–কি বলতে এসেছিলে, বলবে না? চলো, সামনেই আমার এক ফ্রেন্ডের লন্ড্রি আছে, বসা যাবে খন, নিরিবিলি। লায়লা আশ্চর্য হয় ওর রুচিবোধ দেখে। এর চেয়ে তো ওই ঘিঞ্জি গলিটাই ভালো ছিল।

লায়লা বলে, না, তাহলে থাক।

অবশেষে ও নাসিরকে একরকম জোর করেই এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। নাসিরের আপত্তি গুঞ্জিত হতে থাকে। ও হতবাক। অনেককাল পর সে আবার এদের মাঝে এল। ভাবতে ভাবতে নাসির খাবার মুখে তোলে। এমনি গোগ্রাসে খেতে শুরু করে যে লায়লা চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কত দিন ধরে লোকটা খায়নি? এমন ব্যস্ত যে কোনো দিকে তাকাবার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। অবশেষে লায়লাকেই মুখর হতে হয়, সত্যি আমি এখনো ভেবে উঠতে পারছি না যে কেমন করে কালের চাকা ঘুরে গেল। ভেবেছিলাম রতনপুরের বাড়িটার মতো, যমুনা-খালের ধারের বাগানবাড়ির মতো এখনকারটাও অমন একটা কিছু হবে। কিন্তু যা এসে দেখলাম, তাতে তো সমস্ত তলিয়ে গেল। এর ফলে আপনাকে খুঁজে বের করতে...

লায়লার মুখের কথা মুখেই রইল।

নাসির আহত স্বরে বলে—কণ্ঠে তাদের বেদনার আভাস, লায়লা, সত্যি করে বলো দেখি, কেন তুমি আমায় খুঁজে বের করতে গিয়েছিলে?

কোনো এক নাসিরকে খুঁজতে।

কিন্তু তাকে কি পেয়েছ? সহসা শ টাকার কেরানি, যে দশটা–পাঁচটা সেক্রেটারিয়েট ছাড়া আর কিছু বোঝে না, সে কবি হয়ে ওঠে—সত্যি লায়লা তাকে কি পেয়েছে?

লায়লা কম্পিত কণ্ঠে জবাব দেয়, না, তবে তার খোলসকে পেয়েছি। কিন্তু সেদিনের কথা কি ভুলতে পারি!

হ্যাঁ, আমি তার খোলস বৈ আর কিছু নই। বাইরের দিক দিয়ে আমার এ অধঃপতন ঘটেছে, মনের দিক দিয়ে আরও! বিশেষ করে বাড়ি-বাগানগুলো বিক্রি করে দেবার পর থেকে...

লায়লা আর্তনাদ করে ওঠে, বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছ?

হ্যাঁ, উপায় ছিল না তখন। বাইশ গাঁয়ের জমিদারের ছেলে বলে নিজেকে আর পরিচিত করতে পারলাম না। লজ্জায় ভেতরে মরে গিয়েছি। সে লজ্জা এখনো ভাঙেনি। মুখ তুলে কারও সাথে কথা কইতে পারিনি। সে জন্যই পরিচিতদের বাঁধন থেকে সরে এসেছি। কেউ আমাকে খুঁজে পায়নি। অবশেষে তুমি, তুমি আমায় বার করলে। আমার ক্ষতকে দ্বিগুণ করে দিলে। কেন তুমি এলে?

লায়লা আশ্চর্য হয়। আপাত-প্রৌঢ় নাসির দুর্বল গলায় কেমন করে এতগুলো কথা বলে ফেলল। কোত্থেকে এত শক্তি পেল? না তার বহু বছরের জমানো বেদনা আজ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে?

ভুলে যাও লায়লা তেরো বছর আগের সেই নাসিরকে, সে নাসির মারা গেছে।

যাক সে মারা, তার স্মৃতি তো বেঁচে আছে।

ওসবও ভুলে যাও। সময়ে ছিল তোমার–আমার পূর্ণ যৌবনের বানডাকা হৃদয়। কত ঢেউ উঠেছে–মিশেছে, কিন্তু সে কথা মনে করে কী লাভ, বলো?

লাভ অনেক আছে। যেদিন চৌধুরী সাহেব সামান্য উকিলের মেয়ে বলে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে ফেললেন, জানি না, কেন যেন সেদিন থেকে তার স্মৃতি আরও উজ্জ্বল হতে লাগল।

নাসির ভ্রু কুঁচকে সমাহিত স্বরে বলে, লায়লা, তুমি বড্ড উচ্ছ্বাসপ্রিয়। সে নাসির নেই, যে বাপের সামান্য কথায় তোমায় ত্যাগ করেছিল। তখন ধনেজনে মান–সম্মান ছিল। আর না থাকলেও এসে যেত। লোকে ভয়ে সম্মান করত। প্রাসাদের সামনে দিয়ে কেউ জুতো পায়ে হাঁটতে পারত না, সহস্র কুর্নিশ দিয়ে দৌড়ে যেতে হতো। সে সমস্ত মিলিয়ে গ্যাছে। সে নাসিরের সাথে আমার তুলনা? তুমি কি তা নিজে বুঝতে পারছ না যে মরণ কবে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছে।

লায়লার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, চোখ সজল হয়ে ওঠে। নাসির টেবিলের ওপর মাথা নোয়ায়। লায়লার মনে হয়, এই কি সে–ই?

নাসির আবার বকে ওঠে, লায়লা, নিজের বাড়ি বিক্রি করে বেচে–বেটে খেয়েছি। এখন এখানে থেকে বাড়িওয়ালার বকুনি নিত্যি খেতে হয়। এ কি সহ্য হয়? ভেবেছিলাম এ স্মৃতিটুকুও মুছে ফেলব, কিন্তু পারলাম না ছাই। সস্তায় কি ঘর কোথাও পাওয়া যায় না?

লায়লা আগে জানলে আসত না ওর কাছে। পাগলের মতো বকে চলেছে। দমকা হাওয়ার মতো মাতামাতি করছে। আবার মাথাচাড়া দেয়, সেদিন রতনপুরের হাটে শুনলাম, সোয়া শ বছরের এ জমিদারির অবসান অদূরে। যখন বাপ-দাদারা সরকারের কাছে জমি নিয়েছিলেন, তখন ছিল রঙিন নেশা, বাদশাহি জায়গিরদারের স্বপ্ন। তা তারা ভোগ করেছে এত দিন হৃদয় পূর্ণ করে। প্রজাদের রক্ত শুষেছে, কেউ টুঁ শব্দটি করতে পারেনি। লায়লা, জমিদার বংশের রক্ত
তোমার মধ্যে নেই, তুমি তা বুঝবে না। তাদের শিরায় শিরায় মাতলামি। কিন্তু গণজাগরণের যুগে তা চলবে কেন? আমরা নিয়মিত আবর্তন করতে করতে একদিন কক্ষচ্যুত হলাম, যেদিন হাতে এসে বিজ্ঞাপন পড়ল। বাবা হার্টফেল করলেন, আর সাথে সাথে আমারও শেষ হয়ে গেল।

লায়লা অভিযোগ করে, অথচ এ আমি মোটেই জানিনি, অন্তত...

জানবে কী করে বলো, তুমি বাপের সাথে ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে ঘুরে ঘুরে বেড়ালে।

কিন্তু বিদেশে অন্তত খবরটা তো জানতে পেতাম।

না, জানবে না। ওদের যেখানে অকর্তৃত্ব তা ওরা কিছুতেই স্বীকার করবে না। কর্নওয়ালিশের পরাজয় অবশেষে সোয়া শ বছর পর।

কথার মোড় ঝট করে ফিরিয়ে নেয়, জীবনে তাই প্রথম সংগ্রাম করতে বাধ্য হই। অবশেষে সামান্য কেরানির চাকরিতে এসে সন্ধি হয়। ভাইয়ে–বোনে সব বেচে–বেটে নিয়েছি। তারপর রইল কী? কিছুই না। জানো লায়লা, কেরানির বিয়েও বাদ যায় না। অবশেষে এক রাতে যাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘরে আনলাম, সে আজ সহস্র রোগে কণ্টকিতা। মরে গেলে ভালোই, কিন্তু বেঁচে থাকবে ঠিক, অন্তত আরও পনেরো বছর আমার টাকা মাসে মাসে অর্ধেক করে কমাবার জন্য। এমনিই এ রকম, তার ওপর সমস্ত বাগানবাড়ি–জমির সামনে দিয়ে যখন যাই, তখন মনটা হু হু করে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ওঠে। পূর্বপুরুষের রক্ত শোষণের ওপর ধিক্কার আসে। শতবর্ষের কুড়ানো অভিশাপ কি তার বংশধর ভোগ করবে? সেখানে গেলে একে একে সব কথা মনে পড়ে, ওই কোণটা ছিল মিলনস্থল। ওখানে তুমি বসে থাকতে আর আমি...না, না, নাসির, সে তোমায় গান শোনাত, বাঁশের একতারা বাজিয়ে শোনাত। সে স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে। বুক ভরা কান্না রেখে গেছে। ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজেডি।

লায়লা এতক্ষণ পর মুখ খোলে, না, ট্র্যাজেডি নয় নাসির সাহেব, কমেডি। আপনার ছেলে হবে, তাদের হবে, তারা নতুন যুগের মানুষ হবে, আমাদের চেয়ে অনেক অনেক পৃথক তারা। মানুষের মতো সবাই বাঁচবে, মরবে। প্রকৃত সুখ তো তারাই ভোগ করবে। ট্র্যাজেডি দিয়ে যে সেতু বাঁধা হলো, তার ওপর দিয়ে কমেডি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে।

তুমি, তুমি বড্ড উচ্ছ্বাসপ্রবণ। আজ যদি তুমি চৌধুরীদের কেউ হতে, তবে তোমার রক্তও আজ এমনভাবে ফরিয়াদ জানাত।

লায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নাসির সাহেব, আজ আপনার পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে। ঠিক, সে নাসির মরেছে, কিন্তু তার অধঃপতন হয়নি, বরঞ্চ সে আরও ওপরে উঠেছে।

নাসির সহসা এমন অমানুষিক হাসি হাসে যে লায়লা চমকে ওঠে। বাইরে ঘড়ি ঢং ঢং করে বেজে ওঠে। নাসির উঠে পড়ে, ওহ, অনেকক্ষণ হয়েছে তো। ঝোঁকের মাথায় তোমায় কি বলতে কি বলে ফেললাম। লায়লা, বলো তুমি তাকে আর কোনো দিন খুঁজতে আসবে না...

লায়লার চোখের সামনে তখন দুটো ছবি পাশাপাশি ভাসছে—কোনটা উজ্জ্বল বেশি?

সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল