'পাইন্যার মা'র সুলুকসন্ধান

জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬)
জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬)

‘পাইন্যার মা’র কথা মনে এল ২৯ ডিসেম্বরের কথা ভেবে, ওই তারিখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৫তম জন্মবার্ষিকী। পাইন্যার মার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। হবে কেমন করে? জয়নুল আবেদিন এ নামের ছবিটি এঁকেছেন ১৯৫৩ সালে, জন্মালেও তখনো আমার শৈশব অতিক্রান্ত হয়নি। ছবির নাম ‘পাইন্যার মা’, এটি অনেককাল থেকে আমার কাছে খানিক বিস্ময় ও আগ্রহের বিষয় হয়ে রয়েছে। অবিভক্ত ভারতের ত্রিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত দুই বাংলার চিত্রসূচি যেটুকু পাওয়া গেল, তা ঘেঁটে এ রকম আটপৌরে নামের সন্ধান পেলাম না। সে কারণে ‘পাইন্যার মা’ শুধু তার নামকরণের কারণেই বিশিষ্টতা দাবি করতে পারে। স্বনামে না ডেকে পুত্রের (কখনো কখনো কন্যার) নামের সঙ্গে মা বা বাপ যুক্ত করে বিবাহিত নারী-পুরুষকে সম্বোধনের রেওয়াজ এ অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। শহরে এ দস্তুরটি কমে এলেও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি। আর নারী গৃহকর্মীদের এ নামে ডাকা শহরেও ভালোভাবেই চালু রয়েছে। ছবির গুরুগম্ভীর কাব্যিক নামকরণের যুগে এমন একটি আলগোছ নাম বেছে নেওয়ার নানামুখী তাৎপর্য থাকতে পারে। সে তাৎপর্যের হদিস করতে গেলে জয়নুল আবেদিন নামের শিল্পীটির সূচনা ও বিকাশের সময়টির দিকে একটু ফিরে তাকানো দরকার।

পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়তে যাওয়া প্রথম বাঙালি মুসলিম ছাত্র জয়নুল আবেদিনের লড়াই ছিল নানামুখী বিরূপতার বিরুদ্ধে। তাঁকে শুরুতেই লড়তে হয়েছে অনিচ্ছুক ও প্রতিকূল এক সমাজের বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম—যাঁরা প্রধানত কৃষিজীবী, শিক্ষার আলোক-বঞ্চিত, কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদ চিন্তাচেতনায় আচ্ছন্ন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডূকতার জোয়ালে বাঁধা তাঁদের মানসিকতায় পশ্চিমা শিক্ষা বা সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলাচর্চা ছিল ধর্মীয় অনুশাসনবিরোধী কাজ। অন্যদিকে দেশ বিভাগের আগেই পূর্ব বাংলার হিন্দু সমাজের অনেকেই ছিলেন কলকাতার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সুপ্রতিষ্ঠিত ও নেতৃস্থানীয়। ভারতীয় আধুনিক চিত্র-ভাস্কর্যেও পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া শিল্পী যে ছিলেন না তা নয়, তবে স্বভাবতই এঁরা সবাই ছিলেন হিন্দুসম্প্রদায়ভুক্ত এবং পরবর্তী সময়ে মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক। এঁদের মধ্যে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী (জন্ম: রংপুর), হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার (জন্ম: ময়মনসিংহ), মুকুল দে (জন্ম: ঢাকা), অতুল বসু (জন্ম: ঢাকা), মণিভূষণ গুপ্ত (জন্ম: ঢাকা), পরিতোষ সেন (জন্ম: ঢাকা), সোমনাথ হোর (জন্ম: চট্টগ্রাম) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা চলে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগে সর্বভারতীয় পরিচিতিসম্পন্ন বাঙালি মুসলিম শিল্পী বলতে সবেধন জয়নুল আবেদিন। জয়নুল আবেদিনের এই প্রান্তিক পটভূমি তাঁর শিল্পবৈশিষ্ট্য রূপায়ণে বিশেষ ছাপ রেখেছিল।

আর্ট স্কুল থেকে পাস করার পর তাঁর মূল সংকটটি ছিল চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের স্বতন্ত্র পথ রচনার। তাঁর সম্বল ছিল রেখাঙ্কনে অতুলনীয় পারদর্শিতা, সঙ্গে জলরঙে চিত্ররচনার ঈর্ষণীয় দক্ষতা। সামনে সমসাময়িক রীতি হিসেবে ছিল প্রধানত ‘বেঙ্গল স্কুল’ প্রভাবিত কাব্যিক ভাবালুতা অথবা রোমান্টিকতায় মোড়ানো বাস্তবানুগ চিত্রাঙ্কন অথবা স্বাদেশিক চেতনার পরিপূরক হিন্দুধর্মীয় বা পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা ইতিহাস বা সাহিত্যের কোনো মহীয়ান ও আবেগঘন বিষয়। কলকাতা আর্ট স্কুলের, যেখানে জয়নুলের শিল্পশিক্ষা, শিক্ষার্থীরা প্রধানত আসতেন শহুরে হিন্দু পরিবার থেকে, যাঁরা বিষয় হিসেবে মূলত চয়ন করতেন ধর্মীয় বা পৌরাণিক ঘটনা; অথবা ভূদৃশ্য হলে কলকাতার নগরচিত্র, নয়তো রোমান্টিক সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতি। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অতুল বসু, গোপাল ঘোষ, অবনী সেন, গোবর্ধন আশ, মুরলীধর টালি, হরেন দাস এবং আরও কারও কারও কাজে প্রত্যক্ষতার ছোঁয়া থাকলেও তাঁদের আঁকা ভূদৃশ্য পুরোপুরি নৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে উঠতে পেরেছে এমনটি হয়তো বলা যাবে না, কদাচিৎ তা প্রকৃতির রূপবিভঙ্গের আবেগাক্রান্ত অতিশায়নকে অতিক্রম করতে পেরেছে।

‘পাইন্যার মা’ ছবিটি জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন ১৯৫৩ সালে
‘পাইন্যার মা’ ছবিটি জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন ১৯৫৩ সালে

১৯৪৩ সালেই দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার মাধ্যমে সর্বভারতীয় শিল্পজগতে স্বকীয় বিশিষ্টতায় জয়নুল আবেদিনের আত্মপ্রকাশ। তাঁর রেখাঙ্কনের অসামান্য দক্ষতার যোগ্য বিষয় যেন খুঁজে পেলেন অনাহার-লাঞ্ছিত মানব অবয়বের কাঠামোয়। এখানে আমাদের নাগরিক খোলসের আড়াল ভেঙে দেন তিনি। সামনে দাঁড় করিয়ে দেন তাঁর গ্রামীণ কিষাণের মুখচ্ছবি আর ওই সব ক্লিষ্ট মানুষের ললাটে এঁকে দেন অপরাজেয় মানব-অস্তিত্বের জয়টিকা। চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন পাকিস্তান-পর্বে তাঁর নিজস্ব যে অভিব্যক্তিতে কেন্দ্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রান্তিক মানুষের লড়াইকে বিবৃত করেছেন, সেটি লক্ষ করার মতো বটে।

পঞ্চাশের দশকজুড়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির উন্মেষের কাল। দেখা যায়, ১৯৫১-৫২ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোপ ভ্রমণ ও লন্ডনের স্লেড স্কুল অব আর্টসে কাজ করার সুযোগ জয়নুলের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন সূচিত করেছিল, সেটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমের সমসাময়িক চিত্রধারার সঙ্গে এ-ই তাঁর প্রথম সরাসরি পরিচয়। সাদৃশ্যরূপ ছেড়ে ফর্মের জ্যামিতিক বিভঙ্গ তাঁকে আকৃষ্ট করল, শিল্পে রূপের অতিশায়ন বা অতিরঞ্জনের প্রয়োগ সম্পর্কে এল সচেতনতা। তবে তাঁর বয়োকনিষ্ঠদের মতো এই নবলব্ধ উপলব্ধি তাঁকে পাশ্চাত্যমুখী না করে বরং করে তুলল আরও অন্তর্মুখী। বিদেশের মাটিতে বসে যেন তিনি আবিষ্কার করলেন স্বদেশের মুখ। এ বিশিষ্টতা জয়নুলের মানসরূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতিভাত করে, যা আবারও তাঁর প্রান্তমুখী শৈল্পিক আকাঙ্ক্ষাকে অনুধাবন করায়।

তবে একই সঙ্গে এই সময়েই পরিণতি পেয়েছে—যাকে আমরা বলতে চাইছি জয়নুলের একান্ত চিহ্ন—মোটা তুলির দ্রুতচালের কালো পরিলেখয় অবয়বের ডৌলের ত্রিমাত্রিক আভাস, সঙ্গে জলরঙের যৎসামান্য প্রয়োগে বাস্তবানুগ বর্ণ ও আলোছায়ার ইঙ্গিত। একই সঙ্গে প্রচলিত আবেগাক্রান্ত অতিশায়ন বা কাব্যিক লালিত্যের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে দৃশ্যের নৈমিত্তিকতাকে প্রতিভাত করাতে চেয়েছেন তিনি, তাঁর রেখার শক্তিময়তাকে ব্যবহার করে চিত্রপটে এনেছেন অভূতপূর্ব গতিময়তা ও পরাক্রম। এই বৈশিষ্ট্যের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ দেখি তাঁর ‘বিদ্রোহী’, ‘মই দেওয়া’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘অপেক্ষা’ প্রভৃতি সুবিখ্যাত সব চিত্রমালায়।

তাঁর স্বদেশ-অনুসন্ধানের অভীপ্সা মূর্ত হয়েছে লোককলাকে আশ্রয় করে চিত্রনির্মাণ প্রয়াসের মধ্যে। ফিরে এসে পশ্চিমা সাদৃশ্যপন্থার ঘেরাটোপ থেকে একেবারেই মুক্ত হয়ে বাঙালির লোকশিল্পের দ্বারা প্রাণিত হয়ে কিছু চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি—১৯৫১-৫৩-তে একবার, ১৯৭২-৭৩-এ আরেকবার। ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালির আত্ম-আবিষ্কারের উদ্বোধন হয়তো এতে প্রণোদনা জুগিয়ে থাকবে। কিছু কিছু চিত্রে, যেমন ‘প্রসাধন’, ‘দুই বোন’ বা ‘গুণটানা’য়, উলম্ব ও আনুভূমিক রেখার জোরালো জ্যামিতিক বাঁধন ও সমতলীয় বর্ণবিস্তারে একধরনের মহিমাব্যঞ্জক পরাক্রম সঞ্চার করে। তবে এদের মধ্যে ‘পাইন্যার মা’ তার নামকরণের অভিনবত্বে আর চিত্রপটের সরল কিন্তু সমুন্নত বিশিষ্টতায় এক ভিন্নতর উপস্থাপনার উপলব্ধি সঞ্চার করে।

১৯৫১ সালের আগস্ট থেকে ’৫২ সালের আগস্ট পর্যন্ত জয়নুল ইউরোপে কাটিয়েছেন, তবে ফিরে আসার পর ’৫৩ সালে তাঁর আঁকা চিত্রমালায় লোককলার অভিঘাত সুস্পষ্ট শৈলীতে প্রতিভাত। ১৯৫১-এর ছবিতে স্বল্প পরিমাণে দেখা গেলেও ১৯৫৩ সালে আঁকা লোককলাশ্রিত চিত্রে ডুরে শাড়ি পরা গ্রামীণ নারী যেন হয়ে ওঠে তাঁর প্রতীকচিহ্ন—‘একাকী নারী’, ‘দুই বোন’, ‘তিন নারী’, ‘মা ও শিশু’ প্রভৃতি চিত্র—যার কোনো কোনোটি একাধিকবার রূপায়িত, এর উদাহরণ।

লোকশিল্পের শৈলীতে অনুপ্রাণিত ১৯৫১ সালে আঁকা ছবিগুলোতে সরলায়নের ধাপ হিসেবে জ্যামিতিক গড়নের প্রতি পক্ষপাত দেখা যায়। বিষয়ে মা ও শিশুর প্রাধান্য, একক অবয়ব কম। ’৫৩-তে এসে একক নারীমূর্তির দেখা যেমন পাই, তেমনি অঙ্কনে দেখি ক্রমশ স্বতঃস্ফূর্ততার দিকে ঝোঁক বাড়ছে। এর অন্যতম উদাহরণ ‘পাইন্যার মা’। কাছাকাছি সময়ের ‘দুই বোন’, ‘একাকী নারী’, ‘তিন নারী’–তেও এ প্রবণতা দেখা যাবে। তবে এসব ছবিকে ছাড়িয়ে ‘পাইন্যার মা’র উন্নত গ্রীবার সঙ্গে মিলিয়ে দুটি হাতের অবস্থান যে উল্লম্ব মনুমেন্টালিটির বোধ জাগ্রত করে তা আর কোনো ছবি করে না। এখানেও লোকশৈলীর সীমায়িত বন্ধনের মধ্যে জয়নুলের স্বতঃস্ফূর্ততার আকাঙ্ক্ষার একটি সম্মিলন ধরা পড়ে। কাগজের ওপর গোয়াশ (অনচ্ছ জলরং) মাধ্যমে আঁকা ৩২ গুণ ২৩ সেমি আকৃতির এ চিত্র সমসময়ের আর সব ছবির কাছাকাছি হয়েও অনন্য।

‘পাইন্যার মা’ কোথা থেকে এসে বসল চিত্রের পটে? এই নামে সত্যি কেউ কি ছিল কোনো দিন? ৬৫ বছর আগের পাইন্যার মাকে চিনতেন তেমন কারও খোঁজ পেলাম না। ’৫৩ সালে জয়নুল আবেদিন শহরবাসী, তাঁর শান্তিনগরের বাসায় থাকা শুরু করেছেন। পাইন্যার মা সম্ভবত তখন শহুরে গৃহকর্মী, আরও সম্ভব শিল্পীর বাসাতেই। শিল্পীর কনিষ্ঠ পুত্র ময়নুল আবেদিনের কাছে খোঁজ নিয়ে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেল, তা এ রকম: পাইন্যার মা বলে সত্যই কেউ ছিল কি না, তা ওর জানা নেই, তবে ছবিটি মার্কিনপ্রবাসী ওর এক খালার কাছে রয়েছে। ওই পরিবারের সঙ্গে বর্তমানে যোগাযোগ না থাকাতে ওটির সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে ও নিশ্চিত নয়। অশীতিপর মিসেস আবেদিন স্মৃতিচারণার ঊর্ধ্বে। ফলে পাইন্যার মা বিস্মৃতির কোনো রহস্যলোকে এখনো রয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন তাঁর উন্নত গ্রীবার ব্যক্তিত্বমণ্ডিত অবয়ব নিয়ে।

নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতি জয়নুলের অনুরাগ আগেও দেখেছি দুর্ভিক্ষের চিত্রমালায়। লোকশিল্পের অনুপ্রেরণায় আঁকা চিত্রে গ্রামীণ কিষাণ, বিশেষ করে নারী যে এসে জায়গা দখল করবে সে তো স্বাভাবিক। তবে একলা নারীরা একটু ভিন্নমাত্রিক, পরিপার্শ্বের মুখরতার মধ্যেও তাদের বিষাদময়তা পরিব্যাপ্ত হয়। ‘পাইন্যার মা’ তার সমুন্নত বিশালতা নিয়ে যেন আকাশস্পর্শী, তার একাকী অবয়ব সমস্ত জমিন ব্যাপ্ত করে যেন উপচে পড়েছে চিত্রের সীমা ছাড়িয়ে। এভাবে অকিঞ্চিৎকর ‘পাইন্যার মা’ আমাদের বোধের জগতে তোলে প্রবল অনুভূতির আলোড়ন।