রবীন্দ্রপ্রয়াণে গান্ধী ও জিন্নাহর শোকবার্তা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: বিনোদ কুঠারী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: বিনোদ কুঠারী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ছিল ভারতবর্ষের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন। তাঁর মৃত্যুতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ শোক প্রকাশ করে বার্তা দেন। উপমহাদেশের রাজনৈতিক জগতের দুই দিকপাল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও শোকবার্তা দেন। দুই রাজনীতিবিদ ছিলেন দুই ধরনের মানুষ—পরস্পর বিপরীত। গান্ধীর জীবনযাপন ও কর্মধারা ছিল এক রকম, জিন্নাহর একেবারেই অন্য রকম।

জিন্নাহর জীবনী ঘেঁটে দেখা যায়, যার-তার মৃত্যুতে তিনি শোক প্রকাশ করতেন না। রবীন্দ্রনাথের তিরোধানে তাঁর শোকবার্তাটিও প্রথাগত ছিল না। সেটি তাঁর সচিবের রচিত নয়, তাঁর নিজের লেখা। উপমহাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শোকবার্তাটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বিশেষ করে শোকবার্তায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি জিন্নাহর মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।

বাইশে শ্রাবণ মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ওয়ার্দায়, সেখান থেকে এক বার্তায় তিনি বলেন:

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে শুধু এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকেই নয়, একজন নিষ্ঠাবান জাতীয়তাবাদী ও মানবতাবাদীকেও হারালাম। জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই বললেই চলে, যেখানে তিনি তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে যাননি। শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে তিনি জাতির জন্য—এমনকি পৃথিবীর জন্যও—উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। তাঁর মহৎ আত্মা শান্তি পাক এবং শান্তিনিকেতনের দায়িত্বভার যাঁদের কাঁধে রেখে গেছেন, আশা করি, তাঁরা তাঁদের যোগ্যতার প্রমাণ দেবেন।’

গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের গঠনমূলক কাজের ওপরই জোর দিয়েছিলেন, যদিও শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠাই কবির প্রধান কীর্তি নয়, অন্যতম কীর্তি। তিনি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পৃথক তারবার্তায় লিখেছিলেন: ‘আপনার ক্ষতি আমারও ক্ষতি এবং জাতির ও জগতের ক্ষতি। গুরুদেব ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। আপনাদের সবার প্রতি আমার সমবেদনা।’

মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দেড় বছর আগেই মুসলিম লিগের ‘লাহোর প্রস্তাব’ গৃহীত হয়েছে। তখন উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি, সাম্প্রদায়িক দূষিত রাজনীতি তুঙ্গে। এমন সময়ে দাঁড়িয়ে মুসলিম লিগের শীর্ষ নেতা জিন্নাহ দিল্লি থেকে এক শোকবার্তায় বলেন:

‘ভারতবর্ষেরসর্বশ্রেষ্ঠ কবি, দার্শনিক ও সমাজসেবক ড. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের সংবাদে আমি গভীরভাবে শোকাভিভূত। আমার তরুণ বয়স থেকেই তাঁকে আমার জানার সৌভাগ্য হয়েছিল এবং শেষবার ১৯২৯ সালে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি সম্মানিত বোধ করি। তাঁর অত্যন্ত উদার ও মনখোলা এবং উদ্দীপিত (ফ্র্যাংক অ্যান্ড ইলুমিনেটিং) আলোচনা থেকে আমি অনুপ্রেরণা লাভ করি।

‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে ড. ঠাকুর ছিলেন একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক এবং তিনি সব সময় প্রতিপক্ষের বক্তব্য অনুধাবন করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর মতো একজন সত্যানুসন্ধানী মানুষের তিরোধানে ভারতবর্ষের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।’

জিন্নাহ ছিলেন নীরস ও উদ্ধত প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু এই শোকবার্তায় তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটেছে। তা ছাড়া এতে রয়েছে কিছু তথ্য ও বক্তব্য, যা উপমহাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

১৯২৯ ছিল জিন্নাহর জীবনের একটি কষ্টের বছর। উপমহাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হতাশাগ্রস্ত হয়ে রাজনীতি থেকে ‘বিশ্রাম’ নিতে ১৯২৮ সালের ৫ মে তিনি ‘রাজপুতনা’ নামক এক জাহাজে বোম্বে থেকে লন্ডন যাত্রা করেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন তাঁর দুই বন্ধু—দেওয়ান চমনলাল ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। জাহাজে তাঁরা দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন। চমনলাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, হিন্দু ও মুসলমান নেতাদের মতানৈক্যে জিন্নাহ ভীষণভাবে পীড়িত ছিলেন।

সেই দুঃখের সঙ্গে যোগ হয় আরেক ব্যক্তিগত দুঃখ। স্ত্রী রতন বাইয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছেদ না হলেও বিচ্ছেদ ঘটেছিল কয়েক বছর আগেই। ১৯২৯ সালে তিনি কম বয়সেই মারা যান। কঠিন হৃদয়ের জিন্নাহ দুঃখ-শোকে কাতর হওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না। কিন্তু ছাড়াছাড়ি হলেও স্ত্রীর প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। গান্ধী ও জিন্নাহ উভয়েরই বন্ধু কাঞ্চি দ্বারকদাস তাঁর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন একটি ঘটনা। রতন বাইয়ের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর দ্বারকদাস এক রাতে জিন্নাহর বাসভবনে যান। জিন্নাহ ছিলেন শোবার ঘরে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তিনিও তাঁর বেডরুমে যান। দেখেন, জিন্নাহ ওয়ার্ডরোব থেকে রতন বাইয়ের শাড়ি-সালোয়ার-কামিজ বের করে খাটে ও সোফায় সাজিয়ে রেখেছেন। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসে আছেন তিনি। তাঁর চোখের কোণে পানির ফোঁটা।

জিন্নাহর জীবনীকার হেক্টর বোলিথো লিখেছেন:

‘একই সঙ্গে তাঁকে দুটি আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। এই সময় তাঁর হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের বিশ্বাস ভেঙে চূর্ণ হয়ে যায় এবং তাঁর দাম্পত্য জীবনের বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে। অন্য সময়ে নিজস্ব মহত্ত্ব ও শক্তিতে তিনি সব সংকট কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু ১৯২৯ সালের এই সময়টিতে তাঁর সামনে আশা ও প্রেরণার কোনো আলো ছিল না। বাড়িতে তিনি নিঃসঙ্গভাবে থাকতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই একাকিত্বের মধ্যে এমনভাবে ডুবে গেলেন, যা আর কখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি।’ (জিন্নাহ,পৃ. ৯৫)

এ রকম আত্মিক সংকটের মধ্যে লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৈঠকে জিন্নাহ সন্তুষ্ট হন। তাঁর বিখ্যাত ১৪ দফা দাবিনামা—যার তীব্র বিরোধিতা আসে কংগ্রেস ও মহাসভার নেতাদের কাছ থেকে—রবীন্দ্রনাথ অযৌক্তিক মনে করেননি। ওই দাবিগুলোর মধ্যে ছিল ভারতে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার এবং প্রদেশগুলোর হাতে অবশিষ্ট (রেসিডুয়ারি) ক্ষমতা থাকবে, সব প্রদেশকে একই ধরনের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, সব সম্প্রদায়েরই পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে হবে, কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান মন্ত্রী না হলে কেন্দ্রে বা প্রদেশে কোনো মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারবে না ইত্যাদি। এসব দাবি রবীন্দ্রনাথ ন্যায়সংগত মনে করেন। জিন্নাহ ভারতবর্ষের সংবিধানে সংখ্যালঘু মুসলমান অধিকারের নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নয়।

উদার, অসাম্প্রদায়িক ও যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে জিন্নাহর শোকবাণীটি ছিল আন্তরিক—স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা নয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, যে রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা এতটা শ্রদ্ধা করতেন, পাকিস্তানের নেতাদের দ্বারা তিনি হন অবহেলিত।