তুমি হও গহিন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি

>

বছরের প্রথম সংখ্যায় থাকছে দেশের তিন প্রবীণ কবির একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা। এবারের বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হবে তাঁদের তিনটি কাব্যগ্রন্থ

মোহাম্মদ রফিক
মোহাম্মদ রফিক

মোহাম্মদ রফিক
নৃত্যপরা 

দেহ যদি সমুদ্র না হয়, 

আকাশ, দৃষ্টির লাভাস্রোত, 

হৃৎপিণ্ড, ভূ-গর্ভে উদ্​গিরণ; 

নাচো, নাচো, সমাধি ও চিতা 

অগ্নিশিখা, তোমাতে-আমাতে, 

সম্মিলন, সংগম, শীৎকার, 

নৃত্যযাত্রা, পাতাল অবধি; 

অবগাহনের লাস্য দেহে 

ওমধ্বনি শরীর উজিয়ে, 

ভেঙে পড়ি আকাশ, সমুদ্রে 

ঢেউ ঢেউ, তীরবালু ছুঁয়ে!

কে তুমি 

হতে পারে রাত প্রায় শেষ 

এখনো হয়নি ভোর 

একটি শালিক পড়ে আছে 

রক্তাক্ত নিঃসাড় নিস্তরঙ্গ 

অন্যটি ঘাসের শয্যা ছেড়ে 

উড়ে গেল দিগন্ত পেরিয়ে 

নড়ে ওঠে তৃণের জলধি 

আলোর ঝলক জলবিদ্যুতের 

রেখা—তুমি ঢুকে পড়ো ওই 

মাটির কুটিরে দ্রুত পায়ে

তোমার হাসিতে অনাবিল 

নীলবিষমুক্ত ঝরে বিশ্বময় 

বেহুলার বাসরে ছিলে না, 

তবে কেন হঠাৎ সহসা 

এই—একটি ধাঁধা অনুজ্জ্বল 

ছেয়ে নেয় জীবন যৌবন 

খুঁজে ফিরি শুরু থেকে শেষ 

অব্দি, শেষ থেকে ফের 

এখনো আলোর রেশ দেখি 

বঙ্কিম গ্রীবায় দৃশ্যমান

সে 

সে এসে দাঁড়াল বারান্দায়, 

শারদীয় পূর্ণিমার চাঁদ 

নেমে এল ভুঁয়ে, শেষ রাতে; 

দুই পাশে পিছনে গোলাপ 

রজনীগন্ধার ঝাড় যেন 

নক্ষত্রের বাসন্তী উৎসব, 

টোড়িভৈরবীতে বেজে ওঠে 

এসরাজ ও বীণা পাখওয়াজ, 

দোলনচাঁপার মৌ মৌ ঘ্রাণ 

কোন ফাঁকে ঢুকে যায় নাকে; 

বাতাসে বাতাসে মৃদুকেশ 

কখন যে উড়ে গেল পরনের 

বেশবাস, প্রফুল্ল আশ্লেষে, 

মধু জোছনায় উতরল 

নগ্নতাও এমন বৈদেহী 

মধুপের হূল প্রাকৃতিক; 

কোন যক্ষপুরী থেকে তবে 

মুক্তি পেল কালের যন্ত্রণা, 

স্বাধীন শরীরে আবিভূ​র্তা 

দমিত চেতনা কলাবতী; 

জানি, মুহূর্তের উদ্ভাসন 

কিংবা আবির্ভাব নয়, নয় 

অপ্সরা উর্বশী বা মেনকা 

নয় যে বিভ্রম, সর্পদেবী; 

সুন্দরের মানবী প্রতিমা 

যুগ থেকে যুগে যুগান্তরে; 

ছানিপড়া চোখে নামে জল, 

এ মুহূর্তে মৃত্যু তবে শুভ, 

এরপর অতঃপর পর 

বুঝিবা সৃষ্টিও অবান্তর!

মহাদেব সাহা
মহাদেব সাহা

মহাদেব সাহা
মনে পড়ল

হঠাৎ আমার মনে পড়ল সেদিন সন্ধ্যাবেলা

দাঁড়িয়ে দেখি বনের মধ্যে মেঘ-বৃষ্টির খেলা,

চোখের জল মুছব সেই রুমালখানি কই

জ্যোৎস্নারাতে বনজুড়ে আনন্দ-হইচই;

কী যে কোমল কী যে করুণ স্পর্শকাতর প্রাণ

গাছের গায়ে শীতের জামা, মিষ্টি চুলের ঘ্রাণ,

মনে পড়ল মনে পড়ল হঠাৎ সেই বাঁশি

ইচ্ছে করে বলি আবার, তোমায় ভালোবাসি।

এত যে সুখের নৃত্য
এত যে দুঃখের অশ্রু

এত যে সুখের নৃত্য, এত যে দুঃখের অশ্রু,

এত স্বপ্নবেদনার সিম্ফনি

এত যে দিনরাত্রির চিত্রনাট্য,

মিলন, বিচ্ছেদ, ভেসে যাওয়ার বিবরণ

শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার রোমাঞ্চ,

সেই প্রথম প্রণয়শিহরণ, বিরহের বাঁশি।

কত যে হারিয়ে যাওয়া মুখের রেখাচিত্র, 

কত যে ফেলে আসা বনের বৃত্তান্ত

মেঘ, বৃষ্টি, বিষাদের ছায়া,

নক্ষত্রের অস্থির চোখ

আলো-অন্ধকারের নৃত্যকলা, পাখির পদশব্দ

কত মুছে-যাওয়া আঙুলের ছাপ, কত বিবর্ণ হস্তলিপি।

কত পথ-হারানো পথিকের নোটবই,

কত ছেঁড়া তারের দীর্ঘশ্বাস

গোলাপের গোপন অশ্রুবিন্দু, মাঘনিশীথের বিষণ্ন শিশির,

কত সুখ-দুঃখ, বেদনার নিঃশব্দ মিউজিক।

কোথাও পাবে না সুখ
পাবে না শান্তি

ভালোবাসার মতো কেউ নেই, কাউকে পাবে না,

কোথাও পাবে না সুখ, গোলাপের গন্ধরাশি

সবখানে মরুভূমি, মরূদ্যান নেই;

এই একালের জীবনপ্রবাহ, এই তো নাচের মুদ্রা

পাখিরাও ভুলে গেছে গান, কোথাও পাবে না ভ্রমরগুঞ্জন,

ভালো লাগার মতো কাউকে কোথাও পাবে না

পাবে না একটি দয়ার্দ্র চোখ,

সেই শিশিরের নৃত্য আর কোথাও দেখবে না;

শিশুর হাসির মতো নিষ্পাপ বিশুদ্ধ ফুল কোথাও ফুটবে না,

ফুটবে না পবিত্র ভোরের আলো,

কোথাও দরদি কণ্ঠ কখনো শুনবে না;

ভালো লাগার মতো কিছু কোথাও পাবে না

একটু সামান্য সুখ, একটু সামান্য শান্তি 

কোথাও পাবে না।

নির্মলেন্দু গুণ
নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ
পদবিদ্যুৎবহ্নি

নগ্ন পা দুখানি যেনবা জেলেদের

সদ্য জালে ধরা পদ্মার প্রিয় মাছ, 

স্ফীতবক্ষা পোঁয়াতি ইলিশজোড়। 

তার কোমল মাংসল জঙ্ঘার কাছে 

কাঞ্চনজঙ্ঘাও মানে হার। 

আমি হিমালয় দর্শনে কেন যাব? 

যখন সুন্দরই অন্বিষ্ট আমার। 

কবির চোখের অপার মুগ্ধতা দেখে

খুশি হয়ে পরিহাসছলে ব্রহ্মা বলেন: 

তরুণী ভার্যার পদমুগ্ধ হে কবি, 

নিজেকে শান্ত রেখে তাকে দেখো। 

তারপর রাত জেগে তুমি লেখো

বর্ষার প্রথম জলের মতন

হাঁটু থেকে গোড়ালিতে নেমে আসা

তার দুই অনাবৃত পায়ের বন্দনা। 

আমি এই বর দিচ্ছি তোমাকে, 

যেন তোমার না কাটে নেশার ঘোর, 

অমৃতজ্ঞানে তুমি পান করো

তার পদাম্বু, পদমদ যথা নেশাখোর। 

জানি, তুমি বহনে অক্ষম তার

পদযুগলের সৌন্দযের্র ভার। 

তাই আমি চাই তার বিদ্যুৎবহ্নিতে

তুমি নিজেকে পোড়াও, 

পোড়াও তোমার তুচ্ছ পুরুষকার। 

আমার মাথা সমুদ্রের দিকে
উত্তপ্ত আগুনের দিকে পা

আগুন খুবই বড় জিনিস, 

আমি তার তুলনায় তুচ্ছ। 

তা সে যতই তুচ্ছ হোক, 

আমি দেখেছি তার রক্তবরণ, 

বুকের গোপন রক্তক্ষরণ, 

দেখেছি ঘুঘুর লাল চোখ। 

আমি বলেছি তো বলেছিই, 

উচ্চারিত উক্তি ঘোরাব না। 

আমার মাথা সমুদ্রের দিকে

উত্তপ্ত আগুনের দিকে পা; 

তোমরা চাইলে হাসতে পারো, 

আমি কিচ্ছুটি বলব না। 

আমি মানুষ, তুচ্ছ তৃণলতা

কবি হলেও অগ্নিদাহ্য। 

পায়ে আগুন জ্বলছে জ্বলুক; 

ওটাই জানি ছিল ন্যায্য। 

যদিও আমার মাথা সমুদ্রের দিকে, 

এবং উত্তপ্ত আগুনের দিকে পা। 

অসভ্যতার আনন্দ

অসভ্যতার অপার আনন্দ বুকে নিয়ে

আমি আকাশ থেকে আকাশান্তরে

উড়ে বেড়াচ্ছি পুঞ্জীভূত হেমন্তের মেঘ। 

বর্ষা বা শরতের মতো মেঘ আমি নই। 

আমি এত সহজে বৃষ্টি ঝরাব না। 

আরও অনেকটা সময় ধরে

আমি তোমাকে শাসন করব, নারী। 

এখনো আমার অনেক তৃষ্ণা বাকি। 

না চাইতেই নারীকে যে শুভরাত্রি বলে

নারী তাকে মন থেকে পুরুষ বলে না।