নানান সুরের রেখাচিত্র

লিখিত বক্তব্য আর উপস্থিত বক্তব্যের পার্থক্যের মতো শিল্পীর নির্মিত চিত্রকর্ম, অটোগ্রাফের সঙ্গে কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে এঁকে দেওয়া উপহার চিত্রকর্মের মধ্যে একধরনের পার্থক্য আছে। এসব চিত্রকর্ম সাধারণত ড্রয়িংপ্রধান হয়, যাকে মিতব্যয়ী রেখার চিত্র হিসেবে অভিহিত করা যায়। সম্পর্কসূত্রে ভালোবাসা বিনিময়ের এসব চিত্রে থাকে স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তির প্রতিফলন। দেশে–বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি তুলে যিনি আলোকচিত্রী হিসেবে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন, তিনি নাসির আলী মামুন। নেশা, পেশা, ভালোবাসা আর সম্পর্কের টানে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি ছুটে চলছেন শিল্পী–সাহিত্যিকদের কাছে। সেই সূত্রে কবি–লেখক–শিল্পীদের অটোগ্রাফের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি সংগ্রহ করে চলেছেন শিল্পীদের চিত্রকর্ম। তাঁর সংগ্রহের ভারত–বাংলাদেশের ৫০ জন শিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে চলছে একটি প্রদর্শনী। ‘স্বপ্নের চারণভূমি’ শিরোনামে এ প্রদর্শনীতে আছে বরেণ্য চিত্রকরদের রেখাচিত্র, নানা সুরের রেখাচিত্র।

শিল্পীর দেওয়া অটোগ্রাফ সাধারণত একটু ভিন্ন হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ আঁকেন আত্মপ্রতিকৃতি। সমরজিৎ রায় চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, হামিদুজ্জামান খান, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, রবীন মণ্ডল, চন্দ্রশেখর দে, রফিকুন নবীর আত্মপ্রতিকৃতিতে যেনবা ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তির শিল্পশৈলীর রস একই সঙ্গে আস্বাদন করা যায়। নাসির আলী মামুনের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন অনেক শিল্পী। যেমন গণেশ পাইনের কলমে সীমিত লাইনে নাসির আলী মামুনের প্রতিকৃতি একটি অনন্য মাত্রা পেয়েছে।

ধীরাজ চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ও রণজিৎ দাস অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি কতটা নিরীক্ষামূলক, স্বাতন্ত্র্য, অভ্যন্তরীণ বোধ এবং রসময় অভিব্যক্তি ও নান্দনিকতায় ভরপুর, তা শেখ আফজালের রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতির সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়।

প্রতিকৃতি, আত্মপ্রতিকৃতি ছাড়াও পশুপাখি, গাছপালা, ফুল, লতাপাতা যেসব চিত্রে এসেছে, সেগুলোও বিশিষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। প্রত্যেক শিল্পীর বৈশিষ্ট্যই তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে অক্ষুণ্ন; এবং যা বাস্তবানুগ না হলেও বাস্তবতাকেই যেন আরও শক্তিশালী করে প্রকাশ করেছে। প্রকাশ কর্মকারের ‘বার্ড উইথ কাউ’, কাইয়ুম চৌধুরীর ‘টু ওম্যান’, এস এম সুলতানের ‘ভিলেজ ওম্যান’—কথার স্বপক্ষে এই ছবিগুলোকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া মোটা ব্রাশে আঁকা কে জি সুব্রমণ্যনের ছাগল, মোটা লাইনে যোগেন চৌধুরীর ফুল–লতাপাতা এবং বিশেষ ভঙ্গিমায় বসে থাকা ফিগারে ব্রাশের গতি, রেখার ছন্দ ও সাবলীলতা—সবকিছুই নান্দনিকতায় ঋদ্ধ।

পূর্ণেন্দু পত্রীর জাদুকরী তুলিতে ফোক মোটিফে আঁকা বিভিন্ন রকম ঘোড়া এই প্রদর্শনীকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। সেই যুগের পরিতোষ সেন থেকে এই আমলের শাহাবুদ্দিন—সবার রেখাচিত্রের মধ্যেই একটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। এটি হলো এগুলো স্নিগ্ধতার ছোঁয়ায় অনুপম। নাসির আলী মামুনকে ধন্যবাদ, এমন একটি প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য।

গেল বছরের ২৭ ডিসেম্বর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হবে ১০ জানুয়ারি।