বুলবুলি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ধানখালি থেকে মাইল দুয়েক দক্ষিণে বুড়া গৌরাঙ্গের গা ঘেঁষে পিন্নাই নামে যে গ্রামটিতে হাফসা বানু থাকেন, একরাতের ফারাকেই তা যে একটা রাগী বিলের রূপ নিয়ে নিল, যার পানির ওপর গাছপালা, ঘরবাড়ির চাল অথবা দুয়েকটা ছাদ জেগে থাকায় যদিও এই জলসাম্রাজ্যকে বিল বলে বর্ণনা করায় সমস্যা হচ্ছিল...যাহোক, তা কে ভাবতে পেরেছিল? আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যদি পারত, তাহলে কি মধ্য-পিন্নাইতে চৌদ্দ শতকের চন্দ্রদ্বীপ সাম্রাজ্যের কোনো এক ক্ষমতাবানের তৈরি অট্টালিকা—যা ১৮০২ সালের এক ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে মাটি চাপা পড়ে যায়—উদ্ধার করতে খনন কাজ চালায়, নাকি পিন্নাইকে ‘হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করার তোড়জোর শুরু করে, যেহেতু অট্টালিকার সঙ্গে নাটমণ্ডল—এবং অবাক কাণ্ড—এক গ্রন্থাগারেরও সন্ধান খননকারীরা পান? এক রাতের ফারাকটা তৈরি করেছিল বুলবুল, ২০১৯ সালের নভেম্বরের ৯ ও ১০ তারিখের মধ্যিখানের আঁধার লেপা কয়েকটি ঘণ্টায়। বুলবুলের জন্মের নাম ছিল মাতমো, যদি জানতে চান, নামটি সে পাল্টে ফেলে ইন্দোচিন পার হয়ে আন্দামানে এসে। এরপর বড়সড় একটা লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে বুলবুল বেগে ধায় বাংলার সাগর দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে সে হানা দেয় কাজী নজরুলের সন্ধানে, তার গন্তব্য ছিল চুরুলিয়া। সেখানে তিনি নেই জেনে তার রাগ হয়। ঢাকায় তিনি শুয়ে আছেন, এ তথ্য পেয়ে সে ঢাকার দিকে রওনা হয়। তার উদ্দেশ্য ছিল নজরুলকে একটা সালাম জানানো, তাঁর সন্তানের নাম সে যে ধারণ করেছে, তা–ও জানানো। কিন্তু লাটিমের মেজাজি ঘূর্ণি মেপে পথ চলতে দেয় না। ফলে তার লেজটা হঠাৎ পিন্নাইয়ের ওপর আছড়ে পড়ল।

বুলবুলের এই গল্পটা প্রত্নতত্ত্বের কনিষ্ঠ খননবিদ অচিন্ত্য শুনিয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফ হাকিমকে। বুলবুল চলে গেলে পরে তাকে সে আরও বলেছে, মাতমো নামটা ধরে রাখলেই যথার্থ হত। পিন্নাই আর তার আশেপাশের কত শত বাড়িতে যে সে মাতম রেখে গেছে! হাকিমকে একটা করুণ হাসি উপহার দিয়ে সে বলেছে, ‘তুফানের নাম বুলবুল শুনে অনেকে গা করেনি। স্টর্ম শেল্টারে যায়নি। একটা পাখি তো, নরম পালকের, কী আর এমন করবে, এমনই ভাব ছিল তাদের। আমার বউয়ের নামও স্যার নরম, মমতা’, অচিন্ত্য বলল, ‘অথচ...’

হাকিম বুঝলেন। বললেন, ‘এমনই হয় অচিন্ত্য। এ নিয়ে দুঃখ কোরো না।’

দয়ালু মানুষ হাকিম। পিন্নাই এসেছেন আদিষ্ট হয়ে। পিন্নাইয়ের ব্যাপারে সরকারের ওপরমহলে আগ্রহ উৎপন্ন হয়েছে, জাতিসংঘের তথা ইউনেসকোর একটা বড় অনুদান পাওয়া গেছে। কিন্তু পিন্নাইতে এসে হাফসা বানুর সঙ্গে কথা বলে হাকিমের চোখ সিক্ত হয়েছে। প্রত্নতত্ত্বের খননকাজ হাফসা বানুর দশ ডেসিমেল জমি হাওয়া করে দেবে, যদিও তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তবে কতটা তিনি সত্যি সত্যি পাবেন, তা নিয়ে হাকিমের সন্দেহ আছে। হাফসা বানু সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হলে ভাবনার কিছু ছিল না, কিন্তু তিনি তো বয়স্কা, শক্তি-সামর্থ্যহীন ঊনজন, চোখে কম দেখেন, কোনোরকমে টিকে আছেন, গ্রামের এক জমিবিধবা দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সঙ্গে আছে বলে তিনি যাহোক দুবেলা খেতে পারেন। কিন্তু হাকিমের চোখ ভিজেছে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে নয়, ওই সজলতা তৈরি হয়েছে হাসনা বানু যখন হাকিমকে দেখে, তার কথা শুনে, আঁচলে চোখমুখ ঢেকে শুধু কাঁপা কাঁপা হাতে দশ শতাংশ জায়গার দিকে দেখিয়ে অস্ফূট গলায় বলেছেন, ‘ওই দেখেন দুই কবর। ওদের আমি নিজের হাতে শুইয়েছি, তখন।’ হাকিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়তেন। তার ইচ্ছা ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিক হবেন। কবরের কথায় তিনি অনুসন্ধানী হলেন। তিনি জানলেন, হাফসা বানুর স্বামী মারা গেছেন সেই জমিযুদ্ধে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে—যে যুদ্ধে তাকে দেখাশোনা করে যে বিধবা, তার স্বামীও গেছে। স্বামীকে কবরে শোয়ানোর এক বছরও শেষ হয়নি, হাফসা বানুর মেয়েটি মারা গেল। এখন তিনি বসে আছেন তৃতীয় একটি কবরে আশ্রয় নিয়ে অসমাপ্ত সংসারটি আবার শুরু করতে। তার একমাত্র জীবিত সন্তান হিরণ আছে লালুয়ায়, শ্বশুরবাড়িতে থানা গেড়ে বসে। হাফসা বানুর আশা, একদিন ছেলে এসে তাকে তৃতীয় কবরে শোয়াবে। 

অচিন্ত্য বলেছে হাকিমকে, ‘স্যার, খননকাজ ফলপ্রসূ হবে না, যদি এই জমিতে কোদাল না পড়ে। অচিন্ত্যর ধারণা, নাটমণ্ডলটা এই জমির নিচে। কিছু প্রমাণও সে পেয়েছে। হাফসা বানুর স্বামীর জন্য কবর খুঁড়তে গিয়ে কিছু ইট বেরিয়েছিল, সেগুলি দিয়ে কবরের শিখানটা বেশ পাকাও করা গেছে। অচিন্ত্য নিশ্চিন্ত, নাটমণ্ডলটা শুয়ে আছে হাফসা বানুর জমির নিচে।

অনুসন্ধানী হাকিমকে হাফসা জানালেন, এত দিন এ বাড়িটা নিয়ে তার যা হয়নি, এখন তা–ই হবে। এখন তিনি হয় কড়াইতে ফুটবেন, নাহয় গনগনে চুলায় পুড়বেন। হাকিম বুঝলেন। কড়াইটা যদি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ হয়, চুলাটা মনু মিয়া, যে কিনা টাউট শ্রেণির স্থানীয় এক উটকো লোক। সে কিছু পয়সা দিয়ে হাফসা বানু থেকে জমিটা লিখিয়ে নিয়ে প্রত্নতত্ত্বের কাছে গছিয়ে দেওয়ার তালে আছে, তাতে ক্ষতিপূরণটা সে–ই পাবে। মনু মিয়া হাফসা বানুর ছেলেকে বাগে এনেছে, কীভাবে, তিনি জানেন না। তবে পিন্নাইয়ের এক লোক বলল, মানুষকে সাইজ করার ক্ষমতা মনু মিয়ার অসাধারণ।

হাকিম ওপরতলায় কথা বললেন। ওপরতলা বলল, কোদাল চালাও। সময় বেশি নেই। মার্চে অড্রে আজুলা আসবেন, যিনি এই কিছুদিনের মধ্যে ইউনেসকো–প্রধান হচ্ছেন। তাকে পিন্নাইতে নিয়ে আসার কথা হচ্ছে। আজুলা ম্যাডাম সংস্কৃতিপ্রেমী...ইত্যাদি। 

হাকিম বললেন অচিন্ত্যকে, ‘খননকাজ বন্ধ করতে হবে। হাফসা বানু আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন।’

‘স্যার! ওপরতলা যে...’ 

‘রাখো তোমার ওপরতলা, এটা আমি দেখব। তুমি বরং চেষ্টা করো। এই জমিটা বাঁচিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করতে। যাও।’ 

হাকিমের গলা শুনে অচিন্ত্য অবাক হয়ে গেল। সে বলল, ‘জি স্যার, এবং তার ল্যাপটপ কোলে নিয়ে হাফসা বানুর প্রিয় আমড়াগাছের নিচে বসে পড়ল। হাকিম তার সঙ্গে আসা একটা পুলিশকে বললেন মনু মিয়া যেখানেই থাকুক, ধরে আনতে। 

হাকিমের কেন হঠাৎ রাগ হলো, কেনই–বা তিনি অচিন্ত্যকে অবাক করে ওপরতলা সম্পর্কে অবজ্ঞার সুরে কথা বললেন, তা অনুসন্ধান করে গুছিয়ে লিখতে গেলে আরেকটা গল্পের সমান জায়গার দরকার হবে। 

সে সুযোগ আমাদের নেই। তারপরও চার-পাঁচ কথায় একটা ইশারা হয়তো দেওয়া যায়—ওপরতলার অবজ্ঞা আর রূঢ়তা, ঢাকার এক স্কুলে পড়া মেয়েটার জ্বর, এবং ফোনে কয়েকবার ‘বাবা, তুমি না এলে জ্বর সারবে না’ বলা, হাফসা বানুর মুখে তার নানির অসহায় মুখটি ভেসে ওঠা, যে নানি অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে ঝাঁসির রানির মতো যুদ্ধ করে তার মা আর মামাকে মানুষ করেছেন, এবং ওই মামাই বাড়িতে মামি এলে একদিন তাঁকে এককাপড়ে বিদায় করে দিয়েছেন, এবং ইউনেসকোর অনুদান কীভাবে কোথায় খরচ হবে, কারা এরপর নাটমণ্ডলের ইটের কার্বন ডেটিং করতে প্যারিস-জুরিখ যাবেন, উন্নত খননযন্ত্র-কাণ্ডে আখের গোছাবেন—এসব নিয়ে তার সাতপাঁচ ভাবা। হাকিম থার্মোফ্লাস্কে করে কফি এনেছেন। তিনি অচিন্ত্যর পাশে বসে কাপে কফি ঢেলে খেতে খেতে তার কাছে সিগারেট চাইলেন। অচিন্ত্য বলল, ‘স্যার, ঠিকমতো খাবারই জোটে না, তার ওপর সিগারেট!’

হাকিম বললেন, ‘ম্যাডাম আজুলা এলে তাকে বোলো তোমাকে প্যারিস নিয়ে যেতে।’

অচিন্ত্য বলল, ‘একটা তুফান তৈরি হয়েছে বে অব বেঙ্গলে। নামটা শুনবেন স্যার? বুলবুল।’ 

ঘরের দারয়া থেকে বসে বসে হাফসা বানু দেখলেন, সরকারের লোক আমড়াগাছটা দখল করে ফেলেছে। এখন তারা তার জমিতে থানা গেড়ে বসবে, যেমন হিরণটা বসেছে শ্বশুরের জমিতে, দুই সম্বন্ধিকে রাস্তা দেখিয়ে। শ্বশুরের জমি অনেক, তার ওপর সোনাফলা। সে কি এই অল্পখানি জমি বাঁচাতে পিন্নাই আসবে, মনু মিয়ার টাকা না পেলেও?

তিনি আরও দেখলেন, একটা পুলিশ হঠাৎ জোরেশোরে উত্তরের দিকে হাঁটা দিল। আরও দুটো বসে আছে রমিজউদ্দিনের টুঙ্গিঘরে, তিনি শুনেছেন। জমিবিধবা রানু তাঁকে বলেছে, ‘আম্মা, ভেসে বেড়ানোর সময় শুরু হলো।’

ভেসে বেড়াতে তিনি চান না। এই বাড়ি, স্বামী আর মেয়েকে ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চান না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘বুঝলে রানু, দেখার মালিক
যিনি, তিনি দেখবেন। তাঁর চোখটা তো আর আমার মতো না। তাঁর দিলটাও দয়ার। ধৈর্য ধরো।’

দুই.

ওপরতলা জানাল সাত দিন আরও থাকতে হবে। ম্যাডাম আজুলা কনফার্ম করেছেন। হাকিম মেয়েকে ফোন করে বললেন, ‘মা, তুমি ভালো হয়ে যাও। বাপি তোমাকে আর তোমার মাকে কক্সবাজার নিয়ে যাব। তিন কিরা।’

অচিন্ত্যকে বললেন হাকিম, ‘অবাক কাণ্ড অচিন্ত্য, জীবনের একটা গল্পে আরেকটা গল্প এত অবলীলায় যে ঢুকে যায়! গল্প যে কীভাবে ডালপালা গজায়! এখন দেখো, আমার মেয়েটা খুশি হয়ে কক্সবাজার নিয়ে আরেকটা গল্প লিখতে বসেছে।’

কথাটা আমাদেরও। অচিন্ত্যরও। সে বলল, ‘স্যার, চন্দ্রদ্বীপেরও অনেক গল্প। অট্টালিকার আছে এক শ গল্প। নাটমণ্ডলেরও।’ 

হাকিম বললেন, ‘কোনো গল্প যেহেতু একা থাকে না, তাদের বিশ্বাস করে কী লাভ?’ 

‘ঠিক স্যার।’ 

‘তাহলে খননযন্ত্র বাক্সে তুলে বসে বসে তুফান দেখো। আর নাও, এই প্যাকেটটা রাখো।’

সিগারেটের প্যাকেটটা অচিন্ত্যের জন্য আবুল পুলিশকে দিয়ে কিনিয়ে এনেছেন হাকিম।

তিন.

আবহাওয়া একেবারে পাল্টে গেল। সাত দিনের তিন দিনও যায়নি, খননকাজের এক আঙুল কাজ হয়েছে কি হয়নি, অথচ আরও তিন খননবিদ এসে পড়েছেন, দশজন খননশ্রমিকও। হাফসা বানুর দশ শতাংশে অবশ্য কোদাল পড়েনি। কিন্তু হাফসা জানেন, এই সম্ভাবনা পরদিন সকালেই সত্য হতে পারে। তিনি চোখ বুজে দীনদয়ালের কাছে আরজি পেশ করলেন। হাকিম মাঝখানে দুদিন আসেননি। আজ এসেছেন। এসে বললেন, ‘প্যাক আপ। আবহাওয়ার লোকজন কড়া সিগন্যাল দেখাচ্ছে।’ 

ঢাকা থেকে আসা জ্যেষ্ঠ খননবিদ বললেন, ‘আরেকটা দিন দেখি।’ 

‘দেখেন’, হাকিম বললেন, ‘তুফান দেখেন। কিন্তু খননকাজ হবে না। অচিন্ত্যও আমার সঙ্গে যাবে।’ অচিন্ত্য বুঝল, এবার তার চাকরি নিয়ে টান দিচ্ছেন হাকিম। বলল, ‘স্যার, আমি এইখানে থাকি। স্যাররাও তো থাকবেন।’ 

‘কোথায় থাকবে?’ 

‘হাফসা মাসির বাসায়।’ 

হাকিম হাসলেন। বললেন, ‘থাকো। আমি গেলাম।’

চার.

অচিন্ত্যর গলায় পরিষ্কার শুনলেন হাফসা বানু, বুলবুলি এসে যাচ্ছে, আজ বিকেল থেকে তাণ্ডব শুরু হবে।

একটা চিৎকার দিয়ে উঠলেন হাফসা বানু, ‘ও রানু হুনছ’, তিনি জমিবিধবাকে ডাকলেন, ‘আমার বুলবুলি আইতেছে। আর ডরাইও না।’

অচিন্ত্য জানল, দশ শতাংশে শুয়ে থাকা মেয়েটার নাম বুলবুলি। সে হাফসা বানুর ভুল ঠিক করে দিল, ‘মাসি, তুফানের নাম বুলবুলি না, বুলবুল।’

হাফসা বানুর কানের পাশ দিয়ে এই ভ্রম সংশোধন উড়ে গেল। তিনি কোথা থেকে হঠাৎ এত জোর পেলেন, অচিন্ত্য ভেবে পেল না। কিন্তু সে দেখল, তিনি একবার ঘরের ভেতর, একবার বারান্দায় ঢুকছেন, বেরোচ্ছেন। একটা চটের ব্যাগে তিনি কিছু জিনিসপত্র ভরে জমিবিধবাকে দিয়ে বললেন, ‘এইগুলা নিয়া সোজা স্কুলটাতে চইলা যাও। পাকা দালানে। ’ অচিন্ত্যকেও তিনি বললেন, ‘বাবা, যাও। আমার বুলবুলি আইতেছে। আমি টের পাই।’

‘আপনি যাবেন না, মাসি? চলেন না?’ অচিন্ত্য বলল। 

হাফসা বানু মুখে হাসি ধরে দুই কবরের একটার দিকে মেলে বসে থাকলেন। তার চোখ দেখে মনে হলো, যাবার সময় ঠিকই তিনি যাবেন। 

অচিন্ত্য ভাবল, মাসির পাশে বসে থাকবে। সন্ধ্যা হতে বাকি নেই। তাঁকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে নিয়ে শেল্টারে যাবে। কিন্তু তার তিন বস—বড়-মেজ-সেজ খননবিদ বললেন, ‘চলো অচিন্ত্য, শেল্টারে চল। অবস্থা ভয়াবহ।’ 

শেল্টারে মানে পাশের ছইলা গ্রামের তিনতলা পাকা স্কুলে। অচিন্ত্যর পাশে পাশে জমিবিধবা রানুও হাঁটছিলেন। তিনি এক আজব কথা বললেন অচিন্ত্যকে। হাফসা বানু তাঁকে বলেছেন, আজ রাতে বুলবুলি কবর থেকে বেরিয়ে আসবে। সে রেগে থাকবে। মেয়েটার খুব রাগ ছিল। এ জন্য শ্বশুরবাড়িতে মার খেত। অবশ্য সে–ও মার দিত। তবে সব মার সবাইকে সে দিতে পারেনি—ওর বাবাকে যারা মেরেছে, তাদেরকেও। আজ রাতে তার সামনে যে-ই পড়ুক, প্রত্নতত্ত্বের খননবিদ, অথবা মনু মিয়া, অথবা ছদ্মবেশী বদমাশ ইসমাইল কাকা, কারও রক্ষা নেই। 

হাফসা বানু রানুকে বলেছেন, স্বপ্নটা তিনি প্রতিরাতে দেখেন। দুদিন ধরে দিনেও দেখেন। আজ আকাশটার মুখ ভার, কিন্তু বাতাসের রাগটা প্রবল। ঠিক বুলবুলির মতো। বুলবুলি এসে গেছে। তার কোনো ভয় নেই।

‘মেয়েটার নাম কি সত্যিই বুলবুলি ছিল?’ অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল।

‘নাম কি মানুষের মিথ্যা হয়, ভাইজান?’ রানুর অবাক উত্তর।

পাঁচ.

বুলবুলি ঠিকই এল। হাফসা বানু বিছানার ওপর আধশোয়া হয়ে ছিলেন। দুদিন থেকে তার হালকা জ্বর। ছেলেটার কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন, যেন একবার আসে। না, ডাক্তার নিয়ে নয়, একাই যেন আসে। তার নাড়িছেঁড়া ধন, একবার দেখতে বুকটা হা–হুতাশ করে। ছেলেটা অবশ্য আসেনি। কেন, কে জানে। 

হাফসা বানু জানেন, এখন যেতে হবে। টাকাপয়সা যা ছিল রানুকে দিয়েছেন। সে এখন ভেসে বেড়াবে, তবে তিনি উড়বেন। বুলবুলির সঙ্গে, তার হাত ধরে। 

চোখ বুজে তিনি তিন রাত ধরে দেখা স্বপ্নটা আবার পরিষ্কার দেখলেন। বুলবুলি আসবে, তার রাগের বাতাস ঘরের চাল ওড়াবে। আকাশ উপুড় হয়ে পানি ঝরাবে। খাটটা একসময় জমা পানিতে ভাসবে, তারপর ভাসতে ভাসতে বুড়া গৌরাঙ্গ পর্যন্ত চলে যাবে। 

তারপর দেখা যাবে।

তিনি অচিন্ত্যকে ধন্যবাদ দিলেন। ছেলেটা কী করে বুঝল, আজ বুলবুলি আসবে? ছেলেটা বলেছে সে মাটি খুঁড়ে পুরোনো দিনের কেচ্ছা বের করে আনে। খোঁড়াখুঁড়িতে ছেলেটার হাত ভালো। বুলবুলির কবরে সে হাত দেয়নি, তাহলে ওকে আস্ত কী করে সে বের করে আনল, এনে তাকে বলল, বুলবুলি আসছে? 

আকাশের চাপা ক্রোধ আর বাতাসের গর্জনে পৃথিবীটা কাঁপছে, ঘরটা যেন উড়ে যাবে। হাফসা বানু আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার বুলবুলিটার রাগটা দেখলে? তাকে কি সামাল দিতে পারবে?’