সৃজনশীলতা ও বিশেষজ্ঞতার যুগলবন্দী

মোহিত কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
মোহিত কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কোনো জাতির মধ্যে যদি বিচিত্রমাত্রিক বিশেষজ্ঞ থাকেন আর তাঁরা যদি হন একই সঙ্গে সৃজনশীল, তাহলে সেই জাতির প্রাপ্তি হয় অনেক বেশি। সৃজনশীলতা নিজেই এক বড় শক্তি, তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আর যদি উভয়ের মধ্যে ঘটে সুসমন্বয়, তাহলে সাহিত্যে যে কী বিস্ময়কর ঘটনা ঘটতে পারে তার উদাহরণ দুই চিকিৎসক-লেখক: একজন রুশ আন্তন চেখভ, আরেকজন বাঙালি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, যিনি বনফুল নামেই বরেণ্য। এভাবে লেখক কাম চিকিৎসক, লেখক কাম বিজ্ঞানী, লেখক কাম স্থপতি-প্রকৌশলী, লেখক কাম শিক্ষক-অধ্যাপক, লেখক কাম সৈনিক-পুলিশ-আমলা—স্বদেশে ও বিদেশে এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। তবে এই বাংলাদেশেই অন্তত জনা বিশেক জীবিত কবি-লেখক পাওয়া যাবে যাঁরা চিকিৎসাপেশায় নিয়োজিত। আবার তাঁদের মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র্য।

প্রসঙ্গটা এল একজন চিকিৎসক কাম লেখককে মনে করেই, তিনি মোহিত কামাল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। তিনি ফিকশন ও নন–ফিকশন দুই ক্ষেত্রেই তাঁর চূড়ান্ত সাফল্য দেখিয়েছেন। যদিও বলা হয় এ দেশে নন–ফিকশন তেমন বিকোয় না, কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না।

লেখক হিসেবে তিনি বিচিত্রগামী, অন্তর্গত, পরিশ্রমী ও সক্রিয়, পরন্তু তাঁর একটি গবেষক ও অনুসন্ধানী সত্তা রয়েছে, যা তাঁকে সমাজ-ভূগোল-রাষ্ট্রনির্বিশেষে মানুষের চরিত্র-বিশ্লেষণের সবিশেষ দক্ষতা দিয়েছে। এর সফল ও শিল্পিত প্রয়োগ রয়েছে তাঁর কথাসাহিত্যে। এর মানে এই নয়, পেশাগত কারণে তিনি লেখক, বরং তিনি লেখক বলেই এই বিশেষজ্ঞতা তাঁর সৃজনশীলতায় বিশেষ সহায়ক হয়েছে। 

দুই. 

বিস্মিত হয়ে দেখছি, মোহিত কামালের লেখালেখি সুপ্রচুর। তাঁর মতো একজন ব্যস্ত বিশেষজ্ঞ-অধ্যাপক-গবেষক-সম্পাদকের এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫৩টি। এর মধ্যে গল্প-উপন্যাস-শিশুসাহিত্য মিলিয়ে বেরিয়েছে খান চল্লিশেক বই। অনেক বই আকারেও বেশ স্বাস্থ্যবান। এর মধ্যে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সে আলোকেই কিছু কথা ন্যায়সংগতভাবেই বলা দরকার বলে বোধ করছি। আর সে জন্যই এই হ্রস্বকায় রচনার প্রয়াস। 

ধরা যাক চন্দন রোশনি উপন্যাসটির কথাই। কক্সবাজারে নবদম্পতির বেড়াতে যাওয়া এবং নায়কের সমুদ্রে ভেসে যাওয়া থেকে এ আখ্যানের যাত্রা। এরপরই দেখা যায় সমুদ্রতলে এক বিপুল পরাজগতে নায়ক অন্য এক জীবনে প্রবেশ করে। তার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির এক বিস্ময়জগৎ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়। লেখক এখানে সমুদ্রবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, সাম্প্রতিক বিজ্ঞান, কল্পনা, চিত্রকল্প ও জীবনদর্শনের যে সম্মিলন ঘটিয়েছেন, তা এক কথায় বিস্ময়কর। বইটি একই সঙ্গে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও দর্শনের যুগলবন্দী, যা তাঁর পরিশ্রম-প্রতিভা-সৃষ্টিশীলতার শক্তিরই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। 

আরবে বাঙালি শ্রমিকের জীবন নিয়ে লেখা মরুঝড় উপন্যাসে দেখা মেলে অন্য এক জগতের। নববিবাহিত বাঙালি এক শ্রমিকের প্রবাসজীবন, বিরূপ আরবীয় বাস্তবতা ও নায়কের ইলিউশন, দাম্পত্য ও অসম প্রেম, আইনি জটিলতায় সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে ফিরে আসা, দেশে-প্রবাসে আইনি জটিলতা ইত্যাদি রূঢ়তা ও মনোবাস্তবতা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। 

মোহিত কামালের সুস্মিতার বাড়ি ফেরা ও মরুঝড় উপন্যাসের প্রচ্ছদ
মোহিত কামালের সুস্মিতার বাড়ি ফেরা ও মরুঝড় উপন্যাসের প্রচ্ছদ

আবার সুস্মিতার বাড়ি ফেরা উপন্যাসে দেখি ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে নায়িকা সুস্মিতার ছবির সঙ্গে পর্নোগ্রাফিক চিত্র জুড়ে তার জীবনকে অসহনীয় করে তোলার পাশাপাশি তার ধ্বংসপ্রায় জীবন থেকে উত্তরণের গল্প। 

তবু বাঁধন উপন্যাসে দেখা মেলে পিতা ও কন্যার অসম সম্পর্কের জটিলতা এবং উভয়ের মানবিক বোধে ফিরে আসার কাহিনি। 

এভাবে মোহিত কামাল তাঁর নানা ধরনের সাহিত্যে বর্তমান জটিল ও বিকারগ্রস্ত বাস্তবতার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বয়ান রচনা করেন, যা একই সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার যৌথ প্রকাশ, আবার আমাদের জন্য যুগপৎ বিনোদন, শিক্ষা ও বর্তমান বাস্তবতার পাঠ। 

শুরু করেছিলাম বিশেষজ্ঞ-সৃজনশীলদের কথা দিয়ে। শেষ করা যাক এ দিয়েই। মোহিত কামালের সৃষ্টিশীলতায় আমাদের সাহিত্য উপকৃত, কেননা তাঁর রচনা একাধারে বিশেষজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার ফসল। তাঁর রচনায় এমন অনেক বিষয় আছে, যা তাঁর ডিসিপ্লিনের কারণেই আমরা সহজে জানতে পারছি, একই সঙ্গে বর্তমান জটিল জীবনের অনেক অপ্রকাশ্য বাস্তবতা তাঁর কুশলী লেখনীর কারণেই সাহিত্যরসে জারিত হয়ে খুব সহজেই আমাদের অভিজ্ঞতার অংশে পরিণত হচ্ছে। 

তাঁর ৬১তম জন্মদিনে প্রার্থনা করি, তাঁর কলম যেন কখনো ক্লান্ত না হয়, তাহলে আমাদের সমূহ ক্ষতি।