বিশ-বিশের সংকল্প

>

নতুন বছরে নতুনের আবাহনে নিজের মুখোমুখি হন সবাই, করেন নতুন পরিকল্পনা। এখানে থাকল লেখালেখি নিয়ে কয়েকজন লেখকের ২০২০ সালের পরিকল্পনা 

গোলাম মুরশিদ
গোলাম মুরশিদ

বাংলা গানের খোঁজে
গোলাম মুরশিদ

অবসর নিয়েছিলাম সময় হওয়ার আগেই, দুই হাজার তিন সালে। ভেবেছিলাম, অতঃপর সত্যি সত্যি রিল্যাক্স করব আর স্ত্রীকে সাহায্য করব ঘরের কাজে—বেচারিকে সারা দিন চাকরি করতে হয় (সবেতনে), তারপর বাড়িতে ফিরেও চাকরি করতে হয় (বিনা বেতনে)।
এই মহৎ সংকল্পটা যখন নিয়েছিলাম, তখন বুঝতে পারিনি ‘অবসর’ কথাটা আমার বেলায় একটা পরিহাস মাত্র। আগেও কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়েছিল, আগেও গবেষণা করেছি। কিন্তু অবসর পেয়ে সেটা যে নেশা হয়ে দাঁড়াবে, তা বুঝতে পারিনি। তারপর থেকে প্রতিবছরই বইমেলায় নতুন বই নিয়ে হাজির হয়েছি, কোনো কোনো বছর একটা নয়, দুটো বই নিয়ে। আর, আমার সেই অ-পাঠ্য বই ছাপাতে গিয়ে কত গাছকে খুন করতে হয়েছে, তার হদিস নেই। বুঝতেই পারছেন, পরিবেশদূষণের জন্য আমিও দোষী। 

ভেবেছিলাম, চরিত্র সংশোধন করে সামনের বছর এ দোষটা আর করব না। কিন্তু কথায় বলে, স্বভাব যায় না ম’লে। সামনের বছর আসার আগেই তাই সংকল্প করে ফেলেছি—অন্তত আরেকটা বই লিখতেই হবে। আগের বছরগুলোতে লিখেছি বিচিত্র বিষয় নিয়ে—কখনো জীবনী, কখনো ভাষার ইতিহাস, কখনো রেনেসন্সের ইতিহাস, কখনো বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস, কখনো বা নিজের অ-শিক্ষার ইতিহাস নিয়ে। 

এবার লিখব, বাংলা গানের ইতিহাস। ইতিপূর্বে বাংলা গানের ইতিহাস লিখেছেন অনেকেই। সেগুলোর বেশির ভাগই মনগড়া ইতিহাস। এসব ইতিহাসকার বিসমিল্লাহতেই গলদ করেছেন। তাঁদের ধারণা, বাংলা গানের যাত্রা শুরু উচ্চাঙ্গসংগীত দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে সে গান পাহাড় বেয়ে সমতলে নেমে এসেছে। এমনকি, নদীতে নেমে ভাটিয়ালিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটা হলো, সাগরের পানি ধীরে ধীরে পর্বতের গা বেয়ে তার মাথায় চড়ে বরফ হওয়ার মতো। আমি লিখতে চাই বাংলা গানের বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস। কাজটা অবশ্য সহজ হবে না। কারণ, প্রাচীনকালের অথবা মধ্যযুগের গানের রেকর্ড পাব কোথায়? কোথাও পাব না। স্বরলিপিও না। তাহলে? 

লেখালেখি ছাড়া আরেকটা সংকল্প আছে এ বছর। সেটা কেবল আপনাকে বলছি একেবারে গোপনে (কারণ, স্ত্রী শুনে ফেলতে পারে এবং আপনাকে বলবে, আমাকে বিশ্বাস না-করতে)। ৩৬ বছর লন্ডনে বাস করছি। তবু আজও দেখা হয় নাই শুধু চক্ষু মেলিয়া একটি পার্কের একটি শোভন দৃশ্য। নাহ্, এবারে সপ্তাহান্তের অন্তত একটা দিন বের হতে হবে লন্ডন দেখতে কোনো মিউজিয়াম, কোনো লাইব্রেরি, কোনো অতি বিখ্যাত ব্যক্তির বহু কালের পুরোনো বাসগৃহ, কোনো সমাধি, কোনো পার্ক (বিশেষ করে কিয়ু গার্ডেন। ৩৬ বছরে বউকে কিয়ু গার্ডেন দেখাইনি, এ লজ্জা ঢাকব কী করে? )

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান

যা লিখতে চাই
আকবর আলি খান

২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে লেখালেখি নিয়ে আমি কী ভাবছি? উত্তরে বলেছিলাম, আমি আটটি বই লেখার পরিকল্পনা করছি। এ আটটি বইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বই গত বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। ইতিহাস সম্পর্কে আরও একটি বই প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের বইমেলায়।
বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে একটি বই লেখার পরিকল্পনা আমার ছিল। কিন্তু শুধু ইসলাম প্রচার সম্পর্কে বই লেখার পরিকল্পনা ছিল না। এই বইটিকে তাই আমার মূল পরিকল্পনা থেকে একটি বিচ্যুতি গণ্য করা যেতে পারে। ২০১৮ সালে জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে বাংলায় ইসলাম প্রচার সম্পর্কে একটি বক্তব্য দিয়েছিলাম আমি। বক্তব্যটিতে বিপুল জনসমাগম হয় এবং আমার প্রকাশক এ বিষয়ে একটি বই প্রকাশ করার জন্য আবদার করেন। প্রধানত প্রকাশকের তাগিদেই বইটি লেখা হয়। আরেকটি কারণ হলো, ভারতবর্ষ ও বাংলা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইটন বাংলায় ইসলাম প্রচার সম্পর্কে একটি নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং তা বাংলাদেশের বাইরে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দুর্ভাগ্যবশত ইটনের সঙ্গে আমি একমত নই। তাই বইটি লেখার তাগিদ অনুভব করেছি। 

তবে এই বই প্রকাশিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা এখনো আমার রয়েছে। তা ছাড়া আমি আশা করছি, ২০২০ সালের বইমেলায় দারিদ্র্যের অর্থনীতি শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হবে আমার। 

কাজ করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, লেখালেখির জন্য অতি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি আমি। এসব কাজ শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারব কি না, এ সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। 

বই লেখার মানসিক প্রস্তুতি আমার ঠিকই আছে, কিন্তু শারীরিকভাবে অসামর্থ্য ক্রমেই বাড়ছে। তাই আপাতত স্বল্প মেয়াদে দুটি বই লেখার চিন্তা করছি। একটি বই বাজেট সম্পর্কে; আর একটি বই হলো আমার আত্মজীবনী। আত্মজীবনী নিয়ে আমার মনে দ্বন্দ্ব রয়েছে। জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় সরকারি দায়িত্ব পালন করেছি আমি। তাই সরকারের এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেতাদের অনেক গোপন তথ্য আমার জানা। সেগুলো নিয়ে লেখা কতটুকু নৈতিক, তা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে। যদি গোপনীয় তথ্য নিয়ে না লিখি, তাহলে পাঠকেরা বঞ্চিত হবেন। আর যদি লিখি তাহলে শুধু যে নৈতিক দিক দিয়েই প্রশ্নবিদ্ধ হবে তা নয়, অনেকে অসন্তুষ্টও হবেন। তাই ভাবছি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডটি লিখে ফেলব। কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডটি নিয়ে কী করব সে সম্বন্ধে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন

যে স্মৃতির আগুন জ্বলে
সেলিনা হোসেন

শিরোনামে যে স্মৃতির কথা লিখেছি তা আমার দীর্ঘজীবনের স্মৃতি সঞ্চয়ের একটি দিক। নানাভাবে এই স্মৃতি আমার লেখায় প্রেরণা সঞ্চার করে। এই স্মৃতি কখনো আগুনে পোড়ে না। দাউ দাউ করে জ্বলে অনবরত। প্রথম আলোর সাহিত্যের পৃষ্ঠা ‘অন্য আলো’ যিনি তত্ত্বাবধান করেন, সেই আলতাফ শাহনেওয়াজ ফোনে আমাকে জানিয়েছেন, এই ২০২০ সালে যে বই লিখবেন তার পটভূমি লিখে জানান।

আমি কী লিখব? যে স্মৃতিকথা, যে লেখার কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি, সে লেখা ২০২০ সালে শেষ হবে? শুরু করেছিলাম ২০১৬ সালে। কারণ, ভেবেছিলাম, অনেক বই পড়ে, পড়ার স্মৃতির সঞ্চয় থেকে বইটি লিখব। তাই আমার স্মৃতি সঞ্চয়ের ধারাবাহিকতা দিয়ে বইটি লেখা শুরু হয়েছে।

প্রায় একই সময়ে শুরু করেছিলাম আরেকটি বইয়ের কাজ। সে কথা বলার আগে এর প্রেক্ষাপটটি একটু বলে নেওয়া ভালো। 

২০১৬ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ আমাকে একটি ফেলোশিপ দেয়, যার নাম ‘টেগোর ফেলোশিপ’। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক চেতন সিং ই–মেইলে আমার কাছে জানতে চান, কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই আমি? ভাবলাম, যেহেতু এটি টেগোর ফেলোশিপ, তাই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কিছু থাকতে হবে। কিন্তু এর সঙ্গে বাংলাদেশ কি থাকবে না? 

ভাবতে ভাবতে আমার চিন্তায় ধরা দিল বিষয়টি। আমি বিষয়ের শিরোনাম লিখলাম: ‘পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ মুজিবুর রহমান’। বিষয়টি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ কর্তৃপক্ষকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও সম্মতি দিলেন। একই সঙ্গে বললেন, সিমলায় আমাদের হেড অফিস, এখানে এসে থাকতে হবে। তাদের ই–মেইলটি পড়ে ঘাবড়ে গেলাম। মনে হলো, ওখানে গিয়ে থাকলে আমার গবেষণার উপাদান সংগ্রহ হবে কী করে? 

এসব জানিয়ে আবার ই–মেইল দিলাম ওদের। বললাম, আমি যখন সিমলায় গিয়ে থাকব না, তখন আমাকে মাসিক অর্থ দিতে হবে না। তাঁরা রাজি হলেন না। জানালেন, এটা অনুমোদন করা সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত ওদের আর কিছু না জানিয়েই ঢাকায় থেকে কাজ শুরু করলাম আমি। একপর্যায়ে চেতন সিং জানালেন, আমার ফেলোশিপ বাতিল করা হয়েছে। আমি মেনে নিলাম। কিন্তু একরকম জিদ থেকে ওই কাজটিও শেষ করলাম—পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ মুজিবুর রহমান নামে সেই বইটি এ বছর প্রকাশিত হবে। 

তা ছাড়া যে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা এ বছর আমার রয়েছে, তার নাম বধ্যভূমিতে বসন্ত বাতাস। বাংলাদেশের ভিত্তিমূলে রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের শেষনিশ্বাস। তাঁদের আত্মদান ও বধ্যভূমিকে অবলম্বন করেই লেখা হবে আমার নতুন উপন্যাসটি। চমকপ্রদ একটা ব্যাপার হলো, আমাদের দেশের বধ্যভূমিগুলোতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-মুসলমান সব ধর্মের মানুষের মরদেহ আছে। এটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দিক। এসব বিষয়ই বিশদভাবে আসবে আমার উপন্যাসে। 

 আদতে স্মৃতিকথার বই আর উপন্যাস—এ দুই পুস্তকের ভেতরেই বুঁদ হয়ে থাকতে চাই ২০২০ সালে।

শাহীন আখতার
শাহীন আখতার

বছর শুরুর ভাবনা
শাহীন আখতার

মনে হয় হালখাতা নিয়ে বসা মুশকিল তার পক্ষে, যার গত বছরের লেখালেখির ঘরে লালবাতি জ্বলছে। আমি লিখি ধীরে। ভাষা বা ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। আর এমন সব অগম্য বিষয়ের দিকে ধাবিত হই, যা পর্বত ডিঙানোর শামিল। বা নিজেকে গর্তে ফেলে পরীক্ষা নেওয়া যে এখন নিজেই নিজের ত্রাণ করো, তা তিন-চার বছর সময় লাগলেও। তবে এবারেরটা অগ্নিপরীক্ষা, যা ২০১৯ সালের শুরুতে লিখতে শুরু করেছি, আগামী বছর লিখব বলে আশা করি। শেষ হবে কি না জানি না। এখন লেখার চেয়ে সংযোজন-বিয়োজনের হচ্ছে বেশি।

যেকোনো লেখাই আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং। তা ছোটগল্প কি নন-ফিকশন বা উপন্যাস, যাই হোক। লিখতে পারব কি না বা লেখাটা শেষ হবে কি না, সেই অনিশ্চয়তায় ভুগি সব সময়। তারপরও আমার নাজুক লেখকসত্তাটিকে পছন্দই করি। ভালোবাসি দীর্ঘ সময় ধরে একটা উপন্যাস লেখার সঙ্গে জড়িয়ে থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে। লেখার ছুতায় ভ্রমণ, বই পড়া, একটা আধাআধি ঘোরের মধ্যে থাকা—এ সবকিছু নিয়ে একটা আধা সাহিত্যকেন্দ্রিক জগৎ। সবচেয়ে ভালো হতো একটা লেখার মধ্যে শামুকের মতো পুরোপুরি গুটিয়ে থাকতে পারলে। এমন ধ্যানমগ্ন থাকা বা একটা বিন্দুতে মনোযোগ ধরে রাখার স্তরে উতরানো কোনো দিন সম্ভব হবে কি না জানি না। 

এ মুহূর্তে ১০টি গল্প নিয়ে বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করছি, যে কাজটা নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে গড়াবে। প্রকাশ করবে প্রথমা প্রকাশন। গত পাঁচ বছরে লেখা এ গল্পগুলোর বেশির ভাগই অনাহূত, লেখার টেবিলে জোর করে ঢুকে পড়েছে। তখনো অসুখী দিন উপন্যাস লিখছি, ভরবর্ষায় নাফ নদী পেরিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে। তাদের আগমনের দৃশ্যটা বাস্তব দুনিয়ার মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল এরা যেন বাইবেলের সেই এক্সোডাস। ‘অলৌকিক ছড়ি’ গল্পের মুসার মতোই অনেকটা বিহারি রহমতুল্লাহ, পাহাড়ি দিবাকর। তাদের আগে-পিছে আছে শরণার্থী-কাহিনি। আজকের দুনিয়ায় যে কেউ যেকোনো সময় এ কাফেলার অংশ হয়ে যেতে পারে। 

হোস্টেল সুপারের মার্ডারের ঘটনা মর্মান্তিকই শুধু নয়। বয়ঃসন্ধিকালের অনুকরণীয় একজনের করুণ পরিণতি যেন নিজের সেই বয়সটারই খুন হওয়ার বার্তা বয়ে আনে। 

আবরার ফাহাদের নির্মম মৃত্যুতে কলমের কালি ফুরিয়ে যায়। বোবা অসহায় অনুভূতি—কাছের মানুষের মৃত্যু নিয়ে আমি যেমন লিখতে পারি না। 

বর্তমান সময়ের স্পন্দন মনে হয় উপন্যাসের চেয়ে আমার গল্পেই পাওয়া যাবে বেশি। 

একটা বিষয় এখন গল্পের কেন্দ্রে উঠে আসতে চায়—মৃত্যু। হঠাৎ করে কাছের মানুষেরা চলে যাচ্ছে বলেই হয়তো। মৃত্যুটা শুধু দেহ ছেড়ে আত্মার চলে যাওয়া বা দেহের বিনাশ বা পুনরুত্থান নয়, আমার ভাবনায় আসে কতগুলো পেছনে ফেলে যাওয়া মন, যা স্বজন হারানোর প্রাণান্তকর কষ্ট ভোগ করে, শোকার্ত হয়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী
বিশ্বজিৎ চৌধুরী

নজরুল ও ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে ভ্রমণের পর
বিশ্বজিৎ চৌধুরী

গত বছরটা আমার প্রায় কেটে গেল কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর বিদূষী ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে। ঢাকা, কলকাতা, কৃষ্ণনগর, এমনকি সুদূর লন্ডন শহর পর্যন্ত ভ্রমণের মানসসঙ্গী হয়েছি তাঁদের। সশরীরে টাঙ্গাইলের করটিয়া গ্রামে খুঁজে দেখতে গিয়েছিলাম একটি বালিকার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি আর তাঁর পারিবারিক জীবনের শাখা-প্রশাখা।

নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী তো বটেই, গণিত বিভাগেও তখনকার একমাত্র ছাত্রীটি মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে চোখ খুলে কপালে তুলে দিয়েছিল সকলের। করটিয়া গ্রামের মেয়েটির ঢাকা ইডেন স্কুল, কলকাতা বেথুন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অবশেষে সামাজিক ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সুদূর লন্ডনে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে যাওয়া তখনকার সময়ের বিবেচনায় সত্যিকার অর্থেই ছিল বিস্ময়ের পথে যাত্রা। সেই যাত্রাই হয়তো সুগম করে দিয়েছিল বাঙালি মুসলমান পরিবারের মেয়েদের শিক্ষার পথ।

এই শ্যামাঙ্গী তরুণীর সঙ্গে ঢাকায় এক সাহিত্য সম্মেলনে পরিচয় হয়েছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের। ফজিলতুন্নেসার ব্যক্তিত্ব, মেধার দীপ্তি ও মোহন লাবণ্য মুগ্ধ করেছিল কবিকে। কবি প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সেই প্রেম। নজরুলের বহু গান-কবিতা ও চিঠিপত্রে সেই বেদনা উৎকীর্ণ হয়ে আছে।

কিন্তু শুধুই প্রত্যাখ্যান? আর কিছুই কি ছিল না এই সম্পর্কের মধ্যে? নজরুলের জীবনের এই সৃজন ও বেদনামুখর সময়টি আমাকে একটি উপন্যাস লিখতে প্ররোচিত করেছিল। অতঃপর যথাসাধ্য তথ্যের সমর্থন ও অবশ্যই লেখকের কল্পনার অধিকার নিয়ে কবি ও রহস্যময়ী নামের উপন্যাসটি লিখে শেষ করতে পেরেছি ২০১৯ সালে। এই জানুয়ারি মাসে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে প্রথমা প্রকাশনী থেকে। এর আগে ২০১৩ সালে নজরুলের জীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নারী নার্গিসকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। পাঠক ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে নার্গিস। সামনের বইমেলায় আমার একটি নতুন গ্রল্পগ্রন্থও প্রকাশিত হচ্ছে।

তবে নতুন বছরে এবার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে চাই। নতুন উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি নিয়েছি। মনোচিকিৎসা–সংক্রান্ত কিছু বিষয় এই উপন্যাসের উপজীব্য বলে ইতিমধ্যে এ বিষয়ে কিছুটা পড়ালেখা করেছি।

গত বছর এলোমেলো নানা বিষয়ে পড়াশোনা করলেও একটি ক্ষীণকায় গ্রন্থ আবেগ-ভালোবাসা-বেদনায় এবং সর্বোপরি একটি জিজ্ঞাসায় প্রায় অস্থির করে রেখেছে আমার অস্তিত্বকে। বিপ্লবী সূর্য সেনের জীবনসঙ্গিনী পুষ্পকুন্তলাকে নিয়ে লেখক ও গবেষক মালেকা বেগমের জীবনীগ্রন্থটি পুষ্পকুন্তলার বিষয়ে আমাকে নতুনভাবে আকুল করে তুলেছে। আমি চট্টগ্রামের মানুষ। সূর্যসেন ও তাঁর জীবন এবং সূর্যসেনের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলার বিষয়ে আমার কৌতুহল আছে। পুষ্পকুন্তলাকে নিয় উপন্যাস লিখতে চাই আগামীতে। জানি না এ বছরে সেই পরিকল্পনা আদৌ বাস্তবে রূপ পাবে কি না, কিন্তু ভাবনার শুরুটা তো হলো।

আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল

একটা অতৃপ্তি ছিল, দূর করার চেষ্টা করব
আসিফ নজরুল 

গত বছর আমি কিছু অকল্পনীয় কাজ করে ফেলি। জীবনে প্রথম একটা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখি। এডিস মশার প্রকোপে জীবন অতিষ্ঠ অবস্থায় লিখি ব্যঙ্গাত্মক গল্প। মানবাধিকার নিয়ে একটা বইও রচনা করি। এ ছাড়া রুটিন কাজ হিসেবে দাঁতভাঙা রিসার্চের কাজ করি কিছু।

লেখালেখির হিসেবে বছরটা ছিল তৃপ্তিময়। প্রথমা থেকে বের হওয়া উপন্যাস উধাও-এর তিনটে সংস্করণ হয়েছে এক বছরে। ঈদসংখ্যায় এখনকার সময়ের সাংবাদিকতা নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলাম—এর প্রশংসা করেছেন এ সময়ের নামী কয়েকজন সাংবাদিক।

এত কিছুর পরও গত বছরে একটা অতৃপ্তি ছিল। আমার বিজ্ঞান কল্পকাহিনিটা ছিল ছোটগল্প আকারে। সেখানে জিন এডিটেড মানুষের ভালোবাসা আর সংঘাতের কথা ছিল। গল্প আসলে না, সেখানে ছিল গল্পের বীজ। আমি চাচ্ছিলাম এটা পরে বিশাল ক্যানভাসে বড় করে লিখতে। কত দিন স্বপ্নও দেখেছি গল্পটার বিস্তার কীভাবে হবে তা নিয়ে। কিন্তু তবু লেখার সাহস পাইনি। নতুন বছরে সাহসটা বাড়ানোর চেষ্টা করব। 

আমি মানবিক বিভাগের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি আইন। কিন্তু আমার চিরন্তন কৌতূহল এই মহাবিশ্ব আর এর রহস্য নিয়ে। যখন আমি পড়ি ডার্ক এনার্জি, সুপার গ্যালাক্সি কিংবা সূর্যের স্ফীতি বা মহাজাগতিক গ্রাভিটির তারতম্যের পরিণতি নিয়ে—ভাবি আহা, এসব নিয়ে যদি লিখতে পারতাম গল্প-উপন্যাস! 

জানি না কোনো দিন এ সামর্থ্য হবে কি না। তবে পরিবেশ বিপর্যয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর আধা কৃত্রিম মানবভুবনের মতো কিছুটা সহজবোধ্য বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা অবশ্যই করব আমি। কোনো দিন সুযোগ হলে ছোটদের জন্য লিখব পিট কেয়ার্নস, বোরা বোরা, গ্যালাপেগাস—এসব অদ্ভুত দ্বীপের গল্প। 

আগামী বছরেই ঠিক কী লিখব নিশ্চিত না। দুটো ছোটগল্প নিয়ে ভাবছি কিছুদিন ধরে। একটা একজন মুক্তিযোদ্ধার ঢাকা আগমন নিয়ে, আরেকটা বিয়ের রিং নিয়ে। এগুলো লিখব আশা করি। সদ্য প্রকাশিত মানবাধিকার বইটির পাঠকপ্রিয়তা আমাকে সহজ করে আরও কিছু বিষয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করছে। চেষ্টা করব সংবিধান আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এ রকম বই লিখতে। আর উপন্যাস তো লিখবই। 

আরেকটা কথা ভাবি অনেক বছর ধরে। সেটা হলো, আমার পিএইচডিটা গবেষণাটা হালনাগাদ করার কথা। ইউপিএল-এর মহিউদ্দিন ভাই আমাকে অনেকবার বলেছেন কাজটা শেষ করতে। কিছু কাজ করেছি মাত্র এ বছর। খুব খুশি হব এটা এ বছর শেষ করতে পারলে।

মাসরুর আরেফিন
মাসরুর আরেফিন

জীবনের মানে খোঁজার অভিমুখে
মাসরুর আরেফিন

কখনোই সহজ না ব্যাপারটা—মানে, এই লেখালেখি। তবে নিঃসন্দেহে এটা পড়ার চেয়ে সহজ কাজ। সত্যিকারের নিবেদন নিয়ে ধরুন আপনি ঠিক করলেন যে আজ থেকে আগামী দুই মাস জন মিলটন পড়বেন কিংবা শেক্​সপিয়ার; তো, তখনই বুঝবেন কত কঠিন এক জমিনে পা রাখলেন। সে হিসেবে লেখা তুলনামূলক সোজা।

আমার মনে পড়ে, ২০১৬-১৭—দুটো বছর মার্সেল প্রুস্ত ও অমিয়ভূষণ মজুমদারে খরচ করার দুর্বিসহ স্মৃতি। কী এক অক্সিজেনবিহীন ঘোরের মধ্যে থাকতাম সে দিনগুলোয়—বইয়ের পরে বই এসে জমছে, এক বই নিয়ে যাচ্ছে আরেক বইয়ের দিকে, এক চাঁদবেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেক বঙ্কিমচন্দ্রে (ব্যাপারটা সত্য, অমিয়ভূষণের চাঁদবেনে আপনাকে বঙ্কিমে নেবে স্রেফ শেষ দিকের গদ্যের কারণে), এক মার্সেলের কুমব্রের শৈশব আপনাকে অবধারিতভাবে নিচ্ছে বালজাকে। মনে আছে, প্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম-এ ড্রেইফাস অ্যাফেয়ার পড়ে, পরে উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট ঘুরে এসে আমি থেমেছিলাম হিটলারের সাগরেদ অ্যালবার্ট শিপ্​য়ারের ইনসাইড থার্ড রেইখ বইতে। কোথায় প্রুস্ত আর কোথায় খুনি শিপ্​য়ার! 

তো, ২০২০ সালে লেখালেখির চেয়ে আমার বেশি ইচ্ছা পড়ার, আমার এর আগের নিবিড় পাঠের মডেল মেনেই (যেভাবে পড়েছি কাফকা, হোমার, শেক্​সপিয়ার, জীবনানন্দ, প্রুস্ত, বোর্হেস, অমিয়ভূষণ, জোসেফ ব্রডস্কি, সেবাল্ড বা মিশেল ফুকো) এ বছরটায় মার্ক্সবাদ নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ও স্টালিনের খুনখারাবি মার্ক্সবাদের অনেক বদনাম করে ছেড়েছে ঠিকই, তারপরও কোথায় গিয়ে মনে হয় যে ওয়ার্কিং ক্লাসের মিলিট্যান্সি এ পৃথিবীতে অবধারিতভাবে সামনেই আসছে, তাই আমার উচিত বিষয়টাকে যেহেতু অ্যাপ্লিকেশনে বোঝার উপায় নেই, সেহেতু তাত্ত্বিক জায়গা থেকে বোঝা। আর মাত্রই আমি শেষ করলাম আমার উপন্যাস আলথুসার লেখা। এবারের বইমেলায় এটা বেরোচ্ছে প্রথমা প্রকাশন থেকে, যেখানে উপরিতলে কাজ করেছি আলথুসারিয়ান মার্ক্সিজম নিয়ে। ওটা লিখতে গিয়েই বুঝলাম, পৃথিবী বদলানোর স্বপ্ন-বিষয়ক লেখালেখির, নৈতিক অবস্থানবিহীন আজব লেখালেখির, আমার মাত্র শুরু হলো, শেষ নয়। এই বইমেলায় আমার কবিতার বইও আসছে ২০০১-এর পরে এই প্রথম (২০০১-এর সেই বইটাও—ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে বাতিঘর থেকে), নাম পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়, প্রকাশক পাঠক সমাবেশ, যার থিমও ওই এক—কিছু মানুষ পৃথিবী বদলাতে চায়, তবে তা তাদের নিজেদের না বদলিয়েই এবং কিছু মানুষ শুধুই জীবনের মানে খোঁজে, কিন্তু এটা উপলব্ধি না করেই যে ওই মানে খোঁজার দরকার নেই। কারণ, আমরা প্রতিদিন বাস করি এক কোটি জানা-অজানা মানের থিকথিকে স্যুপের ভেতরেই। 

২০২১-এ তৃতীয় উপন্যাসে হাত দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ২০২০ হবে আমার ওই নির্দিষ্ট এক জীবনের মানে খোঁজার অভিমুখে মার্ক্সবাদের পিঠে চড়ে নিম্নগামী, মানে নরকের দিকে যাত্রা।

আফসানা বেগম
আফসানা বেগম

অজানা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ্রহ
আফসানা বেগম

বছরের যেকোনো একটি দিন থেকে পরের বছরের সেই দিন অব্দি সময়টাকে একটা নতুন বছর মনে করি আমি। তার পরেও, জানুয়ারি এলে কিছু পরিকল্পনার কথা নতুন করে ভাবা যায়। আনকোরা বছরের ধারণায় মোড়ক খোলা নতুন কাজে হাত দেওয়ায় একরকমের উদ্দীপনা থাকে। তা ছাড়া, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধাপে ধাপে কাজ করায় বিরতিহীন মানসিক চাপ যেমন থাকে, সময়মতো কাজ ফুরানোর সম্ভাবনাও থাকে প্রবল। যদিও জানা যায়, আমাদের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ বছরের শুরুতে পরিকল্পনা গুছিয়ে রাখে আর সফলভাবে তা অর্জন করতে পারে মাত্র ৮ শতাংশ। আমার ক্ষেত্রে আগেভাগে পরিকল্পনা করার অভ্যাস মানসিক চাপ কমায়; যেন জানা থাকে নির্দিষ্ট সময়ে কোন বিন্দু থেকে কোন বিন্দুতে পৌঁছাতে হবে, আর তারপর শুধু ছুটে চললেই হলো।

সুতরাং, নিতান্ত অভ্যাসবশত নতুন বছরে পা রাখার আগে একটা ছক মাথায় রেখেছি। লক্ষ্য অর্জন হবে কি না তা সময় বলে দেবে। ২০২০ সালের কোনো সময়ে একটা উপন্যাসে হাত দেব, যার পটভূমি অখণ্ড ভারত থেকে প্রায় এখনকার বাংলাদেশ। কাহিনির কেন্দ্রে থাকবে ঠিকানা হারানো এক মানুষের গল্প, যিনি নির্দিষ্ট দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠলেও মানসিকভাবে বরাবর নো ম্যানসল্যান্ডে হাঁটতে থাকেন; চেনা সীমানা হারান, আবার নতুন সীমানায়ও কিছুতে পৌছাতে পারেন না। সভ্যতার (কিংবা অসভ্যতার) নানা ধাপে ঠিকানা হারানো মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজের ইচ্ছা থেকে উপন্যাসটির পরিকল্পনা। আয়তনে বড় হবে বলে এর অন্তত কিছু অংশ এ বছরে লেখার ইচ্ছে আছে। 

আগের মতোই, বিচিত্র বিষয়ে কয়েকটি গল্প লেখার পরিকল্পনা থাকবে। তা ছাড়া, বিষয়ভিত্তিক গল্প সংকলনের যে চেষ্টা কয়েক বছর ধরে করছি, তাতে মানুষের জীবনে যন্ত্রের প্রভাব, অতিপ্রাকৃত এবং মুক্তিযুদ্ধ, এই তিনটি বিষয়ে অন্তত একটি করে গল্প লেখার পরিকল্পনা আছে। অন্যদিকে, সময়োপযোগী প্রবন্ধ লেখার সুযোগ পেলে তা লেখার চেষ্টা করব। প্রচুর গবেষণার মাধ্যমে সমসাময়িক বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার ব্যাপারে আগ্রহ এ বছরেও অব্যাহত রাখব। 

প্রখ্যাত তিন সাহিত্যিকের তিনটি কালজয়ী উপন্যাস আধাখেচড়াভাবে অনুবাদ করতে শুরু করেছি। যেকোনো একটিতে খানিকটা এগিয়ে যাব বলে আশা করছি। এ ছাড়া, যেহেতু প্রকাশক এবং পত্রিকার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিই, তাই আগ্রহ বোধ করলে হাতের কাজ ফেলে অন্য রকমের কাজও করে ফেলব হয়তো। অর্থাৎ অজানা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ্রহ বছরব্যাপী জারি রাখলাম। তখন মূল পরিকল্পনার খানিক রদবদল হবে বৈকি। যেহেতু যেকোনো কাজেই আনন্দ খুঁজে নিতে চেষ্টা করি, তাই সুনির্দিষ্ট ছকের বাইরের কাজ ভয় না-পাওয়াকেও পরিকল্পনায় রেখেছি।

সাদাত হোসাইন
সাদাত হোসাইন

যতটা সম্ভব বেশি গল্প বলে যেতে চাই
সাদাত হোসাইন

একটা কথা প্রায়ই বলি আমি, গল্পে যেমন জীবন থাকে, তেমনি জীবনজুড়েও থাকে অসংখ্য গল্প। একজন লেখক তাহলে কী করেন? তিনি মূলত সেই গল্পের জীবন আর জীবনের গল্পের গল্পকার হয়ে ওঠেন। লিখতে গিয়ে এই বিষয়টা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে আমাকে। চারপাশের জীবন ও জগৎ, মন ও মানুষ অবচেতনেই লেখার উপজীব্য হয়ে ওঠে। এমন না যে সেই জীবন, সেই ভাবনা কিংবা সেই গল্পগুলোকে আমি খুব সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করি, সতর্কভাবে উপলব্ধির চেষ্টা করি; বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা আমার জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার মতো। হয়তো আলাদা করে বিশেষ ভাবনা নিয়ে কিছুই দেখিনি। কিন্তু লিখতে গিয়ে আচমকা আবিষ্কার করি, কোনো একটা ঘটনা অবচেতনেই মনে দাগ কেটে গেছে।

বইমেলা ২০২০–এ অন্যধারা থেকে প্রকাশিতব্য উপন্যাস অর্ধবৃত্ত সম্ভবত আমার এই অবচেতন পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি এবং ভাবনারই ফলাফল। বইটির মূল উপজীব্য নানাবিধ সম্পর্কের সংকট। এর আগে বছরের শেষের দিকে আমার প্রথম চলচ্চিত্র গহীনের গান মুক্তি পেয়েছে। সেখানেও কীভাবে কীভাবে যেন সম্পর্কের এই সংকটগুলোই মুখ্য হয়ে উঠেছে। তখন হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি বারবার এই একই বিষয় বেছে নিচ্ছি কেন? 

উত্তর হলো, চারপাশে ঘটে চলা অসংখ্য ঘটনা, সম্পর্কের নির্মিতি, বাঁক, সংকট ও সংযোগ নিজের অজান্তেই আন্দোলিত করেছে আমাকে; এবং তা হয়ে উঠেছে আমার লেখার বিষয়। 

বইমেলা ২০২০ উপলক্ষে অন্যপ্রকাশ থেকে দুটো উপন্যাস আসছে আমার—মেঘেদের দিন ও মরণোত্তম। এই দুই উপন্যাসের ভাবনাও অনেকটা কাছাকাছি—যৌন নিগ্রহ। তবে মরণোত্তম উপন্যাসটিতে নুসরাত হত্যাকাণ্ড এবং আরও দু–একটি ঘটনা এসেছে। 

সাধারণত দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাস লিখি আমি। কিন্তু সামনের বছরজুড়ে ছোট ছোট একাধিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছে রয়েছে। বিশেষত গত বছর শুরু করা এসআই রেজা সিরিজটি নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। আমাদের নিজস্ব একটা মৌলিক গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করার ইচ্ছা ছিল আমার। সেই ভাবনা থেকেই ছদ্মবেশ নামে একটি গোয়েন্দা উপন্যাস লিখি, যার প্রধান চরিত্র পুলিশের সাব–ইনসপেক্টর রেজাউল হক রেজা। আশার ব্যাপার হচ্ছে, এ উপন্যাস ও চরিত্রটিকে পাঠক ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। ফলে এ বছর এটি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। ইচ্ছে আছে শিশু–কিশোরদের নিয়ে লেখারও। আমার শৈশব–কৈশোর কেটেছে গ্রামে। ফলে দুর্দান্ত এবং দুরন্ত এক ছেলেবেলা কাটিয়েছি আমি। ছেলেবেলার সেই গল্পগুলো নিয়েই কিশোর উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে। আসলে যত দিন সম্ভব দুই হাতে লিখেই যেতে চাই। যতটা সম্ভব 

বেশি গল্প বলে যেতে চাই আমি।