বিচিত্রগামী গল্পবিশ্ব

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর চারটি গল্পগ্রন্থ থেকে বাছাই করা ত্রিশটি গল্পের নির্বাচিত সংকলন পাঠককে যথার্থই এক বিস্তৃত, ব্যাপক ও বিচিত্রগামী গল্পবিশ্ব পরিক্রমণের সুযোগ দিয়েছে। সেই সঙ্গে ক্রান্তিকালের এক গল্পকারকে নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দও নিশ্চয়ই আছে। ত্রিশ বছরের অধিক কাল ধরে লেখা গল্পের সংকলন; স্বাদবৈচিত্র্য স্বাভাবিক। দ্রুত পরিবর্তমান সময়, সমাজ, পরিবেশ, প্রযুক্তিবিশ্ব তাঁর আজকের গল্পের অন্বিষ্ট হবে, এ–ও স্বাভাবিক। তবে যা হারিয়ে যায়, তার জন্যই তো যত হাহাকার, যত মায়া। নইলে উপন্যাসের সুরে গাওয়া গল্প দিয়ে তিনিই বা শুরু করবেন কেন?

‘নূর আলী টেইলার্স’ সংকলনের প্রথম গল্প। সন্দ্বীপ থেকে নূর আলীর চট্টগ্রামে পালিয়ে আসাটা মূলত এক জীবনের গল্প থেকে পালিয়ে আসা। প্রান্তিক জনপদে নূর আলী টেইলার্স তাঁর নতুন জীবনের গল্প। অশ্রুরানী অধ্যায় তাঁকে অন্য জীবনের গল্পের স্বপ্নে বিভোর করে। কিন্তু অশ্রুরানী-নেপালের গল্পের অমোঘ টানে নূর আলীকে মহৎ হতে হয়। গল্পকারের পক্ষপাত গল্পে; গল্পকে জিতিয়ে দেন তিনি।

‘কৃষ্ণগোপালের ভবিষ্যৎ’ গল্পে সম্বিৎ ফিরে পাওয়া হরিকিশোরের প্রশ্ন শুনে সরকারি চাকরি সূত্রে গ্রামে আসা চিকিৎসকের নিজেরই অজ্ঞান হবার জোগাড়। ‘একটা কালো মানুষ কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে কর্তা?’ গল্পের পাঁচ–পাঁচটি দরজা খুলে শেষ প্রান্তে পৌঁছে নাতির ভবিষ্যৎ ভেবে দিশেহারা হরিকিশোরের যে গল্প আমরা পাচ্ছি, তার ভাগীদার অনেক। তবে উপন্যাসের সমুদ্র ভ্রমণের ঘোর পেরিয়ে পাঠক শেষ পর্যন্ত যে ঘাটে পৌঁছায়, সেটা ছোটগল্পের ঘাটই বটে।

এমন আরেকটি গল্প ‘সেন্ট জোনাথনের ছেলে’। এ–ও কি গল্প সত্যি? অথবা জীবন? এ কেমন জীবন, এ কেমন গল্প ভাবতে হবে আকাশ-পাতাল। এ গল্পেরও শাখাগল্প, পাতাগল্প, ফুলগল্প, কুঁড়িগল্প আছে। সব ছাড়িয়ে, সব ছাপিয়ে থাকে পিতা-পুত্র।

বিচিত্র পেশার মানুষের গল্প বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পের অন্যতম আকর্ষণ। তাঁদের মুখের কথা, মনের কথা, দেহের ভঙ্গি, পোশাক, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সংগতি-অসংগতির বিশ্বস্ত বয়ান তাঁর গল্পের অন্য রকম সৌন্দর্য। ‘রূপবান হেয়ার-কাটিং’ গল্পে প্রাণহরির ক্ষৌরকর্মের ধরন শুধু নয়, তাঁর গল্প বলার জাদুও খদ্দেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। কদমরসুল মার্কেটের রূপবান হেয়ার কাটিংয়ের প্রাণহরি একদা নন্দন কানন রথের পুকুর পাড়ে কাজ করেছে। একদিন প্রাণহরির গল্পে মশগুল এক খদ্দেরের কাছে অপেক্ষমাণ আরেক খদ্দের ছুটে আসেন। ‘আচ্ছা, আপনি কি কবি জসীমউদ্​দীন?’ খদ্দের বলেন, ‘হ্যাঁ।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রাণহরিকে সরিয়ে দিয়ে তিনি নিজেই কাজে লেগে যান। দাড়ি কাটা শেষ হলে জানা যায়, তিনি রমেশ শীল। অতঃপর কবি ও কবিয়ালে কোলাকুলি-গলাগলি।

নির্বাচিত গল্প
বিশ্বজিৎ চৌধুরী
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, চট্টগ্রাম
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রকাশক: বাতিঘর, চট্টগ্রাম
২৮৭ পৃষ্ঠা
দাম: ৫৩৪ টাকা।

গল্পের জাদু কতভাবে কাজ করে, পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকা জীবনের মায়া কত বিচিত্র পথে কাজ করে যায়, বিশ্বজিতের গল্পে তার নমুনা প্রচুর। ‘সায়রাবানু সিনড্রোম’–এর প্রৌঢ় জেবল হোসেন কিশোরী কাজের মেয়ের শুশ্রূষা নিতে গিয়ে নতুন করে শরীরী জাগরণের শিকার হয়ে যে কীর্তি করেন, তাতে তাঁর লাঞ্ছনা–গঞ্জনার শেষ থাকে না। পুত্রবধূর ধমক জড়ানো পরামর্শ অনুযায়ী আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিলেও জীবন তাঁকে মরতে দেয় না।

গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানেন গল্পের হাতটা কীভাবে ধরতে হয়, কখন কীভাবে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে হয়, পাঠককে কোন ভাবের ঘোরে ফেলে গল্পের কোন চরিত্রকে দিয়ে কোন কাজটা কখন করিয়ে নিতে হয়। গল্প যে শুধু ঘটনার নয়, চরিত্রের ভাবভঙ্গি, ভাষাভঙ্গি, চালচলন—সবকিছুতে গল্প চালিয়ে দেবার যে কৌশল চাই, সেটি তাঁর করায়ত্ত। তাঁর চরিত্রদের যাপিত জীবনের কোষে কোষে গল্প থাকে। সত্যিকারের সাপ হয়ে ছোবল দিতে সক্ষম তারা। আবার সর্পভ্রমে রজ্জুতে প্রাণসংশয়ের মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে বিশ্বজিতের গল্প।

গল্প বলার ধরন নিয়েও যথেষ্ট কাজ করেছেন বিশ্বজিৎ। আবার প্রচুর তাড়াহুড়ার স্বাক্ষরও রয়েছে তাঁর কোনো কোনো গল্পে। মোড় ঘুরিয়ে গল্পটাকে এ ঘাট থেকে ও ঘাটে নিয়ে গিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত বা বিমূঢ় করে তুলতেও যথেষ্ট পারঙ্গম গল্পকার। ‘এখন বর্ষা না বসন্ত’ গল্পের প্রবাসী মেয়েটি পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দেশে এসেছে। মায়ের মুখ দেখে মাকে প্রশ্ন করে: ‘ডু ইউ ফিল রিল্যাক্সড মাম্মি?’ এ প্রশ্নে স্রোতের টানে গল্প আসে।

‘পরী’ গল্পে কোনোমতে বিএ পাস করা গ্রামের সহজ-সরল ছেলেটি জীবনের খোঁজে শহরে আসেন। উকিল মামার সঙ্গে পরির পাহাড়ে (কোর্টবিল্ডিং) আসা-যাওয়ার পথে শিমুলতলায় অপেক্ষমাণ পরির মতো মেয়েটি তাঁকে মোহাচ্ছন্ন করে। ঘোরগ্রস্ত যুবকের সব খবর সে নেয়, কিন্তু নিজের কথা কিছুই বলে না। সে নাকি তার নিজের সম্পর্কে কিছুই জানে না। আইনজীবী হবার স্বপ্ন সফল হবার নয় এবং পরিকে পাওয়াও যে অসম্ভব, সেসব বোধগম্য হবার পর গ্রামের ছেলেটি আবার গ্রামেই ফিরে আসেন। পরিকে তাঁর মনে পড়ে। তাঁর ধারণা, পরির পাহাড়ে একদা সকাল-সন্ধ্যায় পরিরা নেমে আসত। তাদেরই কেউ ভুল করে একটা শিশু ফেলে গিয়েছিল। সে-ই এখন পরির পাহাড়ের শিমুলতলায় কাস্টমারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। গল্পের এমন স্বপ্নাচ্ছন্ন, পবিত্র মোচড় যিনি দিতে পারেন, তিনিই আবার অপরাধ জগতের আদ্যোপান্ত দেখিয়ে দেওয়া গল্প বলেন অবলীলায়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্প এক কথায় অশেষ।