সরস ভাষায় উনিশ শতকের কিছু উপাখ্যান

ইতিহাসের কোনো ঘটনাকে আশ্রয় করে সরস-সরল ভঙ্গি ও ভাষায় কিছু লেখা সহজ কাজ নয়। দুই বাংলাতেই এ ক্ষেত্রে কাজ করছেন, এমন লেখকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বেঁচেবর্তে যাঁরা আছেন, তাঁদেরই একজন মাহবুব আলম।

বেগমের কূটনৈতিক মিশন ও অন্যান্য: ইতিহাসের বিস্মৃত সরস কাহিনি তেমনই একটি বই, যার মূলে রয়েছে উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক বাংলার পটভূমি। লেখক মাহবুব আলম বলেছেনও সে কথা, যার ভাষ্যটা এ রকমের: ‘উনিশ শতকে বাঙালির জীবনচর্চা ও চিন্তাচেতনায় যে বিপুল রূপান্তর ঘটেছিল, তার স্পন্দন ও অর্জন আজও আমাদের জীবনে নানাভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। কখনো তাকে চেনা যায়, কখনো যায় না। এই বিচিত্র দ্যুতিময় শতককে নানা দিক দিয়ে দেখার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বক্ষ্যমাণ লেখাগুলোর অপ্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে।’

এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত নয়টি প্রবন্ধের শিরোনামই পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে সেগুলোর অন্দরমহলে প্রবেশের জন্য। ‘বেগমের কূটনৈতিক মিশন’, ‘রামমোহনের রাজা উপাধি লাভ ও বিলাতে দিল্লির বাদশাহের দূতিয়ালি’, ‘পূর্ববঙ্গে খ্যাপাটে সাহেবরা’, ‘উপহার, উপঢৌকন আর উৎকোচ একই সুতোয় গাঁথা’, ‘ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক-সংবাদ প্রাচীন বাঙ্গালা গদ্য পুস্তক’, ‘বাংলার মরণব্যাধি কালাজ্বর’, ‘মংডুতে বিভূতিভূষণ’, ‘ঢাকা–ময়মনসিংহের নিজস্ব সম্পদ ঠাকুরমা’র ঝুলি ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধের সমাজের প্রতিবিম্ব সমাচার দর্পণ পত্রিকা’ শিরোনামের লেখাগুলো পাঠকেরা যখন পড়তে শুরু করবেন, তখন তাঁদের চোখের সামনে সেই কাল বা সময়পর্বের রূপ এমনভাবে ধরা দেবে, মনে হবে, চোখের সামনেই যেন সবকিছু ঘটছে।

উদাহরণস্বরূপ ‘বেগমের কূটনৈতিক মিশন’ প্রবন্ধের কথাই ধরা যাক। ব্রিটিশ শাসকের শতবর্ষের মিত্র লক্ষ্ণৌ-অযোধ্যার বাদশাহ ওয়াজিদ আলী শাহকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ভারতের ইংরেজ শাসকেরা তাঁর ক্ষমতা কেড়ে নিলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তাঁর মা স্বাধীন অযোধ্যা রাজ্যের শেষ রানি আউলিয়া বেগম। তবে প্রতিবাদী হয়ে তিনি ঘরে বসে থাকেন না। জাহাজ ভাড়া করে একদল সঙ্গী-সহচরসহ দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে লন্ডনে পৌঁছান। উদ্দেশ্য, ব্রিটেনের তখনকার রানি আর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সরাসরি ন্যায়বিচার প্রার্থনা করা, ছেলে ওয়াজিদ আলী শাহকে আবারও সসম্মানে গদিনশিন করা। তিনি দেখা করেন রানি ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে। আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। কেন ব্যর্থ হয়, তার সরস বিবরণ আছে। তবে ইতিহাস বাদ দিয়ে নয়। ব্যর্থতার পর আউলিয়া বেগম ১৮৫৮ সালে চলে আসেন প্যারিসে। সেখানেই তাঁর করুণ মৃত্যু হয়। প্যারিসের ভুবনবিখ্যাত পের লেসেস কবরস্থানে এখনো আছে তাঁর কবর। তবে একেবারেই জীর্ণদশা তার। ‘বেগমের কূটনৈতিক মিশন’ মনকে সত্যিই রোমাঞ্চিত করে। করে ব্যথাতুরও।

রাজা রামমোহনের সমাজ সংস্কার সম্পর্কে, তাঁর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আমাদের কমবেশি জানা আছে। তবে তিনি ‘রাজা’ উপাধি কীভাবে, কার কাছ থেকে এবং কোন প্রেক্ষাপটে পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে জানি না বললেই চলে। ‘রামমোহনের রাজা উপাধি লাভ ও বিলাতে দিল্লির বাদশাহের দূতিয়ালি’ প্রবন্ধে মাহবুব আলম তুলে ধরেছেন তারই প্রায় বিস্তারিত বিবরণ। দিল্লির বাদশাহ তখন দ্বিতীয় আকবর। তাঁর প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানা অবিচার করতে শুরু করেছিল। ফলে তিনি ইংরেজি, ফারসি, লাতিন ও আরবি ভাষা জানা রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর পক্ষে ইংল্যান্ডে গিয়ে দূতিয়ালি করার জন্য পাঠান। তবে রামমোহনের রাজা উপাধি প্রাপ্তি ও দূতিয়ালি করার ব্যাপারটি নিষ্কণ্টক ছিল না। সবকিছু উপেক্ষা করে ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতা থেকে ‘দ্য আলবিয়ান’ নামের জাহাজে চেপে একই সালের ৮ ডিসেম্বর লিভারপুল পৌঁছান রাজা রামমোহন। হিন্দু সমাজের জন্য তখন সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ ছিল। সেই বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রামমোহন ইংল্যান্ডে পৌঁছান। ফলে তিনি ব্রিটেনের মননশীল ও অভিজাতশ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের দূত হিসেবে যে তৎপরতা চালান, কিছুটা হলেও তার ফল পাওয়া যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে বাদশাহের আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করার মাঝপথেই তিনি মারা যান। এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে লেখক যেসব তথ্যসূত্রের আশ্রয় নিয়েছেন, এক কথায় তা প্রশংসার দাবিদার। এমন তথ্যসূত্র থেকে আরও জানতে পারি বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের সমস্যা বিষয়ে দূতিয়ালির পাশাপাশি সতীদাহ প্রথা বিলোপে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণে রামমোহনের অবিচল তৎপরতা সম্পর্কেও। এ প্রবন্ধ পাঠককে রাজা রামমোহন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করবে। ‘পূর্ববঙ্গে খ্যাপাটে সাহেবরা’, ‘উপহার, উপঢৌকন আর উৎকোচ একই সূত্রে গাঁথা’, ‘ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক সংবাদ প্রাচীন বাংলা গদ্য-পুস্তক’, ‘বাংলার মরণব্যাধি কালাজ্বর’, ‘মংডুতে বিভূতিভূষণ’, ‘ঢাকা-ময়মনসিংহের নিজস্ব সম্পদ ঠাকুরমা’র ঝুলি ও ‘উনিশ শতকের প্রথমার্ধের সমাজের প্রতিবিম্ব সমাচার দর্পণ পত্রিকা’ শিরোনামের প্রবন্ধগুলোর পাঠ ঊনবিংশ শতকের বাংলার উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে পাঠককে যে ধারণা দেবে, তা পাঠকের মন ও মননকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে। মাহবুব আলম সেই প্রাজ্ঞ কারিগর, যিনি ইতিহাসের বিষয়কে একান্ত ঘরোয়াভাবে পরিবেশন করেন বলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

বেগমের কূটনৈতিক মিশন ও অন্যান্য: ইতিহাসের বিস্মৃত সরস কাহিনি 

মাহবুব আলম 

প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমেদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৯

১৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০ টাকা।