দহনদাগ

এটা তো পুলিশ কেস! এখানে কিছু করা যাবে না। এত দেরি করে এনেছেন কেন, তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। কানের ফুটো থেকে স্থেটোটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে খুবই নির্বিকার কণ্ঠে বললেন এমাঞ্জেন্সির ডাক্তার। চারপাশে রোগী আর রোগীর আত্মীয়দের ভিড়। এই ভিড় কাটিয়ে দুজন নার্স আমার ট্রলিটা ঠেলে ঠেলে আবার অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে আসে। ডেটলের গন্ধটা সরে যেতেই কান ফুটো করে বেজে ওঠে সাইরেন। রিকশা, অটোরিকশার হুড়োহুড়ির মধ্যে আদ্​দীন হাসপাতালের চিকন গলির ঘিঞ্জি থেকে মোচড়াতে মোচড়াতে বের হয়ে আসে অ্যাম্বুলেন্সটা।

আমাকে বয়ে নিয়ে বাসার কাছাকাছি মগবাজার এলাকার এটা তৃতীয় হাসপাতাল। তিন জায়গা থেকেই ফিরিয়ে দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের পথ দেখিয়ে দিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু খোঁড়াখুঁড়িতে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ট্রাফিকের যে অবস্থা ওই পর্যন্ত পৌঁছা অবধি বেঁচে থাকব তো? নাকি ফুরিয়ে যাবে সব? এমন সন্দেহে আম্মার কলজে পোড়া ছটফটানিটা আব্বা সামলাতে পারছেন না। নিজেকে শক্ত রেখে বলেন, উপায় নেই, এদিকের কোনো হাসপাতালেই কিছু করবে না। শুনে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন আম্মা, ও আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে কি আর বাঁচানো যাবে না? ওরে বাঁচাও মাবুদ। অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেনের সঙ্গে জড়াজড়ি করা আম্মার আত্মাচেরা আহাজারি আমার কানের কাছে আসে, আবার হারিয়ে যায়।

চোখ কি খোলা আছে আমার? বুঝতে পারছি না, ঝাপসা হয়ে আছে। জিব আড়ষ্ট হয়ে আছে। বুকের জল শুকিয়ে চৌচির হওয়া তৃষ্ণার মধ্যে ডুবতে ডুবতে ভাবছি কোন দিক দিয়ে ছুটছে অ্যাম্বুলেন্স। আমার মগজের ভেতরের কোনো সুড়ঙ্গ দিয়েই বুঝি! চোখের পাতা দুটো এত ভারী হয়ে আছে কেন? এতই ভারী যে টেনে তুলে পলক ফেলব সে উপায়ও নেই। টের পাই আমার মাথার চুলে বিলি কেটে কেটে ঝাঁঝরা হতে হতে ফোঁপরা হতে হতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আম্মা।

আব্বার উপস্থিতি আর অনুভব করি না এখন। তাঁর শরীর থেকে শ্বাস বুঝি ঝরে গেছে। হয়তো গাঢ় বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছেন তিনি। আমাকে নিয়ে এমন একটা আকস্মিক ধাক্কায় একেবারে বোধবুদ্ধিহীন হয়ে ভয়ে শিটিয়ে গেছেন কি? আমাদের অ্যাম্বুলেন্সটির দিকে আর একটি অ্যাম্বুলেন্স ধেয়ে এসে সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দে গাঁথতে গাঁথতে বিপরীত দিকে ছুটে যেতেই বোধ হয় ঘোরলাগা তন্দ্রা ছুটে গেল আমার। স্ট্রেচারে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা শরীরে অনবরত দুলুনি লেগে উগলে উঠছে চাইছে বমির ভাব। আম্মাকে বলব কি যে আমার বমি পাচ্ছে? কিন্তু কী করে বলব, আমার জিব যে নড়ছে না কিংবা বলেই যাচ্ছি তাঁকে আমি, কিন্তু উনি শুনতে পাচ্ছেন না, টের পাচ্ছেন না কিছুই। হড়হড় করে বমি করতে থাকি। বমি করা ভালো। এতে বাঁচার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তা ছাড়া যেখানে নেওয়া হচ্ছে সেখানে প্রথমেই তো এ কাজটিই করাবে। যে করেই হোক তারা করাবে আর আমাকে বাঁচাবে। হ্যাঁ, এখন বোধ হয় বেঁচে উঠতে চাইছি আমি। বুকভরে শ্বাস নিতে চাইছি। আর এই যে নাড়িভুঁড়ি উগরে বমি করে দিলাম, বিষম তেতো জলে সিথান তো জবজব করছে, টকটক বিচ্ছিরি কটু গন্ধে ভরে উঠেছে গোটা অ্যাম্বুলেন্স! আম্মাকে বলি, আম্মা, দেখেন দেখেন, কিন্তু আম্মা কি এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না? আম্মা কি তবে নেই আমার পাশে? আব্বা, আব্বাই বা কোথায় গেলেন? গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে থাকি আমি। কিন্তু সাইরেনের গোঙানির মধ্যে আমার ভাঙা গলার খড়খড়ে টক তেতো দুর্গন্ধযুক্ত আওয়াজ দূর থেকে আরও দূরে ভেসে যায়। 

আব্বাকে বলি, আপনার মনে পড়ে কি আব্বা, তখন এয়ারপোর্টে চাকরি করতেন আপনি। আমার আম্মা আর আমি নয়াটোলার একটা ছোট্ট বাসায় থাকি। আমাদের সেই বাসাটায় যখনই আসতেন, চকলেট চুইংগাম রংপেনসিল একটা না একটা কিছু নিয়ে আসতেন। স্কুলের চাকরি দিয়ে তো আর রোজ রোজ আমার নতুন নতুন আবদার মেটাতে পারেন না আম্মা। তখনকার আপনিই হয়ে উঠলেন আমার রঙিন দুনিয়ার নতুন রাজপুত্র। আমার জাদুর বাক্স। সে সময়ের এক জন্মদিনে একটা লাল ঘড়ি দিয়েছিলেন আপনি। তাতে ছিল স্টপওয়াচ, টেম্পারেচারের মাপ। স্কুলে ক্লাসের বন্ধু আরিফ আর তারেক একটু হাতে পড়ে দেখবে বলে কত পীড়াপীড়িই না করেছিল। কিন্তু আমি দিইনি। টানাহ্যাঁচড়ায় ঘড়ির বেল্টটা ছিঁড়ে গেলে তাই নিয়ে আমাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত মারামারি। প্রিন্সিপাল তাঁর রুমে ডেকে আমার সামনে, শামীমা আপা, হারুন স্যারের সামনে ধমকাচ্ছিলেন আম্মাকে। স্কুল থেকে বের করে দেবেন বলেছিলেন। মা হয়ে আমাকেই ম্যানেজ করতে পারেন না তো অন্য ছাত্রদের ব্যাপারে তার ওপর ভরসা কী তাদের। লজ্জায় অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন আম্মা। যদি সত্যিই বের করে দেন তাহলে কী উপায় হবে আমাদের! এই ভয়ে ওই নির্দোষ বয়সের বুকটা হিম হয়ে গিয়েছিল—এই এখন যেমন আমার গোটা ছাতির ভেতরটা মাটির তল থেকে তোলা একটা পুরোনো স্যাঁতসেঁতে পাথরের মতো হিম আর ভারী হয়ে আছে, তেমন। 

আমাকে নিয়েই তো যত ভয় ছিল আম্মার। আপনাকে মেনে নেব কি না, সেই ভয়। কিন্তু আব্বা, আপনার সঙ্গে আমার ভাব হওয়াতে একদা সে ভয় কেটে গিয়েছিল তাঁর। একদিন নয়াটোলার বাসা ছেড়ে আমরা আপনার মগবাজারের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছিলাম। কী দারুণ একটা খোলামেলা বাসা। ধীরে ধীরে আমাদের জীবনটা একেবারে বদলে গেল। এমন একটা জীবনের জন্যই কি অপেক্ষায় ছিলেন আমার আম্মা? নাকি আমার নিরাপত্তার জন্যে? এসব আমি জানতে চাইনি কখনো। দুঃখদীর্ণ হয়ে কে-ই-বা বেঁচে থাকতে চায়? এরপরই শুরু হয়েছিল তার থিতু হওয়ার সংগ্রাম। 

মনে পড়ে আপনার, আম্মা, মগবাজারে আসার আগে একদিন খালামণি এসেছিলেন আমাদের নয়াটোলার বাসায়। মাঝেমধ্যেই আসতেন। সেদিন আমার জন্যে কাঠি লজেন্স এনেছিলেন। কাঠি লজেন্সের বয়স সেটা নয়, তবু খালামণি আমাকে এগুলো দিয়ে আনন্দ পেতেন, তাই। খাটে বসে আমি সেই লজেন্স নিয়ে খেলছিলাম, কিছুতেই মোড়ক খুলছিলাম না। কেননা, খুললেই তো খাওয়া হয়ে যাবে। আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন আব্বা, সেদিন আপনাকে নিয়েই আলোচনা চলছিল দুই বোনের। যেটুকু মনে পড়ে কথাগুলো ছিল এ রকম, খালামণি বলছিলেন, তুই এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি? আম্মা কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলছিলেন, ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে, বুবু। ও একটা শিক্ষিত মানুষ, রুচিশীল মানুষ, ওকে নিয়ে আর কদ্দুর কী হবে। যদি আর একটা জাহান্নামও হয় তা-ও মিনিমাম রুচির মধ্যে তো থাকবে। রুচিদৈন্যের বিষ্ঠা গায়ে জড়াবে বলে মনে হয় না। 

আম্মা, আপনি কি যন্ত্রণাদীর্ণ দেহের অন্ধকারে অনেক ঘৃণা পুষে রেখেছিলেন? অনেক নোংরা লেগে যাওয়া জীবন ছিল কি আপনার? মানুষ যত সচেতনই হোক নিজের মতো করে কি সব গোছাতে পারে, আম্মা? আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তো দেখে আসছি কত চেষ্টা করেছেন, কত আগলে রেখেছেন, আমার দিকে খেয়াল রাখতে রাখতে, আমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আপনার সব পেরেশানি দিয়ে আমার পৃথিবীটাকে আপনার করে গড়ে তুলেছেন। আমার সব আলো, আমার সবটুকু অন্ধকার, আমার ভালো, আমার যা কিছু মন্দ, তা তো আপনারই আলো-অন্ধকার, আপনারই ভালো-মন্দ। আপনার এই ভালোবাসার বোঝা আর বহন করে উঠতে পারছিলাম না, আম্মা। অকারণেই কিনা কে জানে, বড় বেশি হতাশার ক্লান্তি এসে ভিড় করেছিল কি জীবনে! 

গলা চড়িয়ে চিৎকার করতে মন চাইছে এখন। সাধারণ সক্ষমতাটুকুও কেন ভোতা আমার? কেন জোর পাই না? জোর খাটাতেও তো পারি না! জীবন ফুঁড়ে জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়তেও যত বাধা আমার! সব যেন ফুরিয়ে গেছে—কোনো উদ্দীপনা নেই। খুব কি তেষ্টা পেয়েছে? গলাটা এত শুকনো লাগছে কেন? রাস্তাটা কতখানি খারাপ যে অ্যাম্বুলেন্সটা এমন ঝাঁকি খাচ্ছে? মনে হচ্ছে স্ট্রেচার থেকে উল্টে পড়ব। বমির বোটকা গন্ধে দম আটকে আসছে যে। কারও নাকেই কি লাগছে না এই গন্ধ? আসলেই কি বমি করেছি আমি? 

ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে এবার আব্বার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। রং সাইড দিয়ে ঢুকবেন কিনা জিজ্ঞেস করছেন ওনাকে। মৎস্য ভবনের মোড় থেকে রং সাইডে ঢুকে হাইকোর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবেন কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। গভীর উদ্বেগ নিয়ে আম্মাও এদিক থেকে তাড়া দিচ্ছেন আব্বাকে, থম ধরে বসে আছ কেন, গ্লাসটা নামাও, সার্জেন্টকে বলো। 

হঠাৎ করে কার যেন ফোন এল—এবার ফোনে কথা বলছেন আম্মা, তিন পাতা ছিল। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী রোজ একটা করে নয় দিন ধরে খাচ্ছিল। সে হিসেবে একুশটাই তো থাকার কথা। একুশটাই খেয়েছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব, এমার্জেন্সির গেটেই থাকো। আম্মার কথার ধরন দেখে বোঝা গেল ওপাশে খালামণি অথবা খালু। আমার খালামণি-খালু নিঃসন্তান কিন্তু বিস্ময়কর এই জুটি! খালু মানুষটা এমন, খালামণি ছাড়া ওনার পৃথিবীতে কেউ নেই আর। এই যুগেও আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া জীবন ওনাদের। 

আব্বা, আপনি মানুষটা কিন্তু একেবারেই তেমন নন। আমরা মগবাজারের বাড়িতে ওঠার পর থেকে বহুদিন পর্যন্ত বেশ ছিলাম। কোনো কিছুরই কোনো অভাব নেই। তখন কী নির্ভার জীবন আম্মার! শুধু আম্মার কেন, আমাদেরও। দিনে দিনে দেখি একটা ছাঁচের মধ্যে পড়ে গিয়ে একটু একটু করে কেমন ছটফটাচ্ছিলেন আপনি, আব্বা। ছাঁচে গড়া জীবন আপনার জন্য নয়। কোথা দিয়ে কী যে হতে থাকল! মাঝেমধ্যে মদ খেয়ে ফিরতে শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে প্রায় প্রতিদিন। সেদিন লিভিং রুমের দরজা খুলে দিয়ে আম্মা দাঁড়িয়েছিলেন ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছায়া ফেলে। টুলে বসে জুতো খুলছিলেন আপনি। আম্মার কথাগুলো কি ফালি ফালি করে দিয়েছিল আপনাকে? পায়ের একপাটি জুতো তুলে নিয়ে আয়নাটায় যেভাবে ছুড়ে মেরেছিলেন ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়েছিল ওটা। বরিশালে বেড়াতে গিয়ে একবার নানির কাছে শুনেছিলাম, ঝিকে মেরে বউ শাসনের কেচ্ছা। সে গল্পের মানে কিন্তু সেদিন ভালো বুঝিনি। জুতো ছুড়ে আয়না ভাঙার দিন আম্মার বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে সেই কেচ্ছার মানেটা একেবারে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমার। আপনার দিকে তাকাতেই দেখেছিলাম রাগটা নিভে গেলেও আমার সামনে সংকোচে কুঁকড়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে রয়েছেন। ঝাড়ু নিয়ে বেলচায় করে কাচের টুকরোগুলো তুলতে তুলতে আম্মা বলেছিলেন, হাঁ করে নাটক দেখা হচ্ছে? রুমে যাও। চুপ করে চলে গিয়েছিলাম কিন্তু সেই থেকে আপনাদের নাটক যে আর থামেনি। 

সাবধানি মানুষ আপনি আম্মা, অথচ সামলে চলতে পারলেন কই? আমি কী শুনছি, কী জানছি, কী বুঝছি না বুঝছি তার তোয়াক্কাও করেননি। কোন মেয়ের সঙ্গে আব্বার সম্পর্ক, তাঁর কোন বন্ধুরা কেমন, কোথায় সময় কাটায়, কী করে না করে সেসবের তালাশ নিতে নিতে মানুষটাকে একেবারে বেদিশা করে তুলেছিলেন। তাঁর শ্বাসের গন্ধেও কত–কী খুঁজে পাচ্ছিলেন! এই করে করে কি মানষিক রোগী হয়ে উঠেছিলেন? হ্যাঁ তাই তো, আপনি একলা কেন, আমরাও মানষিক রোগী হয়েই তো উঠেছিলাম! ইগল পাখির ডানায় চড়িয়ে দিয়েছিলাম জীবনটাকে। স্বপ্নের মধ্যেও খামচাতে লেগেছিলাম নিজের মুখ। হৃদয়ে জলের গন্ধ মুছে যেতে শুরু করেছিল। বড় বেশি নষ্ট হতে শুরু করেছিল সবকিছু। 

এরই মধ্যে একবার দাদা এসেছিলেন। স্কুলের মাস্টারি থেকে অবসর নেওয়া সেকেলে মানুষ। জায়গাজমি যেটুকু আছে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়ে নির্ভার হতে চাইছিলেন। নাশতা রেডি করে দিয়ে আম্মা তো সকালেই চলে গেছেন স্কুলে। আমার কলেজ বন্ধ। আমি যে ঘরে আছি তা জেনেই হোক কি না জেনে ডাইনিংয়ে বসে দাদু আব্বাকে বলছিলেন, চিরটাকালই দেখলাম তুমি একটা ঘাড়বাঁকা লোক। লাইনমতো চললা না। বিয়া একটা করছ, ঘরে সন্তানাদি হইল না। কার না কার পোলা পাইলা-পুইষা বড় করতেছ। তা যা ভালো বোঝো করো বাবা, আমার এতে কিছু বলার নাই। সম্পত্তি যা আছে ভাগ কইরা রাখছি, বাড়ি গিয়া তোমারটুক তুমি বুইঝা লও। এই বয়সে এখন শান্তিতে মরতে পারলেই বাঁচি। 

দাদার কথার উত্তরে সেদিন চুপ হয়ে ছিলেন আপনি। কোনো উচ্চবাচ্চই করেননি, আব্বা। একটা বিদ্যুৎচমক যেভাবে ঘনকালো মেঘখণ্ডকে দুফালি করে দেয়, দাদার কথাগুলো আমাকে তেমনি করে চিরে দিয়েছিল সেদিন। শ্রীচৈতন্যর একটা বাণী আছে। স্ত্রী বিয়োগ হলে তিনি তাঁর মাকে বলেছিলেন, ‘কস্য কে পতি পুত্রদ্যা, মোহ এব হি কারণম্’। পতি পুত্রাদি কে কাহার? কেহই কাহারও নহে, মোহই ওই সকল প্রতীতির হেতু। আমার কি মোহভঙ্গ হয়েছিল সেদিন? জানি না। 

অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে আবার এসে সিটে বসলেন আব্বা। তাঁর গলা শুনতে পেলাম। না, ওদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন চলছে। শাহবাগ, টিএসসি হয়ে যেতে হবে। আম্মা বুক চাপড়াতে লাগলেন। হায় হায় করে উঠলেন। আমার পা দুটোয় কি বরফ চেপে ধরেছে কেউ? এত ঠান্ডা লাগছে কেন? শাহবাগের মোড়ে তো সারি সারি ফুলের দোকান। ফুলের দোকানের কথা ভাবতেই রীমার কথা মনে পড়ল কেন আমার? তোমার না বেলি ফুল খুব পছন্দ, রীমা? আমার একদম না। তবু কতবার কিনেছি। শুধু তোমার জন্যই কিনেছি কিন্তু অতি তুচ্ছ আর হীন হয়ে উঠেছিল সেসব কেনাকাটা, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া, লেকের ধারে ঘুরে বেড়ানো। আমার বিষণ্নতার কাছে সবকিছইু হেরে গিয়েছিল। অবসাদের ধাঁধার মধ্যে এতই একা হয়ে উঠেছিলাম, তুমি আর নিতে পারছিলে না। আমাকে সহ্য করতে পারছিলে না, কাছে থেকেও তারা থেকে তারার মতো আলোকবর্ষের দূরত্বে চলে গিয়েছিলাম আমরা। সেসব ছোট ছোট স্নিগ্ধস্মৃতিও কি ক্লান্ত করে তুলছিল আমাকে? 

ইমার্জেন্সির গেট দিয়ে তো ঢুকতে পারছে না অ্যাম্বুলেন্স। গিজগিজ করছে মানুষ। দূর থেকে স্লোগানের শব্দ ভেসে আসছে। খালু বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি হয়েছে। গুরুতর আহত এবং মৃত্যুমুখী বহু ছাত্র এখন এখানে। মন্ত্রী, আমলা সাংবাদিক আর উত্তেজিত ছাত্রদের চাপ সামলাতে পারছে না পুলিশ। 

অ্যাম্বুলেন্স ঢুকবে না তাই স্ট্রেচারসহ কাঁধে করে নামানো হচ্ছে আমাকে। চোখেমুখে হাত বুলিয়ে খালামণি চুমু খেলেন আমার ঠান্ডা কপালে। তার মায়াময় উষ্ণ স্পর্শে ঊষর চোখ মেলে তাকাতে চাইলাম। কিন্তু তাকাতে কি পারছি আমি? মনে হচ্ছে মহাকালের গহ্বর থেকে অমাবস্যার তমিস্রা এসে আমার দৃষ্টি এবং অনুভূতির সব কটা দরজা সেঁটে দিয়েছে। এত আন্ধকার সাঁতরে তাহলে কোথায় চলেছি আমি? 

একটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার মতো মানুষের বিপুল কোলাহলের ওপর দিয়ে উড়িয়ে এনে এ কোন ঘরে ঠেলে দেওয়া হলো আমাকে? পৃথিবীর সব পথ বুঝি এসে থেমে গেছে এখানে। চৌবাচ্চায় অবিরল জল পতনের শব্দ আর তীব্র আলোর মধ্যে ভূতের মতো কয়েকটা লোকের কথাবার্তা আর তাদের ছায়া ভেসে বেরোচ্ছে। ধাতব কোনো বস্তুর ওপর শুইয়ে ভেজা দড়ি দিয়ে দ্রুত আমার হাত, পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গলা দিয়ে সাঁই সাঁই করে সাপের মতো কিছু একটা সেধিয়ে গেল কি? প্রাণের মধ্যে জলের প্রবাহ আর থামে না যে। তলিয়ে যাচ্ছি আমি, আম্মা। আপনার ক্লান্ত ডুবন্ত ছেলেটাকে টেনে তোলেন, টেনে তোলেন আম্মা, আম্মা গো। 

আর শ্বাস নিতে পারছি না। দম নেবার মতো এক ফোঁটা টাটকা সরল বাতাস কোথাও কি নেই? বন্ধুরা কোথায় গেলি তোরা সব? দেখছিস না, লাল জামা গায়ে নিথর শরীর নিয়ে সাগরের নোনাজলে ভাসছে আমার তিন বছরের ছোট্ট ভাই আইলান কুরদি! পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে বনভূমি। ভয়ে আবাস ছেড়ে অজানার দিকে ছুটছে নিরীহ প্রাণীরা। শঙ্খচিলের ডানায় রোদের গন্ধ নেই। এই ঘোর যুদ্ধে সিরিয়ার শিশুদের এখন কী হবে, খালামণি? ফরাসি ফুকো ভাই, আপনি বেঁচে থাকলে জানতে চাইতাম, নিজেকে মূল্য দিতে দিতে আত্মসর্বস্ব হয়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে মানুষ? গ্রেটা থুনবার্গ, সুইডিস বোন আমার, পৃথিবীটা সবুজ করে দাও, শ্বাস নেবার পরিধি বাড়িয়ে দাও, বোন।