খাবার বিল না দিয়ে নির্মলেন্দু গুণের দৌড়

যৌবনে নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: নাসির আলী মামুন
যৌবনে নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: নাসির আলী মামুন

নির্মলেন্দু গুণের পকেট সেদিন গড়ের মাঠ। এক কাপ চা ছাড়া সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি। খালি পেটে শুধু খুব কড়া, টোস্টেড টোব্যাকোর কিংস্টার্ক সিগারেট ফুঁকছেন। এর-তার কাছে ধার চাইলেন। হা হতোস্মি! ফলাফল শূন্য। শেষে বিকেলে এক প্রকাশকের কাছে প্রুফ দেখা বাবদ কিছু টাকা পেলেন। এতক্ষণ পেট জানান দিচ্ছিল ক্ষুধার কথা, টাকাটা হাতে পেতেই মন জানান দিতে শুরু করল লাভ আর লোভের কথা। একমুহূর্ত ভেবে দৌড়ালেন হাক্কার জুয়ার আড্ডায়। সেখানে চরকি ঘোরানো জুয়া চলে দিনরাত। চরকির সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে ভাগ্যের চাকা। ভাগ্যান্বেষী মানুষজনের কষ্টার্জিত টাকা এসে পড়তে থাকে জুয়ার পটে আঁকা মাছ, হাতি, ঘোড়া, ময়ূর ইত্যাদি আঁকা মার্কায়। গুণ ভাবছেন, টাকাটা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে পারলে ভালোই তো হয়! গেলেন এবং যা হয়—সর্বস্বান্ত হলেন। তাঁর ভাষায়, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বহু কষ্টে উপার্জিত টাকা মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে বিছানো হাক্কার জুয়ার পটের বাঘ-ভালুক-মাছ-মুরগি মিলে গিলে ফেলল।’

শূন্য হাতে বেরিয়ে এলেন জুয়ার আসর থেকে। গা কাঁপছে ক্ষোভে ও ক্ষুধায়। ক্ষোভ যদিও চেপে রাখা যায়, ক্ষুধা আর কতক্ষণ চাপবেন? কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় ‘দুষ্টবুদ্ধি’ চাপল একটা। ভাবলেন, আগে পেট পুরে খেয়ে নেবেন কোথাও, তারপর অন্য চিন্তা। বেছে বেছে ঢুকলেন খুব চালু এক হোটেলে। গোলাপ শাহ মাজারের ঠিক ওখানটাতে ছিল হোটেলটি। প্রচণ্ড ভিড়। ঠেলেঠুলে ঢুকলেন তার মধ্যে। বসে পড়লেন পছন্দমতো একটা জায়গা বেছে নিয়ে। তারপর পেট ভরে খেলেন ভাত-মাছ-ডাল। একসময় খাওয়া শেষ হলো। মুখ-হাত ধুয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোলেন বিল কাউন্টারের দিকে—বাইরের ভঙ্গি অতিসাবলীল। হাত মুছছেন...কাউন্টারের লোকটি তাকাল কবির দিকে। গুণের চোখ অবশ্য অনতিদূরের রাস্তায়। রাস্তার ডাক শুনতে পান, ‘আয় আয়।’ টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ততক্ষণে খাবার পরিবেশন করা ছেলেটিও চিৎকার করে সফলতার সঙ্গে বিল ঘোষণা করে। গুণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকান ছেলেটির দিকে, কাউন্টারের লোকটির দিকে। যেন এত বিল হতেই পারে না কোনোমতে।

তারপর?...তারপর আর কী! একবার আড়চোখে তাকিয়েই বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে মিলিয়ে গেলেন। পেছনে তখন ‘ধর ধর’ আওয়াজ আসছে সমস্বরে। গুণের ভাষায়, ‘তারা আমাকে কী বলবে...চোর বলবে? না, আমি তো চোর নই। ডাকাত বলবে? না, আমি তো ডাকাত নই। হোটেল থেকে খেয়ে পয়সা না দিয়ে যে দৌড় দেয়, তাকে কী বলা হয়, বাংলা ভাষায় তা নেই। আমি ভাষার সীমাবদ্ধতার ওই সুযোগটা উপরি হিসেবে পেয়ে যাই।’

পেছনে ‘ধর ধর’ আওয়াজ। গুণ তখন কী করছেন? তিনি নিজেও তখন দৌড়াচ্ছেন ‘ধর ধর ধর ধর’ বলে, যেন সামনে কাউকে তাড়া করছেন।

সামনে একটা দোতলা বাস ছুটছে। কোনোমতে উঠতে পারলেই হয়!

সূত্র: নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনী মহাজীবনের কাব্য


গ্রন্থনা: রাসেল রায়হান