নিঃসংকোচে দেওয়া মিথ্যে বচন

শ্রীরামকৃষ্ণ উবাচ—এসেছিস যখন দাগ রেখে যা।

জীবনভর ধরাছোঁয়ার বাইরে যাঁরা, তাঁরাও নেমে এসেছেন ধরাধামে। কার ধমনিতে কোন রক্ত—ওসব আজ ধর্তব্য নয়। ধনী, ধঞ্চে সমান স্মর্তব্য। কর্তব্য আজ ধনুর্ভঙ্গপণ। 

ভোটপ্রার্থীরাই এ যুগে সবচেয়ে বড় যশপ্রার্থী। গোঁ ধরেছেন—যে করেই হোক, দাগ রেখে যাবেন। এ জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। এ সময় ভুশণ্ডির কাকের বড় কদর। তিনি যার মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখবেন, সে এগিয়ে যাবে। প্রতিপক্ষ পিছিয়ে থাকবে কেন? সে–ও ছুটে আসবে। পাঁজাকোলে নিয়ে যাবে ভোটকেন্দ্রে। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হবে সেই ছবি। 

তীর্থের কাকের জন্য অন্য ব্যবস্থা। তাদের প্রতীক্ষা ফুরায় পাঁচ বছর পরপর। অগণিত চায়ের কাপের সঙ্গে দেদার ধোঁয়া ওড়ে। ল্যাটা খিচুড়ির মধ্যে বুড়ো গরুর হাড় লুকোচুরি খেলে। খাও-দাও-ধুয়া ধরো—বিলকুল ফ্রি। চাইলে পেটে-ভাতে পার্টটাইমও করতে পারেন। সকালে এ-প্রার্থী, বিকেলে অন্যজন। কে রাখে কার হিসাব! 

প্রার্থী কিন্তু হিসাবে একচুলও ভুল করতে চান না। এ কারণেই কুম্ভকর্ণও আজ চোখ রগড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কত রবি জ্বলে রে, কে-বা আঁখি মেলে রে... অলসপ্রাণও আজ ত্বরিতকর্মা। বিশ্বকর্মা স্বয়ং হতবাক! হচ্ছেটা কী?

নির্বাচন এলেই আমাদের দেশে প্রার্থীরা যোগ্যতার প্রমাণ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কণ্ঠে শোনা যায় সাম্যের গান। ভাবটা এমন—‘মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না?’

ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সমবেত নির্বাচনী সংগীত—‘একটা ভোট দিয়া যান, ভাইজান যোগ্য ইনসান।’ এ সময় প্রার্থীকেও গলা মেলাতে হয়; বাধ্য হয়েই। বেচারা নিজেই যে গলা পানিতে দাঁড়িয়ে! পাড়ে উঠতে হবে। তার জন্য আগে পেরে ওঠা চাই। ফলে ডিমপাড়া মুরগির মতো কক্কক্ শব্দে তিনি জানান দেন তাঁর গৌরব। তৈরি হয় সত্য-মিথ্যার ওমলেট। খেতে মজা কিন্তু পেট ভরে না। ফলাফল, ভোটারের ত্রাহিদশা! 

চতুর যাঁরা তাঁরা হয়তো এই সুযোগে প্রার্থীকে দিয়ে পিঠ চুলকে নেন। যিনি সাতে নেই, পাঁচে নেই, প্যাঁচেও নেই, তিনি থাকেন তফাতে। মনে না নিলেও, মেনে না নিয়ে তাঁর উপায় থাকে না। অগত্যা মনে মনে বলেন, ‘দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে দাগই ভালো।’ 

শত কথা ছাড়া নাকি বিয়ে হয় না। নির্বাচনের ক্ষেত্রে ওটা হবে প্রচার। ফলে কথামালা থেমে নেই; সব ওই বিজয়মালার জন্য। এ জন্য বিধিমালাও রয়েছে। বিধি ভঙ্গ করে কেউ শোকজ খাচ্ছেন, কেউ বিধুর হয়ে বিধির কাছেই দিচ্ছেন বিচার, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কই?’ 

সেই বিচিত্রবীর্যদের বলি, রেসে নেমে ওকথা বললে হবে? শেষ বাঁশি বাজার পর মাঠের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সুতরাং গো গো অ্যান্ড গো। পারলে দৌড়াও। এর আগে প্রত্যেক প্রার্থীর উচিত ‘ফরেস্ট গাম্প’ একবার দেখে নেওয়া। 

হ্যাঁ, ভোটপ্রার্থীরা দ্বারে দ্বারে দৌড়াচ্ছেন। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সেগুলো কানে মধু ঢালছে। তৎক্ষণাৎ স্মৃতির হেঁচকি জানান দিচ্ছে মগজে—ব্যাটা গতবারও একই কথা বলেছিল! 

রুখে দাঁড়াবেন? জিজ্ঞেস করলেই একগাল হেসে বলবে, তবেই ভাবুন, আমি কেমন ভদ্রলোক! আমার কথার নড়চড় হয় না।

এক্ষণে প্রশ্ন, নির্বাচন মানেই কি তবে নিঃসংকোচে দেওয়া মিথ্যা বচন? 

ভোটাররাও শিখে গেছেন বচন থেকে বাঁচার কৌশল। একবার এক প্রার্থী গণসংযোগে বেরিয়েছেন। যাকেই দেখছেন, সালাম দিচ্ছেন, জড়িয়ে ধরছেন, কুশল জিজ্ঞেস করে কৌশলে ভোট চাইছেন। তবে তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। বিদায় নেওয়ার আগে বারবার বলছেন, আপনার ভোট পাচ্ছি তো তাহলে?

সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে, হাতে ঝাঁকি দিয়ে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করলেও একজন বিব্রত কণ্ঠে বললেন, না মানে, আমি আসলে আপনার আগে একজনকে কথা দিয়ে ফেলেছি। 

শুনে প্রার্থী হেসে উঠলেন। আরে! তাতে কী হয়েছে? আপনি তো দেখছি এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছেন। রাজনীতিতে কথায় এবং কাজে অনেক ফারাক। কথা দিলেই রাখতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি?

এবার ভোটদাতা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, তাহলে আর চিন্তা কী! আমিও আপনাকে কথা দিলাম। 

নগরবাসীকে এখন প্রতি সেকেন্ডে ভোটপ্রার্থীর সালাম নিতে হচ্ছে। পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচার। হাই ভলিউমে হেভি মেটাল গানের সুরে ড্রামের তালে তালে চলছে সালাম বিনিময়। র​্যাপ সিঙ্গারদেরও বলিহারি। তাঁরাও শিখে গেছেন ছড়ার অন্ত্যমিল,Ñ‘ওপরে কাঁটা ভেতরে রস, অমুক আপার...।’ 

পাঠক, মার্কা অনুমান করে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। প্রতিভার এমন বিকট প্রকাশ নির্বাচনী প্রচারণাতেই সম্ভব। 

গোদের ওপর বিষফোঁড়া নির্বাচনের প্যারোডি গান। শুনলেই হৃদয়তন্ত্রীর সবগুলোর তারে হাহাকার বেজে ওঠে। গানেরও তবে সম্ভ্রমহানি সম্ভব!

অর্বাচীনের অত্যুক্তি বলে এড়িয়ে যাবেন, সম্ভব নয়। এ সব সম্ভবের দেশ। নইলে যাঁরা দূষণমুক্ত নগরীর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁরাই কেন দূষণের কারণ হবেন? 

দশ দিক ছেয়ে গেছে পোস্টারে। খোলা আকাশ ঢাকা পড়েছে। প্রার্থীরা ঝুলছেন। যদি টুপ করে পড়ে গিয়ে অক্কা পান! সুরক্ষা পেতে প্লাস্টিকে জড়িয়েছেন পোস্টার। নিজের বুঝ পাগলও বোঝে। তাঁরাই বা বুঝবেন না কেন? মাঝখান থেকে পরিবেশের দফারফা। দফায় দফায় শব্দদূষণের কথা ভুলে যান। 

খোসপাঁচড়ার মতো নগরীর দেয়ালের দুর্দশা আপাতত পোস্টারের নিচে চাপা পড়েছে। বাড়ির নেমপ্লেটও এই অত্যাচার থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অভিযোগ করলেই বেরিয়ে আসছে বিস্ময়ের জিভ—ছি ছি ছি, আমরা কেন এসব করব? সব প্রতিপক্ষের চাল। এরপরই তাল কেটে উল্টো দাবি—একবার ভোট দিয়েই দেখুন। নির্বাচিত হলে মহল্লায় এসব ডার্টি পলিটিকস দূর করে দেব। দেখে নেব সবকটাকে।

হুমকি না প্রার্থনা ঠিক বোঝা গেল না! এমন চরিত্রের একজন ভোটপ্রার্থীর নির্বাচনী জনসভা শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তিনি বলছেন, ভাইছাব, মেম্বার নির্বাচনে আঁর মার্কা আছিল চাক্কা। ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনে আঁর মার্কা আছিল সাইকেল। এইবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আঁই খাড়াইছি। আঁর মার্কা রিকশা। আঁরে আরেকবার ভোট দেন, আঁই যাতে ওই চাইর চাক্কার সরকারি জিপে চইড়তে হারি। যদি না হারি, তাইলে কী অইব আঁই জানি ন। 

সাধু সাবধান! প্রার্থী চিনতে ভুল করলে আপনাকেই পস্তাতে হবে। এ দেশে বিষয়টি দিল্লিকা লাড্ডুর মতো। চিনলে গুড, না-চিনলে নট ব্যাড। সুতরাং ভোট দিয়ে পস্তানোই ভালো। তা ছাড়া মহাপুরুষের কথা অগ্রাহ্য করা সমীচীন হবে কি? দাগ তো আপনাকেও রাখতে হবে। বুড়ো আঙুলের দাগ না হয় ব্যালট পেপারেরই রেখে এলেন। ও হলো নাগরিক দায়। দায় শোধ হলো, মুমূর্ষু গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও।