আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কেন আত্মহত্যা করেছিলেন?

>

হেমিংওয়ের বন্ধু ও জীবনীলেখক অ্যারন এডওয়ার্ড হোচনার। ছবি: সংগৃহীত
হেমিংওয়ের বন্ধু ও জীবনীলেখক অ্যারন এডওয়ার্ড হোচনার। ছবি: সংগৃহীত

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের পেছনে কি গোয়েন্দা লেগেছিল, তাই কি আত্মহত্যা করেছিলেন এই মার্কিন লেখক? প্রশ্নটির সুরাহা হয়নি আজও। এখনো কালজয়ী এ লেখকের আত্মহত্যা নিয়ে পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য। লিখেছেন মাসুদুজ্জামান

সে কী বিস্ময়কর মর্মন্তুদ ঘটনা। ১৯৬১ সাল। সারা পৃথিবীর মানুষ নোবেল পুরস্কারজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (২১ জুলাই ১৮৯৯—২ জুলাই ১৯৬১) আত্মহত্যা করেছেন জেনে হতবাক সবাই। এ রকমটা অবশ্য হওয়ারই কথা। যিনি পশুশিকার, মৎস্য শিকারের মতো অ্যাডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে সময় কাটাতেন, যিনি স্পেনের ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, লিখেছেন ফর হুম দ্য বেল টোল্​স, ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সির মতো জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস, সেই হেমিংওয়ে নিজের জীবন নিজের হাতেই নির্বাপিত করলেন।

তাহলে আমাদের রক্তের ভেতরে কি অন্য কোনো বিপন্ন বিস্ময় রয়ে গেছে, যার জন্য লাশকাটা ঘরে ঠাঁই করে নেওয়ার মতো পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি? হেমিংওয়ে আসলে কেন আত্মহত্যা করেছিলেন, তাই নিয়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন অর্থের টানাটানি ও অসুখী দাম্পত্যজীবন, কারও মতে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে আত্মহত্যা করেন কালজয়ী এই লেখক। হেমিংওয়ে-গবেষকদের একটা লক্ষ্য থাকে তাঁর আত্মহত্যা–রহস্য উন্মোচনের।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ছবি: সংগৃহীত
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ছবি: সংগৃহীত

হেমিংওয়েরই দীর্ঘদিনের বন্ধু অ্যারন এডওয়ার্ড হোচনার, হেমিংওয়ের জীবনীলেখক। ব্যক্তিগত জীবনে সম্পাদক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা। হেমিংওয়ের বেশ কিছু ছোটগল্প আর উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। হেমিংওয়ের জীবনের শেষ ১৩ বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে এই আত্মহত্যার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। হেমিংওয়েকে নিয়ে লিখেছেন দুটি বই, পাপা হেমিংওয়ে ও হেমিংওয়ে অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ল্ড। হোচনার বলছেন, মূলত দুটি কারণে হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রথমত, তিনি মনে করেছিলেন যে তাঁর সৃষ্টিশীলতার সোনালি দিন আর নেই। সেইভাবে তিনি আর ফর হুম দ্য বেল টোলস অথবা দ্য সান অলসো রাইজেস–এর মতো উপন্যাস আর লিখতে পারছেন না বা পারবেন না। হোচনারের কাছেই হেমিংওয়ে তীব্র মনোবেদনা নিয়ে বলেছেন, লেখক হিসেবে তাঁর যে মিশন ছিল, সেটা তিনি আর পূর্ণ করতে পারবেন না। অথচ একজন লেখক লেখালেখি থেকে অবসর নেবেন অথবা লেখালেখি করবেন না, তা–ও তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। একজন লেখক লেখালেখিতে বিরতি দেবেন বা রিটায়ার করবেন, এটা হেমিংওয়ে ভাবতেই পারতেন না।

হোচনার, হেমিংওয়ের এই জীবনীলেখক, হেমিংওয়ের সঙ্গে তাঁর লেখালেখি নিয়ে যে আলাপ হয়েছিল, সে কথা স্মরণ করেছেন নিজের বইয়ে, ‘দেখো, একজন বেসবল খেলোয়াড় কিংবা পুরস্কারজয়ী একজন বুল ফাইটারের মতো একজন লেখক অবসর নিতে পারেন না। লেখকের প্রতিভা নিঃশেষ হয়ে গেছে, এটা কেউ মেনে নিতে চান না। যেখানেই লেখক যান, সেখানেই সবাই তাঁকে একটা প্রশ্ন করে, ‘কী লিখছেন এখন?’

আত্মহত্যার পেছনের দ্বিতীয় কারণটি আরও ভয়াবহ। কি বাড়িতে, কি গাড়িতে, সর্বক্ষণ হেমিংওয়ের পেছনে এফবিআইয়ের ফেউ লেগে থাকত। ফেউ মানে গোয়েন্দারা তাঁকে অনুসরণ করতেন। ফেউতাড়িত হেমিংওয়ের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে এফবিআই গুপ্তহত্যা করে তাঁকে মেরে ফেলতে পারে। হোচনার এ প্রসঙ্গে ইডাহোর একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিন বন্ধু হোচনার, ম্যাকমুলেন ও হেমিংওয়ে পাখি শিকারে যাবেন। কিন্তু ফোনে কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। সর্বত্রই মার্কিন গোয়েন্দারা তাঁদের নানাভাবে অনুসরণ করছিলেন। ফোনে আড়ি পাতছিলেন, কথাও বলা যাচ্ছিল না। ডাকে পাঠানো চিঠিপত্তরের ওপরও নজরদারি করছিলেন তাঁরা।

কথা ছিল হোচনার পৌঁছালে আরও দুই বন্ধু মিলে একটা রেস্তোরাঁতে গিয়ে খাবেন। কিন্তু হেমিংওয়ে গাড়িতে উঠতে ইতস্তত করছিলেন।

হোচনার জিজ্ঞেস করলেন: ‘কী হয়েছে, তোমার আপত্তি কেন?’

হেমিংওয়ে: ‘ওই দেখ, ফেডস্ (এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা)।’

‘কী বলছ?’

‘তাঁরা আমাদের সব সময় অনুসরণ করছেন।’

‘হুম... আমাদের গাড়ির পেছনে আরেকটা গাড়িকে দেখতে পাচ্ছি।’

‘কিন্তু কেন তাঁরা তোমাকে অনুসরণ করেন?’ হোচনার জিজ্ঞাসা করলেন।

 ‘জীবন বিষময় হয়ে উঠছে, সর্বত্র তাঁরা আমাকে অনুসরণ করছেন। সবকিছু, এমনকি আমি ফোন পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারি না, চিঠিপত্রও খুলে পড়েন।’

পাপা হেমিংওয়ে–এর প্রচ্ছদ
পাপা হেমিংওয়ে–এর প্রচ্ছদ

সারা রাস্তা সবাই নীরবে গাড়িতে বসে আছেন। পথিমধ্যে একটা ব্যাংকে ঢুকলেন হেমিংওয়ে। দুজন অডিটর তখন ব্যাংকে কাজ করছিলেন। হেমিংওয়ে বললেন, ‘ওই যে দেখো গোয়েন্দারা আমার অ্যাকাউন্টের ওপর নজরদারি করছেন।’

হোচনার বললেন, ‘কী করে জানলে তুমি যে তোমার অ্যাকাউন্টই খতিয়ে দেখছে?’

‘অবশ্যই তাঁরা আমার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে দেখছেন। না হলে এই মধ্যরাতে অডিটরদের কী কাজ থাকতে পারে?’

শুধু সেবারই নয়, হেমিংওয়ের সঙ্গে হোচনারের শেষবার যখন দেখা হয়, তখনো এমনটাই ঘটেছিল। সেবার আরেকটা রেস্তোরাঁতে স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে আর হোচনারের সঙ্গে ডিনার করছিলেন হেমিংওয়ে। তাঁদের টেবিলের উল্টো দিকে খাবার খাচ্ছিলেন দুজন লোক। খাবার অসমাপ্ত রেখেই সবাইকে নিয়ে রেস্তোরাঁটা ত্যাগ করেন তিনি।

গোয়েন্দাগিরির এ বিষয়টি হেমিংওয়ের জীবনযাপনকে অস্বাভাবিক করে তুলছিল। তিনি মানসিকভাবে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। মেরি নিজেই এই কথাগুলো হোচনারকে বলেছিলেন। হেমিংওয়ে, তাঁর স্বামী কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন আর স্ত্রী হিসেবে তিনি হেমিংওয়ের এই মানসিক বৈকল্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওই ঘটনার এক মাসের মাথায় হেমিংওয়ে মিনেসোটার রচেস্টারের একটা হাসপাতালে মনোরোগের চিকিৎসা করানোর জন্য ভর্তি হন। এ সময় জনতার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার জন্য হাসপাতালে তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। হাসপাতালে হেমিংওয়েকে এগারোবার বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। বরং হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তাঁর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।

এরপর দুবছরও যায়নি, মাথায় শটগান ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। অবসান ঘটে যায় এই পৃথিবীতে সুন্দরভাবে যাপিত নানা ধরনের অন্তর্গত জটিলতায় আক্রান্ত এক মহান লেখকের।

তাঁর মৃত্যুর পেছনে কতটুকু হাত ছিল এফবিআইয়ের, নাকি লিখতে না পারার হতাশা তাঁকে গ্রাস করেছিল, এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। এর উত্তর পাওয়া যায় এফবিআইয়ের কাছ থেকে পাওয়া একটা ফাইল থেকে। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জেফ্রি মেয়ার্স ফ্রিডম অব ইনফরমেশন আইনের আশ্রয় নিলে এফবিআই এই ফাইল ১৯৮৩ সালে তাঁর হাতে তুলে দেয়। মেয়ার্সই জানিয়েছেন, হেমিংওয়ে তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা ঘনিষ্ঠজনদের কাছেও বলেননি। অথচ এসব ঘটনা অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।

হেমিংওয়ে অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ল্ড বইয়ের প্রচ্ছদ
হেমিংওয়ে অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ল্ড বইয়ের প্রচ্ছদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছে। কিউবার রাজধানী হাভানায় হেমিংওয়ে। হাভানায় অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্পারিলে বারডেনের সঙ্গে যুক্তি করে একটা পরিকল্পনা আঁটলেন। সেটা হলো কিউবাতে অবস্থিত যেসব স্প্যানিশ নাগরিক ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কো সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাঁদের ওপর নজরদারি করা। হেমিংওয়ে এই কাজের জন্য ‘দ্য ক্রুক ফ্যাক্টরি’ নামে একটা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন। সেখানে যেসব গুপ্তচরকে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাঁরা অন্য মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে হেমিংওয়ের কথামতো কাজ করতেন। হেমিংওয়ে প্রকৃতপক্ষে কার পক্ষে কী কাজ করছেন, সেটা অজানাই থেকে যেত। হেমিংওয়েকে মার্কিনরা মাসে এক হাজার ডলার বেতন দিত এবং তিনি বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তেল পেতেন, যুদ্ধের সময় যা ছিল দুর্লভ।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেমিংওয়ের এই গুপ্তচরবৃত্তিকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই মনে করত তিনি কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন লেখক। ফলে তাঁর গুপ্তচরবৃত্তিকে সন্দেহের চোখে দেখত তারা। পাঠানো রিপোর্টকে গুরুত্ব দিত না। উল্টো এফবিআই ভেতরে ভেতরে হেমিংওয়ে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। একবার তিনি একটা রিপোর্ট পাঠান যে কিউবার জলসীমায় শত্রুপক্ষের একটা সাবমেরিন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন নৌবাহিনী থেকে যখন নিশ্চিত করা হলো এ রকম কিছু ঘটেনি, তখন হেমিংওয়ের গুপ্তচরবৃত্তির কাজটি তারা বন্ধ করে দেয়। স্প্যানিশ রিপাবলিকানদের সঙ্গে হেমিংওয়ের সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল, সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। হেমিংওয়ে আগাগোড়া ছিলেন ফ্যাসিস্টবিরোধী কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন একজন লেখক। কিউবার কার্যক্রমকে তিনি সমর্থন করতেন। কিউবার সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক আছে বলে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী মনে করত। এমনকি কিউবাতে যেসব স্প্যানিশ নাগরিক ছিলেন, তাঁরা যাতে ফ্রাঙ্কো সরকারের সঙ্গে মার্কিন সরকারের সম্পর্কটাকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলতে না পারেন, তিনি তাতে বাধা দেওয়ার লক্ষ্যেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেন। হেমিংওয়ের জীবনীলেখক জে এডগার হুভার ওই সময়ে হেমিংওয়ে আসলে কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর অবস্থান কোথায় ছিল, তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি প্রমাণ পেয়েছেন হেমিংওয়ের ফোনে আড়িপাতা হতো, চিঠিপত্র খোলা হতো, এমনকি তিনি যখন হাসপাতালে তখনো তাঁর টেলিফোনে আড়ি পাততেন এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা। মার্কিন গোয়েন্দাদের ফাইল এবং অন্যান্য দলিলপত্র পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে হোচনারসহ হেমিংওয়ে গবেষকেরা এভাবে উপসংহার টেনেছেন যে তাঁর মানসিক বিকার তৈরিতে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর ঘটনা বড় রকমের ভূমিকা রেখেছিল। এই ভূমিকা একজন সংবেদনশীল লেখকের জীবনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য ছিল যথেষ্ট। ঘটেছেও তা–ই। জীবনঘনিষ্ঠ লেখক হিসেবে খ্যাতি পেলেও ব্যক্তিগত হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেন।


সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ভিনটেজ নিউজ, হিস্ট্রোরি ওয়ান জিরো ওয়ান, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস