বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে হিন্দি উপন্যাস

ম্যায় বরিশাইল্যা–এর লেখক মহুয়া মাজি। ছবি: সংগৃহীত
ম্যায় বরিশাইল্যা–এর লেখক মহুয়া মাজি। ছবি: সংগৃহীত

মহুয়া মাজি বড় হয়েছেন রাঁচিতে, একসময়ের বর্ধিষ্ণু বাঙালি পরিবারের অবকাশ ও স্বাস্থ্যোদ্ধারের স্থান, অধুনা ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী। তিনি লেখেন হিন্দিতে। তবে তাঁর শিকড় এই বাঙাল দেশেই—ঠাকুর্দা নগেন্দ্র ঘোষ ঢাকার মানুষ, আর মায়ের বাবা কার্তিকচন্দ্র ঘোষ, তাঁর ভাষায়, ‘বরিশাইল্যা পোলা’। দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ ছাপিয়ে ভারতের পশ্চিম ও উত্তরের নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন উদ্বাস্তু বাঙালি—যাঁদের শিকড় এই বাংলাদেশে। তেমনই এক শিকড়বিচ্ছিন্ন ভাগ্যবিড়ম্বিত পরিবারের কন্যা মহুয়া আশৈশব বহুশ্রুত তাঁরই পূর্বপুরুষ নিকটজনদের গৌরবময় অর্জন বাংলাদেশ নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। হিন্দিতে বইটির নাম ম্যায় বরিশাইল্যা। এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে অবস্থিত বিনোবা ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের রিডার রাজেশ কুমার। নিজেও তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন, হিন্দি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদও করেন। ইংরেজিতে বইয়ের নাম মি. বরিশাইল্যা।

প্রায় পাঁচ শ পৃষ্ঠার উপন্যাস শুরু হয়েছে গত শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ায় বা একটু আগে জন্ম নেওয়া এক বরিশাইল্যা পোলাকে নিয়ে, যা বিস্তৃত হয়েছে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুবিরোধী আগুন ও ধ্বংসের বর্ণনায়। শুরুও হয়েছে বারো বছরের শিশুর স্বচক্ষে দেখা দাঙ্গার বীভৎস আক্রমণ, নরহত্যা ও আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলেপুড়ে ছাই হওয়া বাস্তুভিটার বর্ণনা এবং তারই প্রত্যাঘাতে সৃষ্ট আস্থা-বিশ্বাসের সংকট নিয়ে। শেষও হয়েছে সেই একই রকম সন্ত্রাস একই রকম ঘটনা ও দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির অভিজ্ঞতা দিয়ে। তখন স্বভাবতই ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার দাবাখেলার ঘুঁটি হিসেবে সামান্য ব্যক্তিমানুষের জীবনের দুঃখবেদনার অসারতা-অসহায়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

উপন্যাসের নায়ক কেষ্ট ঘোষ ইতিহাসের ফেরে পাকিস্তানের নাগরিক। সংখ্যালঘুর বিড়ম্বনা সে দেখেছে, সয়েছে, কিন্তু বডি বিল্ডিংয়ে প্রদেশসেরা হয়ে বরিশালের সামান্য ছেলে কেষ্ট আক্ষরিক অর্থে কেউকেটা না হলেও বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান মজবুত করতে সক্ষম হয়। মাঝেমধ্যেই ঢাকায় এসেছে বডি বিল্ডিংয়ের প্রতিযোগিতার সূত্রে, তাতে ঢাকায় মুসলিম বন্ধুবান্ধবও জুটেছে। পঞ্চাশের পরে চৌষট্টির দাঙ্গা তাকে একটু নাড়িয়ে দিলেও ভারতে এসে কেষ্ট বুঝেছে জীবন সেখানেও সহজ নয়। তা ছাড়া পঁয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ছয় দফার সূত্রে সারা বাংলা তো মেতে ওঠে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগে। বন্ধুদের সূত্রে সে–ও এতে যুক্ত হয়ে যায়। রাজনীতি তার নিজের চর্চার বিষয় না হলেও উনসত্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সব বাঙালি বাংলাদেশের আন্দোলনে শরিক হয়েছিল, সবার অন্তরজুড়ে একই রাজনীতির ভাবাবেগ—বাঙালি জাতীয়তাবাদ। কেষ্ট তার ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখেনি, ঘটনা পরম্পরায় ঢাকায় অবস্থানকালে বন্ধুদের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে চলে যায় আগরতলা। বাড়ির চিন্তা, মা এবং ছোট ভাইবোনদের ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যেও তারা কেউই বাড়ির খবর নেওয়ার সুযোগ পায়নি। বডি বিল্ডার কেষ্টর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম লেখাতে কোনো কষ্ট হয়নি। একসময় নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে দেশ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে যেটুকু সংশয় অনীহার ছায়া পড়ত জীবনে, তা নবজাগ্রত মুক্তির চেতনার আলোয় ধুয়েমুছে যায়। কেষ্ট প্রশিক্ষণ নেয়, নিজের যোগ্যতায় দলনেতা হয় এবং দ্রুতই গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

মহুয়া একটি ট্যাগলাইন ব্যবহার করেছেন উপন্যাসের নামের সঙ্গে—‘দ্য এপিক সাগা অব দ্য রাইজ অফ বাংলাদেশ’, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহাকাব্যিক কাহিনি। লেখক এই কাহিনিটি সবটা বুঝে, অনুভব করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এখানে তাঁর চিন্তা যেমন কাজ করেছে, তেমনি হৃদয়ও ছিল সক্রিয়। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সাজিয়ে মর্মে গেঁথে তিনি উপন্যাসটা তৈরি করেছেন। কিছু কথা বহুবার শোনা, কিছু গল্পে ডালপালা আর অতিশয়োক্তির ভয় থাকলেও তাঁর বিবেচ্য ইতিহাসের বাস্তবতা কল্পনাকেও হার মানায় বলে আলাদা করে কল্পনার আশ্রয় তাঁকে নিতে হয়নি। বিভিন্নজনের মুখের ভাষ্য, প্রচুর পঠনপাঠন, গবেষণা আর পুরো বিষয়টাকে নিজের ভেতরে বুদ্ধিতে-হৃদয়বৃত্তিতে ধারণ করার চ্যালেঞ্জ ভালোই সামলেছেন তিনি। বইটি তাড়াহুড়োর রচনা নয়, সময় নিয়ে একটি অঞ্চলের নতুন একটি সত্তায় জেগে ওঠার কাহিনি বুনতে কয়েক বছর সময়ে লেগেছে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন সফল মানুষ ও সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে রাজনীতি ও সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটে এ দেশের অভ্যুদয় দেখা ও বোঝার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এটাও ঠিক দেশভাগের পর ছয় দফাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে না ওঠা পর্যন্ত এবং বাংলাদেশ আমলে পঁচাত্তরের পর থেকে প্রায় ২০০৬ পর্যন্ত এ দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবনে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সাম্প্রদায়িকতার যে ধরনের চাপ ছিল, তা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী তেমনভাবে উপলব্ধি করেনি। ভুক্তভোগীদের প্রতি যথাযথ সহমর্মিতা জানায়নি। অনেকেই কেবল তাদের ভারতমুখী চিন্তার খোঁচাটা দিয়ে থাকে, কিন্তু মানুষ কেন কোন পরিস্থিতিতে নিজের চৌদ্দপুরুষের বসতভিটা ফেলে অজানার পথে পাড়ি দেয়, তা বোঝার সংবেদনশীলতার অভাব পীড়াদায়ক। একশ্রেণির বর্ণহিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তার বিভাজনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে থাকতে চাননি, তাঁরা সাতচল্লিশের আগে-পরে দ্রুতই দেশত্যাগ করেছেন। কিন্তু তারপরে দীর্ঘকাল ধরে যে নীরব বিচ্ছিন্ন দেশত্যাগ তার পেছনে কাজ করেছে জমি, পুকুর, বসতভিটা অর্থাৎ সহায়সম্পদের প্রতি ক্ষমতাবান প্রতিবেশীর লোভ। কেউ তাড়িয়ে দখল করেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যাতে মানসম্মান আর বিশেষভাবে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সংখ্যালঘুদের অগত্যা দেশ ছাড়তে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে বাস্তববুদ্ধি থেকেই তাঁরা পাকিস্তান বা জিয়া-খালেদার ‘মিনি পাকিস্তানি’ বাংলাদেশের ওপর শতভাগ ভরসা করতে চাননি, পরিবার ভেঙে দুভাগ করে দুই দেশে ভাগাভাগি করে থাকলেন। বাবরি মসজিদ-পরবর্তী ঘটনা, এবং তারও চেয়ে বেশি ২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার পর এটিই এ দেশে শেষ সম্বল আঁকড়ে থাকার একমাত্র কার্যকর মাধ্যম মনে হয়েছে।

এই দেশে বাস না করেও মহুয়া এর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে ভালোই জানেন। আর উপন্যাসের প্রয়োজনে ইতিহাসের বাঁক এবং গ্রন্থিগুলো ভালোভাবেই জেনে নিয়েছেন। তা ছাড়া আপনজনদের কাছ থেকে যাপিত জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ান তো শৈশব থেকেই শুনে এসেছেন।

এই মহাকাব্যিক কাহিনিতে বর্ণিত ইতিহাস এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং এতই ঘটনাবহুল, আবার সেসব ঘটনা এতই নাটকীয়তায় ভরপুর এবং তাতে এতই গতিময়তা যে মূল প্রবক্তার বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তিমানুষের পক্ষে বেশি জায়গাজুড়ে দাঁড়ানো সহজ নয়। ইতিহাসের যাত্রাপথে মহৎ এবং নগণ্য অনেক ধরনের মানুষেরই সমাগম ঘটেছে কিন্তু তাদের সঙ্গে নায়কের সম্পর্ক সব সময়ই অনিবার্য নয়। কেষ্ট ঘোষের জীবনে নারী এসেছে, তার মনে প্রেমের আবেগ উদ্বেলিত হয়েছিল, কিন্তু ঘটনা যেন ইতিহাস-সমুদ্রের তটরেখায় মুহুর্মুহু আছড়ে পড়েছে, যার ফলে নায়কের পক্ষে ব্যক্তিগত জীবন ঘিরে আপন বলয় তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসই এই উপন্যাসের নায়ক, তার অসংখ্য অভিযাত্রীর মধ্যে কেষ্ট হয়তো মধ্যমণি—এটুকু। আর  বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে তার মতো মানুষের অবদান সত্ত্বেও যে ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে সৃষ্ট দেশটি ভেঙে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা হলো, সেই অঙ্গীকারের লজিক তো মেলে না। কেষ্টর জীবনের মাধ্যমে ইতিহাস কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হলো।

এক যাত্রায় আপাতত সাধারণ মানুষ কেষ্টর বিশিষ্ট মানুষ হয়ে ওঠা, আবার পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা রূপে উঠে দাঁড়ানো, একাধিক অভিযানে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন, বিজয়ের সাক্ষী হতে পারা—এসব তো বক্তির জীবনে কম প্রাপ্তি নয়। তার আত্মত্যাগের বহরও অনেক বড়। মায়ের কোনো খোঁজ আর সে পায়নি, ছোট ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, বড় আদরের ছোটবোন পুরো নয় মাস পাকিস্তানি নরপশুদের বাঙ্কারে পাশববৃত্তির শিকার হয়েছে। সে হয়তো ভাইয়ের কাছে ফিরতে পারত, কিন্তু এক বুক অভিমান আর এক পৃথিবী লজ্জার মুখে আত্মঘাতী হয়ে সুযোগটা সে ফিরিয়ে দিল। যুদ্ধজয়ের পর বোনের পরিণতির জন্য দায়ী এলাকার শান্তি কমিটির নেতার ওপর বদলা নিয়েছে কেষ্ট, কিন্তু শেষ লড়াইয়ে দাম চুকিয়েছে নিজের পা দুটি হারিয়ে। শেষ পর্যন্ত পঙ্গু, হুইলচেয়ারে বন্দী একলা মানুষ কেষ্ট তারই মতো ভাগ্যাহত তরুণ বিশুর সহায়তায় আটার কল চালিয়ে জীবন নির্বাহে মনোযোগী হয়। ইতিহাস-নায়ক কি তাকে এটুকু স্বস্তি দিল? না, বিরানব্বইয়ের আগুন সেটাও গ্রাস করল, উন্মত্ত মানুষ তাকে ছুড়ে মারল রাস্তায়। মুক্তিযোদ্ধা কেষ্ট তার জীবনপ্রবাহের কোনো সদুত্তর দিতে পারে না, কেবল রেখে যেতে পারে প্রশ্ন, জীবন কি কেবল অতৃপ্ত অনিঃশেষ আগুনের সমাহার? আর কিছুই নয়?

বাংলাদেশকেই এর উত্তর দিতে হবে। সে উত্তর মুখের কথায় নয়, বাস্তবে অসাম্প্রদায়িক উদার মানবিক সমাজ গড়ে, তাতে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হলে তবেই কেষ্টর মর্মান্তিক প্রশ্নের জবাব মিলবে।