নো তাড়াহুড়া

তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। কিছুতেই নয়। যতই তাড়া থাক। পরীক্ষার সময় তো নয়ই, অন্য কোনো সময়ও নয়। ঝামেলা সব ওই তাড়াহুড়ার সময়েই হয়। সেই দিনই আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এইটে মানে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই। স্কুলেই খবর পেলাম, নানি ঝিনাইদহ যাচ্ছেন। মামার শ্বশুরবাড়ি। মামার শ্বশুর মারা গেছেন। নানি আমার জন্য অপেক্ষা করলেও ট্রেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে না। তাড়াহুড়া করে বইগুলো নিয়ে বের হচ্ছি, ঠিক তখনই অঙ্ক স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। আমার অঙ্কভীতির কথা তিনি ভালো করেই জানেন। নিশ্চয়ই ভাববেন, পালাচ্ছি। অগত্যা বসেই পড়লাম।     

স্যার সরল অঙ্ক শুরু করলেন। সবকিছু সরলভাবেই চলল। যত অস্থিরতা আমারই।       

অবশেষে ঘণ্টা পড়ল। সরল অঙ্ক সারা হলে শুরু হলো চলিত নিয়ম। এটাও চলিত নিয়মেই চলতে থাকল!

প্রতিদিন ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসান স্যার ঝড়ের বেগে চলে যান। আজ কেন এত জড়তা, বুঝতে পারলাম না। কাতর হয়ে বলেই ফেললাম, ‘স্যার, ঘণ্টা পড়ে গেছে তো!’    

: হুম! অঙ্কটা বুঝতে পারছিস তো?   

: হ্যাঁ, স্যার।   

ঝট করে বলে ফেললাম। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধুই পাঁচ। অঙ্কের প্যাঁচ বোঝার মতো অবস্থা নেই। পাঁচটায় নানির ট্রেন!    

‘আয় দেখি। বাকিটুকু তুই–ই কর।’ চকটা হাতে ধরিয়ে দিলেন স্যার। সবাই মুখ টিপে হাসছে। শেষরক্ষা করল বাবু। ইজ্জত ও সময় দুটোই।  

‘স্যার, ওর নানা মারা গেছে। বাড়ি থেকে খবর পাঠাইছে; তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য।’  

: আগে বলিসনি কেন! যা যা, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যা।

চোখ টিপে হাসল বাবু। আস্তে করে বলল, ‘বিকেলে আসিস। ফুটবল খেলব।’ 

সায় দিয়ে লাগালাম ছুট। আগে খালেকের সাইকেলটা নিতে হবে। তাই বাজারের পথ ধরলাম। ছয় মাইল পথ হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। এর আগে নদীতে গোসল, লাফঝাঁপ, সাঁতার কাটা, গভীরে ডুব দিয়ে বালু তোলা, কত কী। ক্লাসেও কি বসে সময় কাটে! তাই যাওয়ার সময় যে গতি, ফেরার সময় আর তা থাকে না। বাজারে গিয়ে দেখি, খালেক দোকানে নেই। তাকের দিকে তাকাই, সারি সারি কাপড় সাজানো। দোকান হাঁ করে খোলা। হাহাকার করছে যেন। অনর্থক এতটা পথ ঘুরলাম! এখন অপেক্ষা করব, নাকি দৌড়াতে শুরু করব? সিদ্ধান্ত নিতেই কেটে গেল অনেকটা সময়।        

তক্ষুনি হাত চাটতে চাটতে বের হয়ে এল খালেক ভাই। তাকের পেছন থেকে। দোকানে বসেই ভাত খাচ্ছিল! কে জানত?    

বললাম, ‘সাইকেলটা লাগবে...।’ 

সব শুনে খালেক ভাই বলল, ‘যাও যাও, তাড়াতাড়ি যাও। তয় হাত–পাও ভাইঙ্গ না।’

সাইকেল ছোটালাম তড়িঘড়ি করে। ঘড়ি নেই। কটা বাজে জানার সুযোগও নেই। দুপাশে খানাখন্দে ভরা কাঁচা রাস্তা। আমিও সাইকেল চালনায় কাঁচা। 

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আবার হাসান স্যার! সেই গুরুগম্ভীর ভঙ্গি। কখনো হাসেন না, বাঘের মতোই। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু ক্লাসে বলা তাঁর কথাটা মনে পড়ে গেল, ‘আজকালকার ছেলেগুলো বড় বেয়াদব! শিক্ষকদের সম্মান দিতে চায় না। সামনে দিয়ে শাঁ করে সাইকেল চালিয়ে চলে যায়। নেমে সালামটা পর্যন্ত দেয় না...!’     

নেমে সালামটা দিতে গিয়েই সর্বনাশটা হলো। পড়ে গেলাম, খাদের মধ্যে। আমার ওপর থেকে স্যারই টেনে ওঠালেন সাইকেলটা।

: বেকায়দা জায়গায় নামতে হবে কেন! সাইডে

জায়গা ছিল, চালিয়ে চলে যেতে পারতি। ব্যথা পাসনি তো? 

‘জি না, স্যার।’ কবজিটা চেপে ধরে বললাম।   

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’

স্যার যা ইচ্ছে ভাবুন। দ্রুত পালিয়ে বাঁচি। ওদিকে নানি নিশ্চয়ই রেডি হয়ে বসে আছেন। জরুরি সময়ে ট্রেন লেট করে না। বাড়ির কাছে মোড়টা ঘুরতেই বাবুর সঙ্গে দেখা। স্কুল থেকে ফিরে, খাওয়াদাওয়া সেরে বল নিয়ে নদীর ধারে যাচ্ছে। বলল, ‘কি রে, এত দেরি করলি যে? গাধা নাকি তুই!’  

কী বলব! ততক্ষণে কথা বলার শক্তি লোপ পেয়েছে আমার। বাড়ি এসে দেখি, ঘরে তালা। খিদেয় অস্থির। বইপত্র ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। ছোট্ট ডেকচিতে ভাত রান্না করা আছে। তরকারি রাঁধার সময় পাননি নানি। উপকরণ সবই আছে। নেই শুধু শিল্পী রানী; রন্ধনশিল্পী নানি। খোকার বউ কল চেপে পানি নিয়ে যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলল, ‘ইবার দ্যাহা যাবিনি...।’ তাঁর কথায় কান দিলাম না। যার নানি নাই, সে কি ননীর পুতুল? ভাত না খেয়ে থাকে? একটা পাত্রে জলে ভেজানো দুটো গোল বেগুন। বাহ্! নাতির ওপর নানির অগাধ আস্থা। আমি বেগুনভর্তা পছন্দ করি, সেটা নানি ভালো করেই জানেন। তাই বেগুন দুটোকে আমার জন্যই জলাঞ্জলি দিয়ে গেছেন। বেগুনভর্তা না করতে পারার মতো এতটা বেগুণ আমি নই। কিন্তু ওতে সময় লাগবে। আরও শর্টকাট কিছু চাই আমার। ডিম পাওয়া গেল। এটা সেদ্ধ করতে পারি। অকম্মার ডিমেরাও ডিম সেদ্ধ করতে পারে। কিন্তু আরও সহজ কিছু চাই। বুদ্ধিও পেয়ে গেলাম; ডিম পোচ। রন্ধনপ্রক্রিয়া অতীব সরল। রুটি সেঁকা তাওয়াটা চুলায় চাপালাম। এবার অগ্নিপরীক্ষা! পাটকাঠিতে আগুন জ্বালতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। তাওয়াটাও সহজেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল। আন্দাজমতো তেল দিলাম। এবার হবে ডিম পোচ! ডিমটা ঠুক করে ভেঙে দিলাম ছেড়ে, গরম তেলে।  আগুনটা বড্ড বেয়াড়া! দপ করে তাওয়ার তেলে ধরে গেল। একেবারে দাউদাউ করে! আমিও দমবার পাত্র নই। খুন্তিটাকে আঙটায় ঢুকিয়ে দিলাম এক টান। তাওয়া নেমে এল। কিন্তু ডিমটা এল না! সাঁৎ করে চুলার মধ্যে ঢুকে পড়ল! পেটের আগুনে ঢোকার আগেই চুলার আগুনে আত্মাহুতি দিল!     

প্রচণ্ড খিদেয় কান্না পেল। হাউমাউ করে কাঁদলেও লজ্জার কিছু নেই। নির্জন বাড়ি। কেউ শুনতে পাবে না। পেঁয়াজ–মরিচ কাটার মতো ধৈর্যও আর অবশিষ্ট নেই। শুধু নুন দিয়ে ভাত মেখে গিলে নিলাম খানিকটা। এবার গৃহপ্রবেশ। সেটাও খুব সহজ কর্ম নয়। জানালা ধরে ঝুলে ঝুলে লুজ শিকটা খুললাম। তারপর সংকীর্ণ ফাঁকা দিয়ে দেহটা বাঁকিয়ে সাপের মতো করে ঢুকে পড়লাম ঘরে। ঢুকতেই বাড়ি পড়ল নাকে। গন্ধ! সঙ্গে সঙ্গে জল এসে গেল। চোখে নয়, জিবে! টেবিলে সব খাবার সাজানো! কিন্তু পেটে আর খিদে বলে কিছু নেই। ভাত–তরকারি পড়ার টেবিলেই পড়ে রইল। হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই দিনের বেলায়ও! নানির তরকারির রং তো লাল হয় না কখনো! তাহলে কে খাবার সাজিয়ে রেখে গেছে? পরিষ্কার করে গোছানো টেবিল, বিছানা। বিছানা পেয়ে সব ভুলে গেলাম। ধপাস!           

শোয়ামাত্রই খুট করে আওয়াজ হলো। কে যেন ঘরে ঢুকল! চোখ বুজে পড়ে থাকলাম।  

‘হায় হায়! কিছুই তো খাও নাই!’ জুলেখার গলা। প্রতিবেশীর মেয়ে।

‘ঘরে তালা দিয়ে গেছ কেন?’ শান্তভাবেই বললাম।   

: তালা দিই নাই তো। শুধু ঝুলায় রাখছিলাম। টান দিলিই খুলে যাইত।  

: ভালো করছ।  

: দাদিজান তুমার খাবার দিতি কয়া গেছেন। ঘরদোর গুছায় থুয়ে বাড়ি গিছলাম। গোসল করতি। খাও নাই ক্যা?

দরজায় আরেকজন এসে দাঁড়াল। খোকার বউ। বলল, ‘আমি তো কলাম, ইবারকার মতো খান। রাতির বেলা দেহা যাবিনি। দাইজান রানতি
কয়া গেছেন। বারবার কইছেন, ও যিনি রান্নাঘরে না ঢোকে।’     

এবার বুঝতে পারলাম, আমার প্রতি নানির কতটা আস্থা! তাই দুজনকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন।  

এরপর আর কখনো আমার রান্না করার সাহস হয়নি। উপোস থাকলেও না। 

আর তাড়াহুড়া? একদম নয়।