সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি

একসময় আমরা যারা বামপন্থী রাজনীতি করতাম, শুধু তাদের কাছেই নয়, কবিতাপ্রেমী প্রায় সবার কাছেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এক অবশ্যপাঠ্য কবি। তাঁর কবিতাগুলো ছিল বহুল পঠিত। এমনকি তাঁর অসংখ্য কবিতার পঙ্‌ক্তি প্রবাদের মতো উচ্চারিত হতো। বিশ শতকের ছয়ের দশকে আমাদের আঙুলে গোনা যে কজন আবৃত্তিকার ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই কণ্ঠে আবৃত্ত হতো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কোনো না কোনো কবিতা। পাঠ করা হতো ঘরোয়া আসরেও। বস্তুত, দুই বাংলাতেই তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয় কবি।

এমন যে কবি, সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মতিউর রহমানের সম্পাদনায় সম্প্রতি বের হয়েছে শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি নামে একটি অনিন্দ্য সংকলন। এটি সমৃদ্ধ হয়েছে রণেশ দাশগুপ্ত, শামসুর রাহমান, সন্‌জীদা খাতুন, আনিসুজ্জামান, বেলাল চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, মতিউর রহমান, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক ও অনুজপ্রতিম লেখক পিয়াস মজিদের লেখার ভেতর দিয়ে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯—৮ জুলাই ২০০৩) বাংলাদেশে পার হয়ে যাচ্ছিল নীরবেই। এ প্রেক্ষাপটে এগিয়ে এলেন মতিউর রহমান। সম্পাদক হিসেবে বইয়ের ভূমিকায় তাঁর ভাষ্য, ‘আমাদের প্রিয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁর শৈশব–কৈশোরের স্মৃতিবাহী ভালোবাসার ভূমি বাংলাদেশ থেকে কোনো আয়োজন থাকবে না—এটা ভালো লাগছিল না। বাংলা একাডেমি অমর একুশের আয়োজনে “শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়” শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও এই বঙ্গে তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনো বইপত্র প্রকাশিত হয়নি। সে অপূর্ণতা দূর করার ভাবনা থেকেই শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি শীর্ষক বর্তমান সংকলনের আয়োজন।’

ছোট্ট অথচ সুলিখিত ভূমিকা মারফত মতিউর রহমান আরও জানাচ্ছেন, ‘আমরা খুব বড় পরিসরে স্মারকগ্রন্থ–জাতীয় কিছু করার প্রয়াস পাইনি, বরং বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সুভাষ–শ্রদ্ধার্ঘ্য মলাটবদ্ধ করেছি মাত্র।’

খুব বড় পরিসরের না হলেও এ বইকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। যাবে না এ কারণে যে এখানে বাংলাদেশের যে ১০ জন লেখক, প্রাবন্ধিক ও কবির লেখা রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের রচনার ভেতর দিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

১০টি নিবন্ধকে দুটি ভাগে সহজেই ভাগ করা যায়। এক ভাগে রয়েছে যাঁদের সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্যক পরিচয় ছিল, তাঁদের স্মৃতিচারণা; অন্যভাগে রয়েছে তাঁর কবিকৃতির ও গদ্যরচনার কথা, কোনোটা সাধারণ আলোচনা, কোনোটা মূল্যায়নধর্মী।

যেমন রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই যখন বলেন, ‘তাঁর কোনো কোনো কবিতা লোকশ্রুতিতে স্থান করে নিয়েছে’, তখন তাঁর এ উচ্চারণকে উপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না। আবার শামসুর রাহমান যখন বলেন, ‘সুভাষ তাঁর অনুজ কবিদের নতুন পথ দেখিয়েছেন, বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের কাব্যিক সাহসের সীমা’, তখন কবির পাশাপাশি মানুষ সুভাষেরও ভিন্ন এক মূর্তি ধরা পড়ে আমাদের সামনে।

সন্‌জীদা খাতুনের স্মৃতিসিক্ত, পাশাপাশি সুভাষের কবিতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখাটিও মর্ম স্পর্শ করে যায়। অন্যপক্ষে আনিসুজ্জামানের লেখাটি পাঠ করলে মানুষ ও কবি হিসেবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নতুন করে জানার সুযোগ পাওয়া যাবে।

একইভাবে বেলাল চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, মতিউর রহমান, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক ও পিয়াস মজিদের প্রবন্ধ–নিবন্ধগুলো পাঠ করলে কবি ও মানুষ হিসেবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের যে পরিচয় উন্মোচিত হয়, তা কেবল স্মৃতিমূলক নয়, মনোগ্রাহীও বটে।

বইয়ের ভেতরে সুভাষের ছবি, জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি একে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। সমাজের চলমান ঘটনা, তাঁর আঁকবাঁক, শোষিত, অবহেলিতদের ছবি যে সহজ-সরল কাব্যিক ভাষ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তুলে ধরতেন, তাঁর জনপ্রিয়তার মূল কারণ নিহিত ছিল সেখানেই। এ বইয়েও পাওয়া যায় কবি ও মানুষ সুভাষের নিবিড় কিছু ছবি। এমন একটি প্রয়োজনীয় বই সংকলন ও সম্পাদনার জন্য মতিউর রহমানকে অশেষ ধন্যবাদ। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।

শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সংকলন ও সম্পাদনা: মতিউর রহমান

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৯

১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ২৬০ টাকা।