'সোনার বাংলা'য় দারিদ্র্য

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান

দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
আকবর আলি খান
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
[‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ বইয়ের অংশবিশেষ]

প্রখ্যাত মার্কিন বুদ্ধিজীবী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন লিখেছেন, ‘দ্য গোল্ডেন এজ ওয়াজ নেভার প্রেজেন্ট এজ।’ বর্তমান যুগ কখনো সোনালি যুগ নয়। যারা বর্তমান নিয়ে আশাবাদী, তারা বিশ্বাস করে, সোনালি যুগ ভবিষ্যতে আসবে। যারা বর্তমান নিয়ে হতাশ, তারা বিশ্বাস করে, অতীতই হলো সোনালি যুগ। সোনার বাংলার ধারণা যখন বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, তখন বাঙালিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হুতোম প্যাঁচার নকশায়বলা হয়েছে, ‘হ্যানো সোনার বাংলা খান, পুড়ালো নীল হনুমান’। নীল বিদ্রোহের লোকগীতির একটি চরণে বলা হয়েছে, ‘নীল বাঁদরে সোনার বাংলা করলে ছারখার’। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের প্রতিবাদ হিসেবেই সোনার বাংলার স্বপ্ন বাঙালিদের বিভোর করে তোলে। অভিধান সংকলক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,সোনার বাংলা অর্থ হলো: ‘স্বর্ণপ্রসূ বঙ্গভূমি, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বঙ্গভূমি’।(হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৬৬। বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, (নিউ দিল্লি: সাহিত্য একাডেমি), পৃ. ২২৬৬)

বাংলাদেশের সোনার বাংলা ধারণার সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতিতে যে সোনালি যুগের স্বপ্ন দেখা যায়, তার একটি বড় তফাত রয়েছে। বাংলাদেশে সোনার বাংলাকে একটি স্বপ্ন হিসেবে গণ্য করা হয় না; এখানে সোনার বাংলাকে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। বাংলার অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় সব মানুষ সচ্ছল ছিল। ব্রিটিশ শাসনের আগে এ দেশে দারিদ্র্য ছিল না।

প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী লিখেছেন:

সতেরো শতকে সুবা বাংলাকে ‘জান্নাত-আবাদ’ বা ‘স্বর্গরাজ্য’ বলে অভিহিত করা হতো। দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুন নাকি স্বয়ং এই আখ্যা দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবও বাংলাকে ‘জাতির স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করতেন। সত্যিই, কোনো মোগল ফরমান, নিশান বা অন্যান্য সরকারি নথিপত্রে বাংলাকে ‘ভারতের স্বর্গ’–জাতীয় আখ্যা ছাড়া উল্লেখ করা হতো না। আঠারো শতকের মাঝামাঝি কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ লর মতে, সুবা বাংলার এই বর্ণনা যথার্থ। আঠারো শতকের প্রথম ভাগে নবাবি আমলেও যে বাংলা সতেরো শতকের মতো সমান সম্পদশালী ও ক্রম উন্নতিশীল ছিল, তার সাক্ষ্য মেলে তখনকার প্রায় সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস রিয়াজ-উস-সালাতিন রচয়িতার লেখায়। তিনিও বাংলাকে ‘জান্নাত-উল-বিলাদ’ বা ‘জাতির স্বর্গ’ বলে বর্ণনা করেছেন। বাংলার অতুল ঐশ্বর্য ও জিনিসপত্রের সুলভতার কথা কিংবদন্তিরূপে সমসাময়িক ইউরোপীয়দের বর্ণনায় স্থান পেয়েছে। ইংরেজ কোম্পানির পদস্থ কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট প্রাক্-ব্রিটিশ যুগের বাংলা সম্বন্ধে বলেন: ‘[তখন] এ রাজ্য ছিল সচ্ছল, ব্যয় বেশি নয়, স্বাধীন রাজ্য পরিচালনার ব্যয় ও দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত। এ দেশের মানুষ কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে সুখী। তারা প্রাচুর্য ও শান্তিতে জীবন যাপন করতো।’ (সুশীল চৌধুরী, ১৯৯৩। ‘সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা: নবাবী আমল’, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১ , ২য় খণ্ড, [সম্পাদনা সিরাজুল ইসলাম। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি], পৃ. ৩০-৩১)

 এ ধরনের স্বর্গরাজ্যে দারিদ্র্যের উপস্থিতি অকল্পনীয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে এ ধরনের প্রাচুর্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় সব সময়ই বিরাজ করত।

ঐতিহাসিকদের এ ধারণা কিন্তু অর্থনীতিবিদদের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তাত্ত্বিক মতভেদ সত্ত্বেও সব ধরনের অর্থনীতিবিদই ‘সোনালি যুগ’ তত্ত্বকে কিংবদন্তি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সমাজ সম্পর্কে ধ্রুপদি, নব্য ধ্রুপদি, কেনসীয় ও মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদদের মতে বিস্ময়কর মিল রয়েছে। ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদের মতে, প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সমাজ ছিল ম্যালথুসীয় ফাঁদে বন্দী। এ ধরনের সমাজে অধিকাংশ মানুষ কোনোরকমে বেঁচে থাকত। অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক ছিল জনসংখ্যা। ম্যালথুসের পূর্বসূরি অ্যাডাম স্মিথ বিশ্বাস করতেন যে অন্যান্য পণ্যের মতো মানুষের উৎপাদন তার চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। (কোট ইন রবার্ট এল হেইলব্রোনার, ১৯৮৬, দ্য ওয়ার্ল্ডলি ফিলোসাফারস, [নিউইয়র্ক: টসস্টম], পৃ. ৬৫)

 ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদদের মতে, মজুরির হার বেড়ে গেলে শ্রমের সরবরাহ বেড়ে যেত। রিকার্ডোর মজুরি সম্পর্কে অমোঘ বিধির (iron law) বক্তব্য হলো, দীর্ঘদিন ধরে মজুরির হার বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি থাকতে পারে না। মজুরি বাড়লে জনসংখ্যা বাড়বে; জনসংখ্যা বাড়লে মজুরি আবার কমে যাবে। কাজেই প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সমাজের অর্থনীতিতে ওঠানামা ছিল, কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। ম্যালথুসীয় বিশ্লেষণে প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করত দুর্ভিক্ষ। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মজুরির চেয়ে মজুরি বেড়ে গেলেই জনসংখ্যার অতিসরবরাহ দেখা যেত। এর পরিণামে শুরু হতো মজুরি হ্রাস আর সবশেষে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে জনসংখ্যা কমে গেলে আবার মজুরির হার বেড়ে যেত। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও দুর্ভিক্ষের পরবর্তী চক্র।

চিত্রকর্ম: জয়নুল আবেদিন, ১৯৪৩
চিত্রকর্ম: জয়নুল আবেদিন, ১৯৪৩

নব্য ধ্রুপদি ঘরানা ও কেনসীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা একই ধারণা পোষণ করেন। নব্য ধ্রুপদি ধারার দুজন ইতিহাসবেত্তা এ ধরনের সমাজ সম্পর্কে লিখেছেন:

যদি আমরা মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের চিত্র তুলে ধরি এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের অর্থনৈতিক জীবন আধুনিক মানদণ্ডে বিচার করি, তাহলে দেখতে পাবে যে জীবন ছিল বিরামহীন দুর্দশা।...দুর্দশার যুগকে কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং সেসব যুগকে গ্রাম্য সারল্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু সেসব যুগ স্বর্ণযুগ ছিল না।

(নাথান রোজেনবার্গ অ্যান্ড এল ই ব্রিজুয়েল জুনিয়র, হাউ দিস ওয়েস্ট গ্রো রিস [নিউইয়র্ক: বেসিকস বুকস], পৃ. ১)

...এই নিবন্ধে সোনার বাংলা সম্পর্কে প্রচলিত বক্তব্যগুলো কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।