বাবান ও তার কুকুরছানা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

বিজু বলল, ‘বাবান, তোমার বন্ধু এসেছে।’

মেঝেতে বসে ছবি আঁকছে বাবান। বিজুর কথা শুনে মুখ তুলল, ‘কোন বন্ধু?’

‘কাকুয়া।’

‘তাই নাকি? মনে হয় আমাকে কিছু বলবে।’

ছবি আঁকা রেখে বারান্দায় এল বাবান। কাকুয়া বসে আছে রেলিংয়ে। বাবানকে দেখে বলল, ‘তোমাকে আমি তিনবার ডেকেছি। তুমি শুনলেই না। পরে বিজু গিয়ে তোমাকে বলল।’

বাবান হাসল, ‘ছবি আঁকছিলাম তো! তোমার ডাক শুনতে পাইনি। কী খবর, কাকুয়া?’

‘দুটো কুকুরছানাকে মশায় কামড়াচ্ছে।’

‘বলো কী? কোথায়?’

‘গুলশান পার্কের পশ্চিম পাশে। আমি ওদিক দিয়ে উড়ে আসার সময় দেখেছি। ভারি সুন্দর ছানা দুটো। মশার কামড়ে খুবই কষ্ট পাচ্ছে।’

‘ওদের মা–বাবা কোথায়?’

‘আছে কোথাও। আমি দেখতে পাইনি।’

‘কী করা যায় এখন?’

‘তুমি গিয়ে ওদের নিয়ে এসো। নয়তো মশার কামড়ে আরও কষ্ট পাবে।’

‘আমি নিয়ে এলে ওদের মা–বাবা কষ্ট পাবে না?’

‘না। কারণ, পথের কুকুরছানাদের অনেকেই নিয়ে যায়। কুকুর মা–বাবা তা জানে। এ জন্য কষ্ট পায় না।’

‘চলো তাহলে, এক্ষুনি যাই।’

ছুটতে ছুটতে মায়ের রুমে এল বাবান, ‘মা, আমি বেরোব।’

মা অবাক, ‘বেরোবে মানে? কোথায় যাবে?’

‘গুলশান পার্কের ওখানে।’

‘কেন?’

‘বুলেট আর বন্দুককে মশা কামড়াচ্ছে?’

‘বুলেট–বন্দুক কে?’

‘দুটো কুকুরছানা।’

‘তুমি তাদের কথা জানলে কী করে?’

‘কাকুয়া বলেছে। ওদের নিয়ে আসব। তুমিও চলো।’

মা হেসে ফেললেন, ‘দেখলে না শুনলে না, কুকুরছানা দুটোর নামও তুমি দিয়ে দিলে?’

‘হ্যাঁ মা, দিলাম।’

‘এ রকম নাম দিলে কেন?’

‘বড় হয়ে একজন বুলেটের মতো ছুটবে, আরেকজন বন্দুকের মতো শব্দ করবে।’

‘কী করে বুঝলে?’

‘আমি জানি, মা। তুমি তাড়াতাড়ি চলো।’

হাত ধরে মাকে টেনে গাড়ির কাছে আনল বাবান। মতিন ড্রাইভার বাড়িতে নেই। সে গেছে বাবাকে নিয়ে বাইরে। এখন আছে জহির ড্রাইভার। মাকে নিয়ে বাবান এসে জহিরের গাড়ির সামনে দাঁড়াল, ‘তাড়াতাড়ি চলুন, জহির আংকেল। গুলশান পার্কের পশ্চিম পাশটায় যেতে হবে।’ 

জহির গাড়ি স্টার্ট দিল। কাকুয়া আছে মাথার ওপর। সে–ও উড়ে চলল। যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

জায়গামতো এসে গাড়ি থামাল জহির। বাবান ছটফটে ভঙ্গিতে নামল। এদিকটায় আগাছার কিছু ঝোপজঙ্গল আছে। কিছু বালু রাখা আছে ডাঁই করে। সেই বালুর পাশে দুটো বড় সাইজের কুকুর বসে আছে। একটার রং সাদা–কালোয় মেশানো, আরেকটা গাঢ় হলুদ রঙের। পাশেই বালুর একটা গর্ত, সেই গর্তে গুটিসুটি হয়ে আছে দুটো কুকুরছানা। একই রং দুটোর। গাঢ় সোনালি। তাদের চারপাশে বিনবিন করছে মশা। আগাছার ঝোপ থেকে বেরিয়ে ছানা দুটোকে কামড়াচ্ছে। যন্ত্রণায় ওরা ছটফট করছে। কান নাড়ছে, লেজ নাড়ছে। কুঁই কুঁই করছে। মা–বাবা বসে বসে দেখছে। তাদের কিছু করার নেই।

বাবানকে দেখে মা–বাবা দুজনই উঠে দাঁড়াল। ঘেউ ঘেউ করে আনন্দের শব্দ করল। আসলে কথা বলল। বাবান তাদের কথা বুঝতে পারল। 

মা কুকুর বাবা কুকুরকে বলল, ‘এই তো বাবান এসে পড়েছে। এখন আমাদের ছানা দুটোকে নিয়ে যাবে। আহা, মশার কামড়ে বড় কষ্ট পাচ্ছিল বাছারা। এখন আর ওদের কোনো কষ্ট থাকবে না।’

মা কুকুরের কথা শুনে বাবা কুকুর খুব খুশি। খুব ভালো হলো। এই জায়গার মশাগুলো বেজায় দুষ্টু। ছানাদের তো কামড়ায়ই, আমাদেরও ছাড়ে না। ছানাদের কাছে এসে বসলে আমাদেরও কামড়ায়। বাবান এখন ছানাদের নিয়ে গেলে আমরাও এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব।

মা কুকুর বাবা কুকুর এসে বাবানের পায়ের কাছে দাঁড়াল।

বাবান বলল, ‘তোমরাও আমার সঙ্গে চলো। বুলেট–বন্দুক বাড়ির ভেতরে থাকবে, আর তোমরা থাকবে বাড়ির সামনের রাস্তায়। আমি তোমাদের খেতেও দেব।’

মা কুকুর বাবা কুকুর দুজনেই খুব খুশি, ‘ঠিক আছে। চলো।’

‘কিন্তু তোমাদের তো গাড়িতে নিতে পারব না। বুলেট–বন্দুক ছোট। ওদেরকে আমি কোলে করে নেব। তোমরা যাবে কেমন করে?’

মাথার ওপর কদমগাছ। সেই গাছে এসে বসেছে কাকুয়া। সে কা কা করে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই। মা কুকুর বাবা কুকুরকে আমি পথ চিনিয়ে নিয়ে যাব। আমি উড়ে উড়ে যাব। ওরা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে যাবে।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’

বাবানের মা গাড়ি থেকে নামেননি। জহির নেমেছে। বাবানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। 

বুলেট–বন্দুককে ডাকল বাবান, ‘এসো বুলেট, এসো বন্দুক।’

সঙ্গে সঙ্গে ছানা দুটো উঠে দাঁড়াল। বাবান হাত বাড়াতেই তার কোলে এল। দুজনকে কোলে নিয়ে গাড়িতে চড়ল বাবান। মশারা মন খারাপ করে ঝোপের দিকে ফিরে গেল।

বাড়ি এসেই বাবাকে ফোন করল বাবান, ‘বাবা, বুলেট–বন্দুকের জন্য ডগ হাউস নিয়ে এসো। দুধ আর ফিডার নিয়ে এসো।’

ততক্ষণে মায়ের সঙ্গে বাবার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। বুলেট–বন্দুকের কথা বাবা জেনে গেছেন। দুপুরের পর ভারি সুন্দর একটা ডগ হাউস নিয়ে এলেন তিনি। দুধের কৌটা আর দুটো ফিডার নিয়ে এলেন। ফিডার পরিষ্কার করার ব্রাশও আনলেন। বুলেট–বন্দুককে নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল।

ওদিকে বুলেট–বন্দুকের খবর নিয়ে কিটি গেল বাগানে। টুনু আর টুনিকে বলে এল। আনন্দে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে সে। ঠিক তখনই গেটের ওখানটায় উড়ে এল কাকুয়া। কা কা করে বলল, ‘আমরা এসে গেছি।’

গেটের বাইরে মা কুকুর বাবা কুকুরের আনন্দের ডাক শোনা গেল। ডগ হাউস রাখা হলো বাগানের দিককার বারান্দায়। মনের সুখে সেখানে থাকতে লাগল বুলেট–বন্দুক। টুনু আর টুনি উড়ে উড়ে এসে তাদের দেখে যায়। কিটি এসে ছুটোছুটি করে ওখানটায়। কাকুয়া এসে বসে বকুলগাছের ডালে। সেখান থেকে বুলেট বন্দুকের সঙ্গে কথা বলে। বাবান সামনে দাঁড়িয়ে থাকে আর বিজু সময়মতো বুলেট–বন্দুককে ফিডারে করে দুধ খাওয়ায়।

তবে মা কুকুর বাবা কুকুর কিন্তু বাবানদের বাড়ির সামনে থাকল না। বিকেলবেলা চলে গেল। বাবানের সঙ্গে তাদের দেখা হলো না। কাকুয়াকে বলল, ‘আমরা যাই। ভেবে দেখলাম, এখানে থাকলে বুলেট–বন্দুক আমাদের কাছে আসতে চাইবে। তাহলে বাবান নিজের মতো করে ওদের বড় করতে পারবে না। ওরা ওদের মতো বড় হোক।’

বুলেট–বন্দুক বড় হতে লাগল। মাস দুয়েকের মধ্যে বড় হলো তারা। সকালবেলার রোদের মতো হলো গায়ের রং। ভারি সুন্দর কান, ভারি সুন্দর লেজ। 

কুকুর আর বিড়ালে নাকি বন্ধুত্ব হয় না। কিন্তু কিটির সঙ্গে বেজায় বন্ধুত্ব হলো বুলেট–বন্দুকের। টুনু–টুনির সঙ্গে হলো, কাকুয়ার সঙ্গে হলো। 

বাবানের মা কুকুর পছন্দ করতেন না। এখন তিনিও বুলেট–বন্দুককে আদর করেন। বাবা তো আদর করেনই।

বড় হওয়ার পর দেখা গেল বাবান যা বলেছিল, তা–ই হয়েছে। বুলেট হয়েছে তার নামের মতোই। ছোটে একেবারে বুলেটের গতিতে। 

আর বন্দুক তেমন ছোটাছুটি করে না। বসে বা দাঁড়িয়ে এমন ঘেউ দেয়, সেই শব্দে অচেনা মানুষদের কলিজা একেবারে কেঁপে উঠবে। বন্দুকের গুলি ছুড়লে যেমন শব্দ হয়, ঠিক তেমন শব্দ।