উল্কা জীবন

অক্টোবরের কুয়াশাঢাকা ভোরে বিমানবন্দর স্টেশনের নোংরা প্ল্যাটফর্মে কাঁথা আর বস্তা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে দু–একজন ভিক্ষুক। এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে ভোরের সবজির ট্রাকগুলো। ঘন কুয়াশা আর ধুলার মধ্যে ঝাপসা এক সকাল জেগে উঠছে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরে। স্টেশনের বাইরে ঘুমন্ত তাথৈকে কাঁধে নিয়ে এক হাতে স্যুটকেস আর বড় ট্রাভেল ব্যাগ সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে টেনে নামিয়ে রেখে অনেক কসরত করে হাতব্যাগ খুলে ভাড়া গুনে দিল রেহনুমা। টাকাগুলো নিয়ে গলায় মাফলারটা ভালো করে পেঁচিয়ে ড্রাইভার ভুঁস করে বেরিয়ে গেলে স্যুটকেস আর ব্যাগ টানতে টানতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল সে। ভোর সাড়ে ছয়টায় ধূমকেতু এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা। মাত্র স্টেশনটা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে শুরু করেছে এখন, ফ্লাস্কে চা নিয়ে ছোটাছুটি করছে একটা বছর বারোর ছেলে, কয়েকজন যাত্রী ব্যাগট্যাগ পায়ের কাছে নিয়ে বসে আছেন বিরস মুখে। শূন্য রেললাইনটাকে একজোড়া সরলরেখার মতো দূরে কোথায় উদাস নিরীহ ভঙ্গিতে হারিয়ে যেতে দেখে হঠাৎ রেহনুমার বুকটা ধু ধু করতে লাগল। শেরেবাংলা নগরে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট হাসপাতালেরও এখন জেগে ওঠার সময় হয়েছে। ওয়ার্ডের মেঝেতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা অ্যাটেনডেন্টরা এতক্ষণে উঠে তাড়াহুড়া করে বাথরুমের সামনে লাইন দিয়েছে হয়তো। এই কাকডাকা ভোরে ওয়ার্ড ঝাড়ু দিতে ক্লিনাররা আর বেডশিট পাল্টাতে নার্সরা এরই মধ্যে হুলুস্থুল লাগিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়। বড় স্যার রাউন্ডে আসবেন বলে রোগীর আত্মীয়স্বজন অ্যাটেনডেন্টদের তাড়িয়ে ওয়ার্ডছাড়া করা হবে এখনই। আর একটু পরই খাবার ট্রলি ঠেলে পাউরুটি, কলা, ডিম নিয়ে ঢুকবে হাসপাতালের প্যানট্রিম্যান। যাদের নাকে নল লাগানো, তাদের জন্য অবশ্য আলাদা ব্যবস্থা। রজতেরও নাকে নল, দিনে দশবার চার সিরিঞ্জ করে তরল খাবার দিয়ে যায় প্যানট্রি থেকে, সেই সিরিঞ্জ চেপে চেপে খুব ধীরে সেই তরল নাক দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হয় সাবধানে। এই তরলটুকুও গিলতে মাঝেমধ্যে কষ্ট হয় রজতের। প্রায়ই খাবার ওপর দিকে ঠেলে উঠে আসতে চায়, বুক চেপে আসে, দম আটকে যায়।
চা–ওলা ছেলেটার কাছ থেকে দশ টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের কাপে এক কাপ গরম চা নিল রেহনুমা। তাথৈকে কাঁধ বদল করে সাবধানে ডান হাতে চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ধূমকেতু এখনো আসে নাই?

ছেলেটার ঝটপট জবাব, কাইল রাইতে বলে একটা মালগাড়ি লাইনচ্যুত হইছে। সারা রাইত রাজশাহীর লাইন বন্ধ আছিল। টেরেইন আইতে লেট অইব!
রেহনুমা অতঃপর পিলারের চারপাশঘেরা বাঁধানো বসার জায়গায় ব্যাগ, স্যুটকেস রেখে বসে পড়ল। শীত আসি আসি করছে। হিমেল হাওয়া বইছে স্টেশনে। নিজের ওড়নাটা খুলে তাথৈয়ের গায়ের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল সে। তাথৈকে একটু গরম জামা পরানো উচিত ছিল বোধ হয়। তার চেয়ে বেশি উচিত ছিল ওকে রজতের সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে আনা। গত দুদিন হাসপাতালে তাথৈকে একবারও নিয়ে যেতে পারেনি রেহনুমা। রজত অস্পষ্ট কণ্ঠে বারবার জিজ্ঞেস করেছে তাথৈয়ের কথা। কিন্তু রেহনুমা এত ছোটাছুটির ওপর ছিল এই কয়েক দিন! ব্যাংক, মানি ট্রান্সফারের কাগজপত্র গোছানো, রজতের প্রাক্তন অফিস আর বাড়িওলার সঙ্গে সব হিসাব মেটানো, ঘরের প্রায় সব জিনিসপত্র বিক্রি করা, কাজের মেয়েটাকে তার বোনের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা, তাথৈয়ের প্লে স্কুল থেকে টিসি নেওয়া—কাজের কি অন্ত আছে! এখন শরীর–মন যেন ভেঙে আসতে চাইছে ওর। এত ক্লান্তি ভর করেছে শরীরটাতে যে ইচ্ছে হচ্ছে এইখানে প্ল্যাটফর্মের ওপর ওই ভিক্ষুক আর বাস্তুহারাদের মতোই শুয়ে পড়ে। বাস্তুহারা! আজ থেকে সে সত্যি বাস্তুহারাই বটে। ঠিকানাহীন। উদ্দেশ্যহীন। একা। ওই রেললাইনটার মতো।

আজ বা আগামীকাল রজতকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দেবার কথা। অধ্যাপক জহির স্যার বলছিলেন যে তাঁদের এই মুহূর্তে আর করার কিছু নেই। মটর নিউরন ডিজিজ রোগীর এর চেয়ে বেশি উন্নতি আশা করা বৃথা। সার্বক্ষণিক সেবাযত্ন, নানা ধরনের প্রযুক্তিগত সাপোর্ট আর প্রপার ফিজিওথেরাপি ছাড়া এর আর কোনো চিকিৎসা নেই। উন্নত বিশ্বে নানা রকমের ডিভাইস ব্যবহার করে রোগী এভাবেও তিন–চার বছর দিব্যি বেঁচে থাকে। সে রকম সাপোর্ট এখানে–এখনো ওভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তাই বলে এভাবে হাসপাতালের বেড অকুপাই করে রাখাটা অন্যায়। ডাক্তার সাহেব বলে দিয়েছেন, আপনারা ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করুন। একেবারে অপারগ হলে সিআরপি বা এ ধরনের কোনো হাসপাতালে রাখতে পারেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখেন।
পরামর্শ করার কিছু নেই, কারণ রজতের আত্মীয়স্বজন বলতে কিছু নেই। বিধবা পিসিমার কাছে মানুষ। সেই পিসিমা ফরিদপুরের এক গাঁয়ে দুই বছর হলো গত হয়েছেন। পিসিমার মুখে আগুন দিতে গিয়ে গ্রামের লোকের কাছে লাঞ্ছিত–অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়েছে রজতকে। ঢাকায় এসে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, এ কথা তাদের জানা ছিল। পিসিমার মুখটাও দেখতে পায়নি রজত। তবে রজতের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতে আসত হাসপাতালে। যে ব্যাংকে সে কাজ করত, সেখানকার সহকর্মীরাও দু–একবার এসেছেন। ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার এমনকি তাঁর তিন মাসের পাওনা বেতন আর প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা টাকাগুলো উঠিয়ে রেহনুমাকে পৌঁছে দিয়েছেন বাড়িতে। প্রাক্তন সহকর্মীরা সবাই মিলে নিজেদের এক দিনের বেতন একসঙ্গে করে জমা দিয়েছেন অ্যাকাউন্টে। খুব কম নয় সেই টাকার পরিমাণ, প্রায় তিন লাখ টাকা। এতখানি তাঁরা না করলেও পারতেন। রজত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিল শুধু তাঁদের দিকে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে। চোখ বেয়ে অবিরত পানি গড়িয়ে পড়ছিল তার। কথা তো বলতে পারে না অনেক দিন হলো। হাত–পা শুকিয়ে শুঁটকি। সহকর্মীদের পক্ষ থেকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তার শীর্ণ হাত দুটো ধরে বলেছিলেন, ‍‍‘‍ভাববেন না মিস্টার রজত, ভালো হয়ে যাবেন। আমরা দোয়া করছি।’
তিনি যেমন জানেন, রজত বা রেহনুমাও জানে, এসবই ফাঁকা কথা। বলতে হয় বলে বলা।

কু উ উ শব্দ করে ধূমকেতু এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দেড় ঘণ্টা দেরিতে এসে ঢুকলে স্টেশনে একটা সাড়া পড়ে গেল। এদিক–ওদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো ব্যাগ আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হঠাৎ ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ‘অ্যাই, কই গেলা, ব্যাগটা একটু ধরো না’, ‘আমাদের বগি কোনটা’, ‘আরে সরেন না ভাই, দ্যাখেন না লেডিস’, ‘ছুটু তোর বাবারে ক এক বোতল পানি কিনতে’, ‘খালাম্মা কলা নিবেন, কলা?’ ‘এই পেপার, পে---পা—র র র’ এই রকম নানা আওয়াজ আর হট্টগোল ঠেলে রেহনুমা তার বড় স্যুটকেস আর ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে তাথৈয়ের হাত ধরে টানতে টানতে ঘ বগিতে উঠে পড়ল। এই লাল স্যুটকেসটা তার বিয়ের। বিয়ের তিন দিন আগে রজত তাকে নিয়ে নিউমার্কেটে গিয়েছিল কাপড়চোপড় কিনতে। একটা টকটকে লাল বেনারসি শাড়ি কিনেছিল সাড়ে ছয় হাজার টাকা দিয়ে, ম্যাচিং করা ব্লাউজ, পেটিকোট, মাথার লাল জর্জেট ওড়না। আর কিনেছিল একটা কমলা রঙের সুতি টাঙ্গাইল শাড়ি, আরেকটা সবুজ ফুল ফুল ছাপা জর্জেট। একজোড়া পুঁতি বসানো স্যান্ডেল। একটা হলুদ তোয়ালে। কিছু কসমেটিকস, শ্যাম্পু, সাবান, চিরুনি। কাচের চুড়ি অনেকগুলো। সোনার গয়না কেনার সামর্থ্য ছিল না। এসব কেনাকাটা করে তারপর হেসে বলেছিল রজত—‘এইসব নিব কীভাবে? চলো একটা স্যুটকেস কিনি।’ তারপর তারা অনেক দামদর করে লাল স্যামসোনাইট স্যুটকেসটা কিনেছিল। বিয়ের পর এই স্যুটকেসটা একবারই আলমারির ওপর থেকে নামানো হয়েছিল, গতবার কক্সবাজার যাবার সময়। অফিস থেকেই এজিএম কাম পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কক্সবাজারে। ফ্যামিলির জন্য আলাদা চাঁদার ব্যবস্থা। কক্সবাজারে দুদিন হোটেল কক্স টুডেতে ছিল সবাই। তাথৈয়ের আনন্দ তখন দেখে কে! সমুদ্র থেকে তাকে ওঠানোই যায় না। সারা দিন খালি ঝাঁপাঝাঁপি করতে চায়। রেহনুমা আর রজতের কখনো হানিমুন হয়নি। সেই তাদের প্রথম বেড়াতে যাওয়া ঢাকার বাইরে। সেই প্রথম, আর শেষ।
‘মা, মা, খিদা লাগছে।’ তাথৈয়ের কথা শুনে রেহনুমা টিফিন বক্স খুলে নুডলস বের করল। সঙ্গে বিস্কুটও আছে। তাড়াহুড়া করে আসার সময় গুছিয়ে এনেছে রেহনুমা। গত আড়াই মাসে একেবারে শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। খেয়াল করার তো কেউ নেই। রেহনুমা পাগলের মতো রজতকে নিয়ে ছোটাছুটি করছিল এদিক–ওদিক, কাজের মেয়েটার কাছে তাথৈকে একলা রেখে। নাওয়া–খাওয়া, স্কুল, গোসল কিছুই হয়নি ঠিকমতো। রজতের রোগটা প্রথম দিকে ধরাই পড়ছিল না। হাত–পা শুকিয়ে যাচ্ছে, খাবার গিলতে কষ্ট হচ্ছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, মাংসপেশি লাফাচ্ছে কাঁপছে, অবশ–অসাড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কিছু ধরতে পারছে না। একের পর এক পরীক্ষা–নিরীক্ষা। সিটি স্ক্যান, এমআরআই। মাসল বায়োপসি। এই ডাক্তার রেফার করে ওই ডাক্তারকে। উনি আবার অন্য কাউকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা। একাডেমিক কেস বলে ছাত্রদের পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অধ্যাপক বেশ কিছুদিন রেখে দিলেন ওয়ার্ডে। রোজ ছাত্রছাত্রীরা এসে হিস্ট্রি নিত, হাতুড়ি দিয়ে জয়েন্টগুলো টিপে টুপে দেখত, নিজেদের মধ্যে কেস নিয়ে আলোচনা করত। রজত একটা কাঠের টুকরোর মতো পড়ে থাকত বেডে, কোনো ওজর আপত্তি ছাড়া। কথা তো স্পষ্ট বলতে পারে না, তাই রোগ ইতিহাস রেহনুমাকেই বলতে হতো বারবার। প্রতিদিন। সকাল–বিকেল। অনেকবার। বলতে বলতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ওর। কোনটার পর কোনটা বলতে হবে। কীভাবে সাজাতে হবে ঘটনাপরম্পরা। কীভাবে বললে কেস হিস্ট্রি সহজে লেখা যায়। ছাত্রছাত্রীরা নোট করে নিত তার কথা। পরদিন আবার নতুন কোনো ব্যাচের কাছে রোবটের মতো একই কথার পুনরাবৃত্তি করে যেত সে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো ওদের বলে, ‘এই একই প্যাঁচাল রোজ রোজ শুনে কী করবেন? তার চেয়ে শোনেন আমাদের প্রথম পরিচয়টা কী করে হলো! সেও এক মজার গল্প। চার বছর আগে একদিন আমি একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলব বলে রজতের এলিফ্যান্ট রোডের ব্যাংকে যাই। ভোটার আইডি, ছবি সবই ছিল সাথে, কিন্তু আমার কোনো রেফারেন্স ছিল না। থাকবে কী করে, এই শহরে তো আমার তেমন কেউ আপনজন নেই। হোস্টেলে থেকে পড়েছি, দু–একজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন আছে বটে, তবে সাহায্য করার ভয়ে তারা রীতিমতো এড়িয়েই চলে সব সময়। তো সেদিন লোকটার সাথে নানা তর্কবিতর্ক করে অবশেষে হার মেনে সজল চোখে অ্যাকাউন্ট না খুলেই ফিরে আসতে হয়েছিল। মনে মনে অনেক গালি দিয়েছিলাম কাঠখোট্টা লোকটাকে। ওমা, পরদিন কাঁটাবনের একটা বাসা থেকে টিউশনি শেষে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, দেখি সেই লোকটা। “আপনি এই বাসায় থাকেন!” “আমি তো এই তিনতলায় পড়াই।” “ও আচ্ছা।” ইত্যাদি কথাবার্তা হলো। তারপর থেকে প্রায় রোজ সকালেই দেখা হয়। আমার টিউশনি যখন শেষ হয়, তখন লোকটার অফিস যাওয়ার সময়। কখনো একটু হাসি। কখনো কেমন আছেন, এই তো ভালো। কখনো কিছুই বলা হয় না। একসময় লক্ষ করি যে লোকটা দরজায় তালা দিয়ে প্রায়ই সিঁড়িঘরে অপেক্ষা করে থাকে বোকার মতো। আমি ওপর থেকে নামার সময় ধরা পড়ে গেলে দ্রুত ঘড়ি দেখতে দেখতে নেমে যায়। কেন দাঁড়িয়ে থাকেন এখানে? জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগত। কিন্তু ভালো লাগত এই দাঁড়িয়ে থাকা। এই অকারণ অপেক্ষা।’

একটা নিশ্বাস ফেলল রেহনুমা। রজত কি অপেক্ষা করছে এখন? রেহনুমার জন্য? কোমরের পেছনে বেডশোর হয়েছে খানিকটা জায়গায়। ডাক্তার বলেছেন বারবার এপাশ–ওপাশ করে দিতে। আর একটা বিশেষ নিউম্যাটিক বেড কিনতে হবে, খোঁজ নিয়েছে রেহনুমা, দশ হাজার টাকা দাম। শুনে রজত অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড় বিড় করে বলেছে, ‘থাক। কী হবে কিনে? পরে আর কোনো কাজে লাগবে না ওটা। টাকা নষ্ট।’ ‘এভাবে বেডশোর নিয়ে শুয়ে শুয়ে কত দিন অপেক্ষা করবে রজত? দশ দিন? এক মাস? তিন মাস? ওর তো দিন রাতের হিসাব নেই। ওর কাছে সব দিনই একরকম। সারা দিন সারা রাত ছাদের দিকে চেয়ে থাকা। তীব্র ব্যথা আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানো। দিনে দশবার নাকের নল দিয়ে তরল খাবার ঢোকে। প্রস্রাব ক্যাথেটারের ইউরোব্যাগেই জমা হয়। টয়লেট করলে অবশ্য পরিষ্কার করে দিতে হয়। প্রথম প্রথম দিনে দুতিনবার করে ডায়াপার পাল্টাত রেহনুমা। পরের দিকে শুধু একবার। অ্যাডাল্ট ডায়াপারের এত দাম! তা ছাড়া রেহনুমা একা আর কত করবে? বাড়িতে তাথৈ আর কাজের মেয়েটা একা, তাই রজতকে রাতে শেষবার খাইয়ে রেহনুমা প্রতিদিন বাড়ি ফিরে যায়, আবার ভোরবেলা আসে। এর মধ্যে তাথৈ আর কাজের মেয়েটার জন্য রান্নাবান্না করে রাখে। টাকাপয়সার খোঁজে এদিক–ওদিক যেতে হয়। একটা চাকরির জন্য অবিরাম চেষ্টা করে। ওষুধপথ্য কিনতে যায়। প্রতিদিন নতুন নতুন কোনো সমস্যা তৈরি হয় রজতের। কখনো রক্তশূন্যতা। কখনো ইউরিনে ইনফেকশন। কখনো কাশি। রোজ ওষুধ পাল্টায় ডাক্তাররা আর রেহনুমাকে অবিরাম ছুটতে হয়। আজকাল সারা দিন তাই রেহনুমার ক্লান্ত লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় মাঝেমধ্যে। একটা অদ্ভুত চক্রের মধ্যে যেন আটকে গেছে তার জীবনটা। সে এর মধ্যে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে, বেরোতে পারছে না। এর মধ্যেই গত মাসে রজতের ক্লাসমেটরা এল হাসপাতালে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং অ্যালামনি থেকে একটা ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে রজতের চিকিৎসার সাহায্যে। অ্যালামনির অনেকেই এখন দেশে–বিদেশে ভালো অবস্থানে আছে। কেউ বিরাট বিজনেসম্যান। কেউ সরকারের বড় পোস্টে। কেউ শিল্প উদ্যোক্তা। তাদের ক্লাসের অনেকে হয়তো এখন মফস্বল থেকে আসা মিনমিনে স্বভাবের প্রায় অনুল্লেখ্য রজতকে মনেই করতে পারে না। কিন্তু ফেসবুকে ঘুরতে থাকা অসুস্থ রজতের ছবি, পিকনিক আর র‍্যাগডের ছবিতে রজতের সহাস্য উপস্থিতি, কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে রজতের বউ–বাচ্চার ফ্যামিলি ফটো তার প্রাক্তন সহপাঠীদের নস্টালজিক আর দুখী করে তোলে বোধ হয়। হয়তো বয়স বাড়ছে বলে তারা নিজেদেরও এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে কল্পনা করে তার প্রতি সহমর্মিতায় আর্দ্র হয়। যে কারণেই হোক, ফেসবুকে উল্লেখিত রেহনুমার অ্যাকাউন্টে তাই হু হু করে টাকা জমা হতে থাকে। এক লাখ। দুই লাখ। পাঁচ লাখ। রজত বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে প্রায়। এই মানুষগুলোর অনেককে সে প্রায় মনেই করতে পারে না। ছাত্রজীবনে খুব বেশি বন্ধুবান্ধব ছিল না কখনো তার। যাকে বলে আড্ডাবাজ আর বন্ধুবৎসল, তেমনটা সে মোটেও নয়। অথচ এখন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মনুষ্যত্ববোধ মৃত্যুর আগে তাকে বারবার কাঁদাতে থাকে। জীবন আর পৃথিবী সম্পর্কে সব নেতিবাচক ধারণা দূরে সরে যেতে থাকে ওর। পৃথিবীটাকে আজকাল বড় সুন্দর আর মায়াময় মনে হয়। হাসপাতালে শুয়ে বিড়বিড় করে রজত মাঝেমধ্যে এসব বলতে চেষ্টা করে। কথা জড়িয়ে যায় বলে মুখের কাছে কান নিয়ে অনেকবারের চেষ্টায় বুঝতে হয় রেহনুমাকে। রেহনুমা জবাবে অবশ্য কিছু বলে না। এই যেমন এখনো তাথৈয়ের অবিরাম প্রশ্নের মুখে সে নিশ্চুপ থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, মা?’, ‘বাবা কোথায়, মা?’ ‘বাবা কি আমাদের সাথে যাবে?’ , বাবাকে কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়বে মা?’ ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্নের সামনে রেহনুমা পুরোপুরি অবিচল থাকতে চেষ্টা করে এখন। তার হাতব্যাগে এই মুহূর্তে নয় লাখ তেষট্টি হাজার টাকা। রজতের সহকর্মী ও প্রাক্তন সহপাঠীদের দেওয়া সব টাকা তুলে ফেলেছে গতকাল। বাড়িতে যা আসবাব, টিভি–ফ্রিজ ছিল, তা বিক্রি করে আরও সত্তর হাজারের মতো পাওয়া গেছে। রজতের অ্যাকাউন্টে পাওনা বেতন আর প্রভিডেন্ট ফান্ড মিলে ছিল দেড় লাখের মতো। এটুকু দিয়ে দিব্যি একটা নতুন জীবন শুরু করা যাবে তাথৈকে নিয়ে। কেউ জানে না যে ওর স্কুলের চাকরিটা হয়ে গেছে রাজশাহীতে। ফোনের সিম পাল্টে ফেলেছে কাল রাতেই। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিয়েছে, ইনঅ্যাকটিভ করেছে ফেসবুক আইডি। ওদের আর কেউ খুঁজে পাবে না কখনো। খুঁজবার চেষ্টাও অবশ্য করবে না কেউ। এই বিশাল পৃথিবীতে কে আছে কে নেই, তা দিয়ে কারই বা কী আসে যায়! তাথৈ নিশ্চয় ধীরে ধীরে একদিন ভুলে যাবে ওর বাবার কথা। রেহনুমাও সবকিছু সামলে নেবে, আর ধীরে ধীরে গুছিয়ে নেবে নিজেকে। আর রজত?

রেহনুমা চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। হু হু দমকা বাতাস এসে তার চুল উড়িয়ে দিতে থাকে বারবার। চোখ দুটো শুকনো খটখটে হয়ে পড়ে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায়। রজত অপেক্ষা করে থাকবে। কত দিন অপেক্ষা করবে কে জানে! তার পিঠের বেডশোরগুলো হয়তো আরও ছড়াবে। দিনে দিনে আরও শীর্ণ অবশ হবে হাত–পাগুলো। অস্পষ্ট বাক্য বন্ধ হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। তবু এই পৃথিবী আর এর মানুষগুলো সম্পর্কে যে দারুণ চমৎকার বিশ্বাস সে এখন পোষণ করে, তা নিয়েই হয়তো অপেক্ষা করতে থাকবে সে। জীবনটাকে হয়তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুন্দর আর মায়াময়ই মনে হবে তার কাছে। শীত লাগছে বলে হাত বাড়িয়ে ট্রেনের জানালা নামিয়ে দেয় রেহনুমা। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ছুটে চলে একটা বিশাল অন্ধকার মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে। উল্কার মতো তীব্র বেগে। জীবন এই বেগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না।