'সাহিত্যের চিরায়ত মানদণ্ডকে ধরার চেষ্টা করেছি'

>অসীমের ভেলা: বাংলা সাহিত্যের সেরা কবিতার সংগ্রহ নামে বাংলা কবিতার একটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বাতিঘর প্রকাশনা থেকে বেরোনো এই সংকলন পরিমার্জিত হয়ে এবারের বইমেলায় নতুনভাবে বাজারে এসেছে। কথোপকথনে জানা গেল এ সংকলনের নেপথ্য কাহিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: অন্য আলো
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: অন্য আলো

আলতাফ শাহনেওয়াজ: প্রথমেই জানতে চাই, এ সংকলন কেন করলেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি মূলত একজন কবিতা পাঠক। জীবনের বহু সময় পাগলের মতো কবিতা পড়ে কাটিয়েছি। কবিতা পড়ার সময় আমার মনে হয়েছে, এই যে কবিতাগুলো পড়ে এত আনন্দ পাচ্ছি, তার সেরা একটি সংগ্রহ যদি বের করতে পারতাম! প্রতিটি পাঠকের ঘরে যদি এই সংকলনটা থাকত! আসলে আমাদের সাহিত্যে লাখ লাখ কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো এত কবিতা পড়তে পারবে না। ফলে তারা এর মধ্যে থেকে সেরা কবিতাগুলো পড়তে চায়। সেই রকম কিছু বই পৃথিবীর সব দেশেই থাকে। কনফুসিয়াস আজ থেকে ২ হাজার ৬০০ বছর আগে এ রকম বই তৈরি করেছিলেন তাঁর সময় ও তাঁর আগের সেরা চীনা কবিতাগুলো নিয়ে। এই বিষয়টি আমাদের ভাষাতেও থাকা দরকার। এর মানে এই নয় যে এটা আগে করা হয়নি। হয়েছে, অনেক ভালো সংগ্রহও হয়েছে। কিন্তু আমার যেটা মনে হয়েছে, তা হলো, আগের সংকলনগুলোর অধিকাংশ করেছিলেন কবিরা। সাধারণত কোনো সংকলনে কবিরা যখন কবিতা বাছাই করেন, তখন তাঁদের যে বিশেষ প্রখর মনোভঙ্গি বা পছন্দ, তা কাজ করে। শিল্পের চিরায়ত মূল্যমানের চেয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টির প্রচণ্ডতা কাজ করে। আমার মতে, অনেকগুলো সংকলন সে জন্য সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হতে পারেনি। আমি নিজে ঠিক কবি নই বা হলেও খুবই ছোট কবি। কবিতা সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এতটা তীব্র, স্বতন্ত্র ও প্রখর নয়। এই সংকলনে আমি সাহিত্যের চিরায়ত মানদণ্ডকে ধরার চেষ্টা করেছি। সেই আলোকে সবার কাছে সেরা বলে গ্রহণীয় এমন কবিতাগুলোকেই বাছাই করার চেষ্টা করেছি এবং আমার ধারণা কবিতাপ্রেমীরা এটা ভালোবাসবে।

আলতাফ: সংকলনটি করার সময় কবি বা কবিতা নির্বাচনে কোন কোন বিবেচনা কাজ করেছিল আপনার?
সায়ীদ: কবি ও কবিতা নির্বাচনে আমি আমার চিরায়ত (ক্ল্যাসিক্যাল) দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেছি। সাম্প্রতিকতার দ্বারা প্রভাবিত হইনি। কবিতার চিরকালীন সেরা গুণগুলো যে কবিতায় পেয়েছি, সেগুলোই নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আসলে প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সংকলন করতে চেয়েছি।

আলতাফ: প্রতিনিধিত্বমূলক বিষয়টি যদি বুঝিয়ে বলতেন…
সায়ীদ: বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার সংকলন করেছেন, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যৌথভােব আধুনিক কবিতার সংকলন করেছেন, বিষ্ণু দে–ও করেছেন, এমনকি হুমায়ুন আজাদের কবিতার সংকলনও আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন। কিন্তু সমগ্র বাংলা সাহিত্যের কোনো একক সংকলন নেই। ইংরেজি সাহিত্যের অন্তত সাত–আটটি ভালো কবিতার সংকলন আছে। আমি মনে করি, বাংলা ভাষার সব যুগের কবিতা নিয়ে আমাদেরও এমন একক সংকলন থাকা দরকার। সে কারণেই এ সংকলনে আমি সব যুগের প্রতিনিধিত্বমূলক কবি ও কবিতাকে স্থান দিতে চেয়েছি।

আলতাফ: আপনি নিজে ষাটের দশকের প্রতিনিধি। কিন্তু অসীমের ভেলায় পঞ্চাশের দশকের পর আর কোনো কবিকে নেননি কেন?
সায়ীদ: এখন নিইনি মানে এই নয় যে পঞ্চাশ দশকের পরের কবিরা আর কখনো অন্তর্ভুক্ত হবেন না। ষাটের দশকও অন্তর্ভুক্ত হবে। পরবর্তী সংস্করণে আমি সেই চেষ্টা করব। কারণ, আমি যে দশকের মানুষ, সে দশকের কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি আমার দুর্বলতা থাকতে পারে। সে জন্য আম, কাঁঠাল যেমন জাগ দেয়, তেমনি এ বিষয়টিও একটু জাগ দিয়ে রেখেছি। সেই সময়ের কবিতাগুলো মাঝেমধ্যে দেখি, হয়তো সামনের সংস্করণে এই কবিতাগুলো নিয়ে আসব।

আলতাফ: অসীমের ভেলায় আরেকটি বিষয় খুব স্পষ্ট: কবি ও কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনি পাঠকপ্রিয়তার দিকে নজর দিয়েছেন। কেন?
সায়ীদ: কবিতার পাঠকপ্রিয়তা কিন্তু এমনি এমনিই হয় না। কোনো অ-কবিতা পাঠকপ্রিয় হওয়া কিন্তু অত সহজ নয়। আর হলেও সেটা স্থায়ী হয় না। পাঠকপ্রিয়তা কবিতার কোনো দোষ নয়। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তো পাঠকপ্রিয় কবিতা, এটা কি তার দোষ? পাঠকপ্রিয়তার সঙ্গে সেরা কবিতার একটা যোগ আছে। পাঠকপ্রিয় নয়—এ রকম সেরা কবিতা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তবে দু–একটি ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যেমন সুধীন দত্তের কবিতা অনেক ভালো মানের হলেও পাঠকপ্রিয় নয়। তাঁর কবিতাও নিয়েছি। এই সংকলনে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের সর্বাধিক কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছি। কারণ, আমি মনে করি, এ দুজনের কবিতায় যত পর্বান্তর রয়েছে, তা অন্যদের ক্ষেত্রে কমই দেখা যায়। আর তিরিশের দশকে এসে পঞ্চপাণ্ডবের বাইরে আরেকজন গোপনে পড়ে ছিলেন। তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্র। আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রকেও গুরুত্ব দিয়েছি।

আরেকটা বিষয়ে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। সেটা হলো কবিতায় ‘হাস্য রস’। বাঙালির জীবনে হাসি নেই। তা ছাড়া আমাদের যে স্বাস্থ্য, তা হাসির অনুকূল নয়। সংস্কৃতশাস্ত্রে নয়টি রসের কথা বলা হয়। তার মধ্যে ‘হাস্য রস’ একটি। প্রেমের কবিতার পরেই মানুষ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে ‘হাস্য রসের’ কবিতা। আমাদের এখানকার কবিতার সংকলনগুলোয় ‘হাস্য রস’ একেবারেই অবহেলিত। এ জন্য রবীন্দ্রনাথ, দিজেন্দ্রলাল রায়, গোলাম মোস্তফাসহ যেসব কবির হাস্যরসাত্মক কবিতা আমি পেয়েছি, এই সংকলনে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছি।