পাবলো নেরুদার গোপন বাড়ি

নেরুদা।
নেরুদা।

[মাতিলদে উরুটিয়া (জন্ম: ৩০ এপ্রিল ১৯১২—মৃত্যু ৫ জানুয়ারি ১৯৮৫) পাবলো নেরুদার তৃতীয় স্ত্রী, দাপ্তরিকভাবে তাঁদের দাম্পত্যকাল ১৯৬৬ থেকে নেরুদার মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু তাঁদের প্রথম দেখা এবং প্রণয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।

১৯৪৬ সালের এক আলসে অপরাহ্ণে পাবলো নেরুদাও মাতিলদে উরুটিয়ার সাক্ষাৎ চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো একটি পার্কে, তখন এখানে একটা কনসার্ট চলছিল।

চন্দ্রালোকে আমৃত্যু একসঙ্গে থাকার ব্রত নিয়ে দুজন বিয়ে করেন। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুজন—বর ও কনে। এটি কোনো আইনসিদ্ধ বিয়ে ছিল না।

মাতিলদে উরুটিয়া সংগীতশিল্পী, প্যাডিয়াট্রিক থেরাপিস্ট। নেরুদার নির্বাসিত জীবনের সঙ্গী ও প্রেরণা। নেরুদাকে নিয়ে মাতিলদের বইটির নাম ‘মাই লাইফ উইথ নেরুদা’। আলেকজান্দ্রিয়া জিয়ারদিনোর ইংরেজি অনুবাদ থেকে এই বইটির একটি অধ্যায় ভাষান্তরিত হলো।]

১৯৫২ সালের শীতে আমি চিলি ফিরে আসি, পৃথিবীর কুৎসিততম বাড়িতে। আমি ব্লাঙ্কাকে বলেছিলাম, আমার জন্য একটি উঠোনসমেত বাড়ি ভাড়া করে রেখো, আমার সঙ্গে কুকুরটাকে ফিরিয়ে আনব, তার বাইরে ছোটাছুটি করার মতো জায়গা লাগবে।

ব্লাঙ্কা পেয়েছে দুটো উঠোনের একটি বাড়ি, অনেকগুলো রুম, যার সব কটিই খালি। খাট-পালঙ্ক যা কেনার ও সাজানোর আমাকেই করতে হবে। তবে পৌঁছে যাতে ব্যবহার করতে পারি, সে জন্য ব্লাঙ্কা একটি বেডরুম ঠিক করে রেখেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আমি আতঙ্কের সঙ্গে দেখি ছোট বিছানা, একটি বেডসাইড টেবিল, একটি ছোট টেবিল এবং দুটি চেয়ার। এই হচ্ছে আমার আসবাব। আমি ক্যাপ্রি ও ইশিয়া থেকে এসেছি, তার আগে রৌদ্রকরোজ্জ্বল মেক্সিকো—সেখানে পরিসর অনেক বড়, অনেক সুন্দর, অনেক আলো। কিন্তু এখানে আমি কী করতে এসেছি?

পাবলো যখন দ্রুত সামনের দরজা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় চিৎকার করে বলল, ‘পাতোজা, আমার পাতোজা কোথায়?’ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

আমরা আলিঙ্গন করলাম এবং আমার মধ্যে আবেগময় বিস্ফোরণ ঘটল, আমি তাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করলাম, ‘জঘন্য পচা এই দেশে আমি কী করব?’

পাবলোর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, ক্ষুব্ধ হয়ে ভারী পা ফেলে রুমের চারদিকে ঘুরতে শুরু করল। সে রাগে আরও ফুলে উঠেছে, আমি তাকে কখনো এমন ক্ষুব্ধ হতে দেখিনি। রোম থেকে আমার কেনা ছোট হ্যাটটা হাতে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল, এটাকে পায়ে মাড়াল, তারপর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ স্বরে বলতে শুরু করল, ‘এই ভয়ংকর পচা দেশটি তোমারই। এখানেই তোমাকে থাকতে হবে, তোমাকে এখানেই থাকতে হবে, এই দেশের সমস্ত সমস্যা ও দারিদ্র্য নিয়ে একে তোমার ভালোবাসতে হবে। এসব নিয়েই জীবন। কুৎসিত হবে এবং সমস্যাও থাকবে, দেশকে কারও উপেক্ষা করা উচিত নয়।

পাবলোই ঠিক বলেছে। সৌভাগ্যবশত আমি কাঁদতে শুরু করি। পাবলো আমার কান্না সহ্য করতে পারে না।

সে শান্ত হয়ে আসে, ‘আমি দুঃখিত। আমার এমন নির্মম হওয়া ঠিক হয়নি। আমার মনে রাখা উচিত ছিল যে তুমি বহু বছর ধরে চিলির বাইরে, কিন্তু এভাবেই আমরা দেশকে আগলে রাখি। ব্যাপারটা এমনই। আমরা এখন এখানেই থাকব। আমরা সারা জীবন একসঙ্গে থাকব।’

আমার মনে হয় আমরা দুজনেই লজ্জা পেলাম—পাবলো এমন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠার জন্য আর আমি কোনো কিছু না ভেবে বোকার মতো এসব কথা বলার জন্য।


সান্তিয়াগোতে তখন বিদ্যুৎ সাশ্রয় চলছে। আমার প্রথম রাতেই গোটা মহল্লা অন্ধকার, ব্ল্যাকআউট চলছে। সান্তিয়াগো ক্যালে দার্দিনাকে মোমবাতির আলোয় আমাদের বাড়িটা আরও বেশি বিষণ্ন হয়ে উঠেছে।

মাতিলদে উরুটিয়া।
মাতিলদে উরুটিয়া।

কারও পক্ষে সবচেয়ে হতাশার যে চিত্র আঁকা সম্ভব, দুটি জ্বলন্ত মোমবাতির আলো তাতে তুলির শেষ পরশ লাগিয়ে দিয়েছে। বেশ ঠান্ডা, ছোট্ট স্টোভের আগুনে কিছুই গরম হয় না। আমার হৃৎপিণ্ড বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আমি বহু বছর মেক্সিকোতে থেকে এসেছি। আমি বরফঠান্ডা আর শীতের নগ্ন বৃক্ষের কথা ভুলে গেছি।

শীতের সান্তিয়াগো আমার কাছে কুৎসিত মনে হলো, শহর ছাড়িয়ে আন্দিজ পর্বতমালার দৃশ্যমান এবড়োখেবড়ো যে সৌন্দর্য, তা বিষণ্নতাকে পুষিয়ে দিতে যথেষ্ট নয়।


বিছানায় শুয়ে আমি ঘোষণা করলাম সান্তিয়াগো আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে অনাকর্ষণীয় শহর। সবচেয়ে বেদনার বিষয়টি হচ্ছে, পাবলোকে তার অন্য একটি বাড়িতে ফিরে যেতে হবে, যেখানে সে তার স্ত্রী ডেলিয়ার সঙ্গে বসবাস করছিল। আমি বুঝতে পারলাম পাবলো আমাকে যা ভাবতে বলেছিল, আমি মোটেও ভালো করে ভেবে দেখিনি—আমাদের এখনকার অবস্থা আমার কাছে, তা অসহ্য মনে হচ্ছে। আমার জন্য রয়ে গেল কেবল নিয়ন।

সকালে পাবলো যখন ফিরল, মনে হলো দরজা দিয়ে এক পশলা সূর্যের আলো ঢুকেছে। তার আগমনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘এমন অসময়ে বাসা থেকে বেরোনোর সময় কী বলে এসেছ?’

দুষ্ট অভিব্যক্তি নিয়ে পাবলো বলল, ‘বলেছি সামনের দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছি। শোনো, আমি খবরের কাগজ নিয়ে এসেছি। আমরা একটি সুন্দর বাড়ির খোঁজ করব। ব্লাঙ্কা পাগল না কি—আমাদের জন্য এমন কুৎসিত একটা বাড়ি ভাড়া করেছে।’

এখন অন্তত হতাশাব্যঞ্জক ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার মতো আমি একটা প্রকল্প হাতে পেলাম—বাড়ি খোঁজা।

পরদিন আমার অ্যাটর্নির সঙ্গে বৈঠক। তিনি একজন ভালো বন্ধু, তাঁর সঙ্গে আমি কিছু ব্যবসায়িক বিনিয়োগে জড়িত। যখন আমি চাকরি-বাকরি করছি না, তখন এই বিনিয়োগ থেকে হাতে নগদ কিছু আসে।

তিনি বললেন, ‘আমার হাতে একটা সুযোগ আছে—এখান থেকে দুই ব্লক পরে খুব সস্তায় একখণ্ড জমি বিক্রি হবে। আপনি যদি এটা কিনে ফেলেন, আমি নিশ্চিত আপনি এটা ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন। জমির দাম সব সময়ই বেড়ে থাকে।’

আমি যাতে জায়গাটা দেখে আসতে পারি, সে জন্য তিনি ঠিকানাটা দিলেন।

বিকেলে পাবলো আমার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ি খুঁজে পেলে নাকি?’

বললাম, যে কটা দেখেছি, একটাও পছন্দ হয়নি। এগুলো খুব বড়, দাম অনেক বেশি কিংবা দেখতে খুব বাজে। আমরা মহল্লার ভেতর হাঁটতে বেরোলাম। হঠাৎ আমার অ্যাটর্নি বন্ধুর দেওয়া বিনিয়োগ–সম্ভব সম্পত্তির ঠিকানাটা মনে পড়ল। এটা কাছেই এবং যেহেতু আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার নেই, আমরা এটা দেখতে গেলাম।

সেই ঠিকানায় গিয়ে কাঠের চালাঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম, ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে সন্দিহান চোখে আমাদের দিকে তাকালেন।

আমরা বললাম, ‘যে সম্পত্তিটা বিক্রি হবে, আমরা তা দেখতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘ওই তো পাহাড় পর্যন্ত, কিন্তু কদ্দুর আমি জানি না, ওই রাস্পবেরি জঙ্গলে ঢাকা।’

আসলেই পাহাড়ের কাছের জায়গাটা কাঁটাবনে ঢাকা, আমরা তবু পাহাড় বেয়ে উঠলাম। ঝরনার ধাবমান পানির শব্দে আমরা মুগ্ধ হলাম, পাহাড়ের ওপরের দিককার জমিনের ওপর দিয়ে বহমান একটি খাল থেকে সত্যিই ঝরনা নেমে এসেছে। পাবলো তার উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না। ঘোষণা করল, ‘এ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জিনিস এটাই। এটা আমাদের শিগগিরই কিনে নিতে হবে। আমাদের টাকা দরকার।’

ফেলিসিটা সালার আঁকা কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদে পাবলো ও মাতিলদে।
ফেলিসিটা সালার আঁকা কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদে পাবলো ও মাতিলদে।

আমার ব্যবসায়ের অংশীদার ও অ্যাটর্নি আমার কিছু সঞ্চয় বের করে দিলেন। সেই টাকা হাতে নিয়ে জমির মালিক মিসেস মানারেলির সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি থাকেন ব্যালে ক্যাথিড্রাল এলাকায়। পাবলো দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার এক কোণে, কারণ তার ভয় ছিল ভদ্রমহিলা হয়তো তাকে চিনে ফেলতে পারেন; আমিই গেলাম জমির দামদস্তুর করতে।

মালিক একজন কম বয়সী নারী। তিনি শুনে খুশি হলেন যে ডাউনপেমেন্ট দেওয়ার মতো টাকা আমার হাতেই আছে। আমার মনে হলো, আর্থিক সংকটে পড়েই তিনি জমিটা বেচতে উদ্‌গ্রীব হয়েছেন। টাকা দিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটা রিসিট নিয়ে আমি আনন্দে লাফাতে লাফাতে সেখান থেকে এলাম। এখন সান্তিয়াগো আমার কাছে তেমন ভয়াবহ মনে হবে না। এই জমিনের ওপরই শেষ পর্যন্ত তৈরি হবে আমাদের বাড়ি লা চাসকোনা।

অনেক গবেষণার পর সব শেষে মিলিটারি হাসপাতালের কাছে একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। জায়গা কম হওয়ায় আমি হালকা আসবাবপত্র দিয়ে বাড়িটা সাজালাম। আমার ঘরের জানালা খুললেই অন্য ঘরের জানালা, এটা কোনো আদর্শ অবস্থা না হলেও এখানে উষ্ণতা ছিল।

দারুণ স্বস্তি—কারণ অন্য জায়গায় ঠান্ডা অসহনীয়। আমি চিলিতে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি, সান্তিয়াগো আগের চেয়ে কম ভয়াবহ মনে হচ্ছে, বিশেষ করে যখন বসন্ত এল সুগন্ধী ফুলের গাছগুলো শহরকে সৌন্দর্য ধার দিল। প্রতিদিনই আমরা নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করছি, আমি যেসব জায়গা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, তা পুনরাবিষ্কার করে চলেছি। আমার পাঁচ বছরের অনুপস্থিতকালে চিলি অনেক বদলে গেছে।

সময়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি বেদনা ও আনন্দ-জীবনের উভয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে শিখেছি। যখন আমাদের মনে হলো কোনো কিছুই আমাদের স্বাভাবিক রুটিনের ব্যাঘাত ঘটাবে না—আমরা আমাদের সুখী ও স্বাভাবিক জীবনের আয়োজন করতে পারি, তখনই ভালো খবরটি এল।

পাবলোর অনেক প্রত্যাশিত একটি শিশুর জন্ম হবে—আমি কি এবারও তাকে হারাব? আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। পুরোনো যন্ত্রণার স্মৃতি বাঁধ ভেঙে আসছে, তবু আমি উৎফুল্ল। দিনের শেষে আমি পাবলোর আগমনের অধীর অপেক্ষায় আছি। আমরা শিগগিরই প্রেগনেন্সি টেস্টের ফল জানতে পারব, আমি তাকে বললাম। কারণ এর মধ্যেই আমি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আমাদের সন্তান লাভের প্রত্যাশা নতুন করে প্রজ্বলিত হয়েছে।

অনেক বছর পর এখন ওই মুহূর্তের কথা যখন ভাবি, বুঝতে পারি তখন এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের মনে হয়নি একটি শিশু আমাদের জন্য কত ধরনের সমস্যার কারণ হতে পারত। আমরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে আমাদের নিজস্ব পৃথিবীতে বাস করতাম।

যখন আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে আমি সত্যিই গর্ভবতী আমি একজন নারী ডাক্তারকে ব্যাখ্যা করলাম যে আমার দুবার মিসক্যারেজ হয়েছে। তিনি বললেন, নিশ্চিত করলেন, এ ধরনের প্রেগনেন্সির বেলায় বিছানায় থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। আমি যদি বিছানা-বিশ্রামে থাকতে পারি, তাহলে সন্তান লাভে সক্ষম হব।

নতুন এক জীবন শুরু হলো। পাবলো আমাকে খুব তোষামোদ করতে শুরু করল, সাহিত্য-সংস্কৃতির বই এনে দিল, আমি যখন পড়ছিলাম, আমার সঙ্গে আলোচনা করল। মার্শেল প্রুস্ত ও ফিওদর দস্তোয়ভস্কি আমাদের প্রিয়।

পাবলো ইতালিতে যা করেছিল, এখানেও আমার জন্য একজোড়া কাকাতুয়া পাখি নিয়ে এল; পাখিগুলো আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমোদিত করবে। সারা দিন পাখি দুটো পরস্পরের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে আবার কখনো ঝগড়াও করছে, তখন পুরুষ পাখিটা খাঁচার নিচের দিকে চলে যায়—বিষণ্ন স্বামীর মতো। কী ঘটল তাদের মধ্যে? কে কাকে কী বলেছে?

আমার হাতে তখন এত বেশি অবসর সময় যে আমি ক্যাপ্রি, নিয়ন ও রোমে আমাদের জীবন কেমন কেটেছে, তা নিয়ে লিখতে বসার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের সফরের সময় যে ডায়েরি লিখেছি, এরপরে বিছানায় গিয়ে যে কথা খেরোখাতায় জড়ো করেছি, তাই স্মৃতিকথা লিখতে সাহায্য করেছে। এসব লেখালেখি কেমন করে স্মৃতিকে নাড়া দেয়!

আমার সন্তানের জীবনের চিহ্ন দেখা দিতে শুরু করেছে। কী আনন্দ! আমরা ভাবলাম, এই সন্তানকে একটা নাম দেওয়া দরকার, কিছুক্ষণ পরই ঠিক করলাম, জন্ম না হওয়া পর্যন্ত কোনো নামের কথা ভাববই না।

পাবলোর পরামর্শ, ‘তবে আপাতত তাকে প্রোকোপিও ডাকতে পারি।’ নামটা বেশ মজার মনে হলো।

আমরা অজাত এই শিশুকে নিয়ে কথা বলছি আর বলছি। পাবলো চাইছে একটি মেয়ে। দীর্ঘ পাঁচ মাস কেটে গেল। ছয় মাসের শুরুতে ডাক্তার বললেন, বিপদ কেটে গেছে। এখন আমি ঘোরাফেরা শুরু করতে পারি। কিন্তু তা সত্যি ছিল না। যে বাচ্চার জন্য আমি এত কিছু সহ্য করেছি, এত যন্ত্রণা মেনে নিয়েছি, আমি বিছানার বিশ্রাম ছাড়ার পনেরো দিন পর তাকে হারালাম।

পাবলো তখন উত্তর চিলি সফর করছে। পুরো ধকল আমার একারই, আমি নিজেই এসে সেন্ট্রাল ক্লিনিকে ভর্তি হলাম। বাচ্চাটা মেয়ে ছিল। পাবলো পরে এসে যখন হাজির হলো, তার হাতভর্তি ফুল। তখনো তার মুখে হাসি ধরে রাখার মতো সাহস রয়েছে।

পাবলো বলল, ‘কিছুই হয়নি। সবই আগের মতো আছে—তুমি, আমি, আমাদের ভালোবাসা। যা হওয়ার ছিল না কিন্তু আশা করেছি, সেটা নিয়ে আমরা নিজেদের ক্ষয় করতে যাব কেন?’

আমি তখনো বেশ অসুস্থ, ব্যথিত এবং ভেঙেপড়া মানুষ। বিছানায় পড়ে থাকা সেই মাসগুলো আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আমার মাংসপেশি বসে যাচ্ছিল। বিশেষ করে আমার পায়ের শক্তি ফিরে পেতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।

লা চাসকোনা, পাবলো ও মাতিলদের গোপন বাড়ি
লা চাসকোনা, পাবলো ও মাতিলদের গোপন বাড়ি

ডাক্তার অনেক সম্ভাবনার কথা বললেন এবং কিছু প্রতিশ্রুতিও দিলেন, কিন্তু পাবলো আর চেষ্টা করতে রাজি নয়। ‘এতে তোমার স্বাস্থ্য যদি খারাপ হয়ে যায়, তোমাকে যদি মরতে হয়, সেই সন্তান আমার চাই না। আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাতোজা।’ এ নিয়ে আমাদের আলোচনা অফুরান এবং যন্ত্রণাদায়ক। শেষ পর্যন্ত একদিন আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিলাম—এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলব না।

আমরা বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিই। আমরা প্রতিদিনই আমাদের জমিনে যাচ্ছি এবং শরীরভর্তি কাঁটাবনের দাগ নিয়ে ফিরে আসছি। বাড়ি করার আগে কাগজে-কলমে যা যা করার দরকার সব শেষ করেছি, এখন কাঁটাবন পরিষ্কার করতে হবে।

একদিন পাবলো ঘোষণা করল, ‘আমার এক স্থপতি বন্ধু এখানে আসছে, আমি চাই তুমি তার সঙ্গে দেখা করো।’

চিলিতে যারা পাবলোর বন্ধু, আমি তাদের চিনি না। আমি পাবলোকে নিষেধ করেছি কারও সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে না। কিন্তু এই জার্মান বন্ধু রড্রিগস আরিয়াস আমাদের সাহায্য করতে আসবে, তার সঙ্গে তো দেখা করতেই হবে।

জায়গাটা দেখে রড্রিগস হেসে ওঠে। বলে, এখানে থাকতে হলে তো আপনাকে কেবল সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করতে হবে—এটা তার ভবিষ্যদ্বাণী। এটা সত্য, আমাদের জমিন ঠিক অনুভূমিক নয়, খানিকটা উল্লম্ব। কিন্তু এটাই তো আমাদের পছন্দ।

কদিন পর স্থপতি একটি পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হলো। চটপটে একজন স্থপতি হওয়ার কারণে বাড়িটাকে এমনভাবে স্থাপন করেছে যে সামনে পুরো সান্তিয়াগো শহর দৃশ্যমান আর বাড়িতে পর্যাপ্ত আলো।

কিন্তু এই ডিজাইন দেখেই পাবলো বলল, ‘আহাম্মক, আমাদের সান্তিয়াগো শহর দেখার দরকারটা কী? আমি পর্বতের দেখা পেতে চাই।’

পাবলো চায় ডিজাইনে বাড়িটাকে ভিন্নভাবে স্থাপন করা হোক। স্থপতি ব্যাখ্যা করল, সেটা করলে বাড়িটা পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাবে না। আর সবার ওপরের ট্যারাসে উঠতে আরও অনেক বেশি সিঁড়ি স্থাপন করতে হবে।

পাবলো বলল, সেভাবেই ভালো হবে। যত সিঁড়ি দরকার লাগাও। তার সব কথার সঙ্গে উথলে উঠছে হাসির ঢেউ।

অনেক বছর পর যখন এই স্মৃতিকথা লিখছি, এই উল্লম্ব প্রকৃতির বাড়িতে অনেক সমস্যা নিয়ে আমাকে বসবাস করতে হচ্ছে। আমাদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাই আমাদের বয়ঃসন্ধির বেপরোয়া বালক-বালিকার মতো করে তুলেছে—আমরা বাড়ি নিয়ে কোনো সমস্যার কথা আমলে নিইনি, আমাদের মতো করে সুন্দর করে তোলার কথা কেবল ভেবেছি।

লা চাসকোনা, পাবলো ও মাতিলদের গোপন বাড়ি এখন জাদুঘর
লা চাসকোনা, পাবলো ও মাতিলদের গোপন বাড়ি এখন জাদুঘর

আমরা সম্মত হলাম একটি লিভিংরুম আর একটি বেডরুম দিয়ে শুরু করব, কারণ হাতে যা টাকা আছে তাতে এটুকুই করা সম্ভব। কাজ শুরু হয়ে গেল, প্রতি সপ্তাহে আমরা এখানটাতে থেকে কাজের অগ্রগতি দেখি। কিন্তু আমাদের আরও হতাশ হতে হলো যখন বুঝতে পারলাম হাতের টাকায় এমনকি একতলাও শেষ করা যাবে না।

স্থপতি ব্যাখ্যা করল, আমরা মাটি ভরাট করা জায়গার ওপর ভবন তৈরি করছি। আমাদের শক্ত ভিত্তি খুঁজে নিতে হবে।

আমরা নির্মাণ সাইটের চারদিকে তাকাই, দেখি কেবল গর্ত আর পাহাড়, কিন্তু দেয়াল নেই। যখন তারা দৃঢ় মাটি পেল, বড় করে ভিত্তি গাঁথল এবং তারপর দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করল। দ্রুত সব টাকা শেষ হয়ে গেল। আমার যা কিছু ছিল বিক্রি করতে শুরু করলাম। প্রতি সপ্তাহে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার ঝক্কিটা সোমবারে পোহাতে হতো; নিয়তি তখন আমাদের পক্ষে, আমরা মজুরি চালিয়ে যেতে সমর্থ হলাম।

পাবলো প্রতি সপ্তাহে ডিজাইনের ব্লু-প্রিন্টে এটা-ওটা বদলাতে শুরু করল, সারাক্ষণই পরিবর্তন করছে। যখন লিভিংরুমের ডিজাইনটা শেষ করল, দেখা গেল রুমে কেবল একটিমাত্র দৃঢ় দেয়াল। আর বাকি সব হবে কাচের। যতক্ষণ না পাবলো তৃপ্ত হচ্ছে, জার্মান স্থপতির সঙ্গে কথা বলেই চলেছে, ‘আমি চাই ফ্লোর পর্যন্ত গ্লাস নেমে আসুক’।

কিন্তু স্থপতি বলল, ‘তা সম্ভব নয়, অন্তত চল্লিশ সেন্টিমিটার দেয়াল থাকতে হবে তার ওপর জানালা বসবে।’ এসব আলোচনা অন্তহীনভাবে চলতে থাকে। যখন দুটি রুমের কাজ সম্পন্ন হলো, আমি স্থপতিকে ধন্যবাদ দিলাম, কারণ তা সত্যিই সুন্দর হয়েছে। রড্রিগস বলল, ‘এই প্রকল্প এখন আর আমার নয়। এটা পাবলোর ডিজাইন করা বাড়ি।’

পরে পাবলো নিজে আমাদের বাড়ির প্রতিটি আসবাবের ডিজাইন করেছে খুব যত্ন নিয়ে, কাঠের গুণাগুণও পরীক্ষা করে নিয়েছে। ততক্ষণ আমি প্রায় সারা দিনই বাগানে কাজ করে চলেছি; বাগানের একটা গাছ, একটা চারাও আমি নির্বাচন করিনি, আমি লাগাইওনি। কিন্তু আমরা সবই বেশ উপভোগ করেছি।

পাবলোর হাসি-কৌতুক বাড়িটাকে জীবন্ত করে তোলে। সব সময়ই হাসতে হাসতে ঢুকত। যখন খুব তাড়ার মধ্যে তখনো আমাকে একটা চুমো দিয়ে দ্রুত ছুটে যেত। আমাদের এই গোপন বাড়িতে আমরা একজোড়া পরিতৃপ্ত দম্পতি হয়ে উঠি।

নেরুদা ও মাতিলদে।
নেরুদা ও মাতিলদে।

এই পরিতৃপ্তির পরও একসঙ্গে থাকার তৃষ্ণা, বিচ্ছিন্নভাবে সন্ধ্যা না কাটানোর তাড়না দিন দিন আমাদের বাড়তেই থাকে। আমরা গ্রীষ্মের ছুটিতে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিই এবং আমরা উরুগুয়ের আটলান্টিদা চলে যাই। আমাদের কজন খুব ভালো উরুগুইয়ান বন্ধু ছিল, তারা তাদের গ্রীষ্মকালীন নিবাস আমাদের জন্য ছেড়ে দিল। বাড়ি অত্যন্ত সুরুচিপূর্ণভাবে সাজানো এবং বাড়িগুলো সমুদ্রের কাছে সুঘ্রাণ পাইনবনের ভেতর। আটলান্টিদা আমাদের শরণ দিতে এগিয়ে আসে।

বড় আশা নিয়ে আমরা আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা করি, আমরা উদ্বেগ এবং বাধাহীন সঙ্গে থাকার উত্তেজনায় পাগল হয়ে উঠি। একবার গন্তব্যে পৌঁছার পর আমরা আমাদের গার্হস্থ্য রুটিন প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করি।

বরাবরের মতোই পানীয় পরিবেশনার দায়িত্ব পাবলোই নিয়ে থাকে এবং ক্ষুধা উদ্রেককারী পানীয়ও তারই হাতে মিশ্রণ। সে টেবিল বসায়, গ্লাস এবং সিলভারের জিনিসপত্র টেবিলে বিছানোই নয়, সারা দিন সমুদ্র কিংবা অরণ্যে ঘুরে যা সংগ্রহ করে এনেছে, তা টেবিল সাজাতে কাজে লাগায়। সন্ধ্যায় একটি সদাই তালিকা হাতে নিয়ে আমরা কেনাকাটা করতে বেরোই। তারপর আমি রাঁধতে বসি, আমার হাতের শ্রেষ্ঠ খাবারটাই রাঁধি। পাবলো উদারভাবে আমার রান্নার প্রশংসা করে।

আমাদের বাড়ির কাছে চমৎকার উষ্ণ পানিতে আমরা সাঁতার কাটি। পাবলো স্মরণ করছে কেমন করে সাঁতার কাটতে হয়; কিন্তু আমাকে এখনো তার পাশে ভেসে থাকতে হয়, কারণ সাঁতারের আতঙ্ক সে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।

‘তুমি যদি আমার সঙ্গে না যাও, তাহলে আমি সবকিছু ভুলে ডুবে যাব।’ সে আমাকে হুমকি দেয়। আমরা আটলান্টিদার চারদিক ঘুরে বুনোফুল সংগ্রহ করি এবং খেরোখাতায় লাগিয়ে তা বন্ধুদের উপহার দিই। তারা এসব বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণ করেছে।

কত নিষ্পাপ আমাদের এই সময় কাটানো। আমাদের জীবনে এত সরলতা, তবু কোনো কিছু উপভোগ করার আগে কত ধরনের জটিলতা যে এড়াতে হতো! আমরা নিয়মিত বন্ধুদের বাড়িতে ‘চলো বেড়াতে যাই’ ধরনের আয়োজনে কয়েক দিন থেকে আসতাম। আটলান্টিদায় পাবলো অনেক সমস্যার কথা লিখেছে—তার লেখায় ‘দাতিতলা’র কথা লিখেছে। এটা তার নিজের আবিষ্কার করা নাম, কারণ সে ঠিকভাবে আটলান্টিদা লিখতে পারত—আমরা যে সত্যিই এখানে ছিলাম, তা অনেকেরই জানার কথা নয়।

বছর কেটে যাচ্ছে, অগোচরে কাটছে আমাদের জীবন। পাবলো আমাকে তার লেখার প্রথম দিককার খসড়া দেখাচ্ছে। আমি হয়ে উঠি তার গোপন সেক্রেটারি, তার পাণ্ডুলিপি টাইপ করে দিই। বাজারে গুজব ছড়াল: পাবলোর একজন ইতালিয়ান প্রেমিকা আছে, কেউ তাকে চেনে না, কারণ পাবলো কারও সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। দিনে দিনে তা আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে, যত দিন না অনিবার্য ঘটনাটি ঘটল। আর তা ঘটল কয়েক বোতল মদের জন্য।

পাবলো ও ডেলিয়ার বাড়িতে ঠিক কোন জায়গায় মদের বোতলের মজুত থাকত, তা জানত বাগানের বুড়ো মালি। কয় বোতল মদের কোনো হদিস দিতে না পারায় পাবলো তাকে চাকরিচ্যুত করল। মালি ছিল ড্রাইভারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যুক্তিসংগত কারণে পাবলোর অফিসে সে-ই ছিল একমাত্র ব্যক্তি, যে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিল।

তিক্ত দিন এসে গেল। ডেলিয়া পাবলোর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট উত্তর পেতে চায়। সে যদি আমার জন্য তার ভালোবাসা অস্বীকার না করে, ডেলিয়া চিলি ছেড়ে চলে যাবে। তাদের যুক্তি অর্থহীন। আমি পাবলোকে কারও কাছ থেকে ছিনিয়ে নিইনি; আমি যখন পাবলোর জীবনে আসি, সে আর ডেলিয়া প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, বরং বন্ধুর মতো একসঙ্গে থাকছে। তারপরও আমি কখনো চাইনি, সে তার স্ত্রীর মর্যাদাটুকু হারাক; সেই ভূমিকার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।

আহত ও বেদনাকাতর ডেলিয়া তাদের বাড়ি ছেড়ে প্রথমে বুয়েনস এইরেস এবং সেখান থেকে ফ্রান্স চলে গেল।

অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী