'না ফেরার দেশে'

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সঙ্গে লেখক
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সঙ্গে লেখক

সবাই এক বাক্যে বলল, আমেরিকা নাকি আমাকে ভিসা দিবে না। কখনোই না। আমার অপরাধ? 

—আমি সাংবাদিক। সাংবাদিকেরা আমেরিকা গেলে আর ফিরে না।
—আমি বিয়ে করি নাই। বিয়ে না করলে দেশে কোনো টান থাকে না। সুতরাং তারা আর ফিরে না।
—আমি গরিব। আমার ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা নাই। এমনকি এক লাখ টাকাও নাই। গরিবেরা আমেরিকা গেলে বড়লোক হয়ে যায়। আর ফিরে না।
তারপরও আমি আমেরিকার ভিসা অ্যাপ্লাই করলাম। সত্য কথা বলতে কেন মানুষ আমেরিকা গেলে আর ফিরে না, এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নাই। অবৈধ অভিবাসী হওয়ার মাজেজা কী হতে পারে, সেটাও আমি বুঝি না। আমাকে আমেরিকা যাবার বুদ্ধি দিছে প্রবন্ধকার আহমদ মাযহার ভাই। তাও চারদিনের বইমেলায় যাবার জন্য। আমার উকিল বাপ আমেরিকায় থাকে। এই অফিসের চার বছরে আমি একটা দিনও ছুটি নেই নাই। চাইলেই এক মাসেরও ছুটি পাব। এই জন্য আমি ভাবলাম, বইমেলায়ও যাব, বাপের বাড়িও থাকব কয়টা দিন—এই তো আমার আমেরিকা ঘোরার প্ল্যান।
কিন্তু সেটা সবাই জানামাত্র যেভাবে আমাকে না না করা শুরু করল, আমার জেদ চেপে গেল ব্যাপারটা নিয়ে। আমি রিজেকশন জিনিসটা সহ্য করতে পারি না। কোনো দিন কোনো কিছুতে রিজেক্টেডও হই নাই। এ অনুভূতিই আমার অচেনা। এইবার দেখি কী হয়! আমি কি মরে যাব নাকি ভিসা রিজেক্ট করে দিলে?
সকাল সাতটা বাজে অ্যাম্বেসির সামনে এক শ লোকের লাইনে দাঁড়ায়া এই কথাই আমি ভাবতেছিলাম। আমার চরম অপছন্দের দুই কাজ:
এক. সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠা
দুই. লাইনের মধ্যে ভেড়ার মতো দাঁড়ায়া থাকা (তাও ফোন ছাড়া!)
এই দুই কাজের মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করতেছি সবচেয়ে বেশি অপছন্দের বিষয়—প্রত্যাখ্যানের জন্য। লাইনে কয়েকজন পরিচিত মুখ দেখলাম, প্রকাশক-লেখক। কেউ কেউ বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে। তাদের জমিজমার দলিল, সহায়–সম্পত্তির কাগজ দেখে আমি মনে মনে দমে গেলাম। ওনারা টিকিটও বুকিং দিয়ে রাখছেন।
আমাকে দেখে আবার বললেন, তোমাকে দিবে না ভিসা। এত কম বয়স তোমার! কম বয়সীদের দেয় না।
আমি সকালের ঝলমলে রোদে আমার কুঁচকানো চোখ মুখ আরও কুঁচকায়ে হাসলাম। বললাম, ঠিক।
ওরা বলল, যদি বাইচান্স তোমার ভিসা হয়, আমাদের সাথে টিকিট করতে যেয়ো। আমরা আজকেই টিকিট কেটে ফেলব। তাহলে খরচ কম হবে তোমার।
আমি আবার বললাম, ঠিক।
দুই ঘণ্টা পরে যেই রুমে আরও ৩০-৪০ জন মানুষের সাথে কাচের দেয়ালের সামনে দাঁড়ায়ে আছি, সেখানে আমার পরিচিত কেউ নাই। লাইন ধরে একেকজন কাচের সামনে দাঁড়াচ্ছে, আঙুলের ছাপ দিচ্ছে, কিছুক্ষণ ওই পারের লোকের সাথে কথা বলতেছে, তারপর ওই পার থেকে বলতেছে, সরি, উই কান্ট গিভ ইউ ভিসা দিজ টাইম।
সবার মধ্যে টেনশন। এখন পর্যন্ত এ রুমে কারও ভিসা হয় নাই।
আমি মনে মনে আল্লাহকে বললাম, আমার বেলায় যেন একটা ছেলে ইন্টারভিউয়ার পড়ে। বাম পাশের কাউন্টারের লোকটার বয়স তুলনামূলক কম, ও হলে সবচেয়ে ভালো। ডান পাশের কাউন্টারে যে বয়স্ক ভদ্রলোক, উনি পড়লেও আশা করি আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। মাঝখানের দুই কাউন্টারে দুই মহিলার পাল্লায় পড়লেই আমি শেষ। তার মধ্যে একজন আবার বেশ দশাসই মহিলা। সে আমার ইন্টারভিউয়ার হইলে আর আমেরিকা যাইতে হবে না আমাকে।
আল্লাহ এই জন্য আমাকে ওই মহিলার কাছেই পাঠাইল। আমি ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে দিতে মহিলা তার ডায়েট পেপসিতে দুইটা চুমুক দিয়ে নিল। আমি মনে মনে ভাবলাম, আমি আজকে শ্যাষ।
যদিও আমার ভিসা উপদেষ্টা, আমার সহকর্মী সালাউদ্দিন সেলিম ভাই বলছেন, ভিসা অফিসারের সামনে খুব একটা উদাসীন ভাব করে থাকবেন যেন আমেরিকা যাবার কোনো সাধই আপনার নাই। আর এই দেশে আপনি খুব ভালো আছেন, আপনার মতন ভিআইপি কেউ নাই—এই জন্য আমি উদাস চেহারা কীভাবে ধরে রাখতে হয়, সেইটা প্র্যাকটিসও করে আসছি, তবু এই মহিলাকে দেখে আমার সব রিহার্সাল ভেস্তে গিয়ে আমার চেহারা একেবারে বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেছে। বেচারা সেলিম ভাই!
দশাসই মহিলাটি আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে আমার দিকে তার দুই চোখ থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করে বলল, আমেরিকা যেতে চাও কেন?
আমি আমার ভাঙা ইংরাজিতে (এত প্র্যাকটিস করে আসার পরেও সব গ্রামার ভুল হইল) বললাম, আমেরিকার কথা অনেক শুনেছি! সবাই বলে সেটা স্বপ্নের দেশ! তাই জীবনে কখনো না কখনো ওই দেশ দেখতে যাবার ইচ্ছা ছিল। এখন একটা সুযোগ হয়ে গেল। ভাবলাম ভিসা অ্যাপ্লাই করি।
মনে মনে নিজেকে কষে থাপ্পড় দিলাম। আমেরিকা—ড্রিম কান্ট্রি? এইগুলা আমাকে শিখাইছে সেলিম ভাই?
মহিলা ওই পার থেকে বলল, এখন কেন? কিসের সুযোগ?
আমি আমার সদ্য প্রকাশিত বইটা তার দিকে ঠেলে দিলাম। বললাম, এইটা আমার উপন্যাস। আমি এর লেখক। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় আমার বুক সাইনিং ইভেন্ট হবে। তাই এখন ভিসা অ্যাপ্লাই করেছি।
ভিসা অফিসার আমার বইটা হাতে নিল। উল্টে–পাল্টে দেখল। বলল, বাহ তোমার বইটা খুব সুন্দর। কী নিয়ে এই উপন্যাস?
উত্তর রেডিই ছিল। গড়গড় করে বললাম, আমাদের সময়ের সম্পর্কগুলির নানা দিক নিয়ে ফিকশন।
বইটার পেছনে আমার একটা ছবি আছে। সে ছবিটা আঙুল দিয়ে আমাকে দেখাল। বলল, এইটা তোমার ছবি?
কেমন অপমানজনক কথা! এইটা আমার ছবি না তো কার ছবি?
আমি উদাস ভঙ্গিতে বললাম, হ্যাঁ।
সে বলল, ছবিটা কে তুলেছে?
আমি বললাম, আমার বন্ধু প্রিন্স।
সে বলল, তাকে বোলো সে খুব ভালো ছবি তোলে। খুব সুন্দর ছবি এইটা। তোমার বইটাও খুব সুন্দর। আশা করি, লেখাও ভালো হবে। আহা, আমি যদি বাংলা পড়তে পারতাম!
আমি হাসলাম। বললাম, আমি ফটোগ্রাফারকে বলব।
এরপর সে আমাকে যেন ভুলেই গেল। আমার পাসপোর্ট একবার বাম দিকে, একবার ডান দিকে, একবার ওপর থেকে নিচে, আরেকবার নিচ থেকে ওপরে; জি-বাংলার সিরিয়ালগুলিতে যেভাবে একই লোককে চারদিক থেকে বারবার দেখায় সেভাবে দেখতে থাকল। আমি চুপচাপ দাঁড়ায়ে থাকলাম। দশ মিনিট কেটে গেল। তার কোনো কথা নাই। যেন আমি নাই এ দুনিয়াতে।
দশ মিনিট পরে কী যেন বলল ওই পাশ থেকে! আমি ওই ইংরাজি বুঝি নাই। বললাম, সরি!
আবার বলল সে, ইন্ডিয়া কেন যাও এত?
আমি বললাম, আমার মায়ের বাড়ি ওই দিকে। আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করতে যাই।
সে বলল, থাইল্যান্ড গিয়েছিলে কেন?
আমি বললাম, ফ্যামিলি ট্রিপ। সবাই মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
সে বলল, ঠিক আছে। এবার তাহলে আমেরিকা ঘুরে আস।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এর মানে কী? ভিসা কি দিয়ে দিল?
সে আমার হাতে একটা নীল কাগজ দিয়ে দ্রুত কী যেন বলে গেল। আমি এর একটা বর্ণও বুঝলাম না।
বললাম, আমার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাব? অফিসের এনওসি?
মহিলা ভুরু কুঁচকে রুঢ়ভাবে বলল, কেন? আমি কি দেখতে চেয়েছি ওইগুলা? যাও এবার। অনেক লোক লাইনে।
খুবই অপমানজনক কথা। এরপর সেখানে দাঁড়ানো যায় না। কিন্তু আমি ওর কথা কিছুই তো বুঝি নাই। কাউন্টার থেকে সরে গেলাম। সেইখানের যে সিকিউরিটির লোক, সেইগুলার ব্যবহার খুব খারাপ। এদের আচরণ দেখলে মনে হয় এরা রাজা–বাদশা, এক এক জন নবাব সিরাজদ্দৌলার বংশধর। তারপরেও এই খারাপ লোকের একটাকেই ধরলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আমাকে কী বলল আমি তো কিছু বুঝি নাই। আমার কি ভিসা হইছে?
উনি বলল, আপনার পাসপোর্ট রাখছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ, রেখে দিছে।
উনি বলল, তার মানে ভিসা হয়ে গেছে। এই নীল কাগজটা পড়ে দেখেন। তারিখ আর স্থান লেখা আছে। সেখান থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নিবেন।
রুমের সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। পাশ থেকে দুই বুড়াবুড়ি বলল, বাহ, ওর ভিসা হয়ে গেছে! এত কম বয়সী মেয়েকে ভিসা দিল?
রাগে আমার জবান বন্ধ হয়ে গেল। এত কষ্ট করে মানুষের কাছ থেকে ধার করে ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকা রাখলাম, একবার স্টেটমেন্টটা দেখবে না? এতগুলি কাগজ সাথে করে নিয়ে আসছি—একটাও কাজে লাগবে না? যত্তসব!
বাইরে বের হয়ে রাস্তার মোড় পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। সেখানেই অন্যরা অপেক্ষা করতেছে। আমি তাদের বললাম, চলেন তাহলে টিকিট করতে যাই।
সবার চোখ কপালে উঠল! টিকিট মানে? তোমার কি ভিসা হইছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ। হইল বলেই তো মনে হইল।
ওরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বলল, মাই গড! কী লাকি! যার হবার কথাই না, তারই হইল। আমাদের সবার ভিসা তো রিজেক্টেড হয়ে গেছে।
শুনে আমি ঠিক কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাব বুঝতে পারতেছিলাম না। সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। কী জিজ্ঞাসা করছে আমাকে, কোন পেপার দেখতে চাইছে—প্রশ্নে প্রশ্নে আমি হয়রান। যখন বললাম, আমি আমার বইটা দিলাম মহিলাকে, সবাই ওহহহহ করে উঠল।
বলল, কী বুদ্ধিমান মেয়ে! নিজের বইটা নিয়ে আসছে! কোনো পেপারই দেখতে চাইল না অফিসার!
অদ্ভুত ঘটনা বটে। এরপর আমি একাই টিকিট করতে গেলাম। টার্কিশ এয়ারলাইনস। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুলে চার ঘণ্টা ট্রানজিট। সেখান থেকে নিউইয়র্ক।
ভিসা হবার পরেও আমার দুশ্চিন্তার শেষ নাই। কারণ আমার কপাল তো আমার সাথে আছেই! দেখা যাবে প্লেনে আমি উঠছি তাই প্লেনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিল। তুরস্ক না গিয়ে চলে গেল হনুলুলু কিংবা নিউইয়র্কের জায়গায় ব্রাজিল! তারপর এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হবে পাঁচ দিন!
কিংবা প্লেন হাইজ্যাক হইল! অথবা নিখোঁজ হয়ে গেল মালয়েশিয়ার প্লেনটার মতো।
এসব আশঙ্কা নিয়েই জুন মাসের ভোররাতে ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুলে রওনা দিলাম। বাংলাদেশ থেকে এত লোক তুরস্ক যায় আমার ধারণাই ছিল না। বেশির ভাগই স্টুডেন্ট। আবার মহিলাও অনেক আছে, যারা কাজ করতে যায়। ছয় ঘণ্টা পরে প্লেন যখন ইস্তাম্বুল নামল, জানালা দিয়ে ওই শহর দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। সব বাড়ির ছাদ কমলা কি গোলাপি—নাম জানি না সেই রঙের, কী যেন একটা মিষ্টি রং। এয়ারপোর্টে নেমে আমি আরেক দফা অবাক! এত দারুণ সব সুদর্শন ছেলেরা ইমিগ্রেশন অফিসার! এদের বয়স বড়জোর ২৩–২৪ হবে! এরা আমার কাগজপত্র খুঁটায়ে খুঁটায়ে দেখল। আমিও সেই ফাঁকে তাদের দিকে হাঁ করে তাকায়ে থাকলাম। তখনো আমি বুঝি নাই, এইটাই আমার আসল ইমিগ্রেশন। আমেরিকায় আর ঝামেলা নাই।

অনেক লোক এয়ারপোর্টে। চারদিকে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির সুন্দরী সব টার্কিশ মেয়ে। আমাকে আরও দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। একটু খিদা পেয়ে গেছে। খাবারের দোকান আছে। কিন্তু একটা খাবারও আমি চিনি না। ভয়ে তাই কিছু কিনতেও পারতেছি না। টার্কিশ একটা মিষ্টিজাতীয় খাবার আছে। খুব বিখ্যাত। নাম বাকালভা। কিন্তু মিষ্টি আমি ঠিক পছন্দ করি না। এই দিকে আমার ওয়াই–ফাইও দরকার। বাসায় জানাতে হবে আমি ঠিকঠাক আছি। একটা ওয়াই-ফাইওয়ালা দোকানে ঢুকে একটা স্যান্ডউইচ আর কফি অর্ডার করে ফোনের ইন্টারনেট চালু করলাম। করতে করতেই একটা পানি কিনে খাইলাম। পানির দাম ৬০ লিরা। ইন্টারনেটে চেক করে দেখি দেশের টাকায় ৯০০ টাকা। মনে মনে কসম খাইলাম, এ জীবনে আর এয়ারপোর্টে কিছু খাব না। 

নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে লেখক
নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে লেখক


ইস্তাম্বুল থেকে জেএফকে এয়ারপোর্ট সাত ঘণ্টার মতো লাগবে। এত লম্বা জার্নিতে কোন লোক যে আমার পাশে পড়বে—এইটা নিয়ে আমার একটু চিন্তাই হইতেছিল। প্লেনের ভ্রমণে সারা জীবন আমার দুইটা ভয়। 
এক, দুইটা ইয়া মোটা লোকের পাশে যদি আমার সিট পড়ে! 
দুই, এয়ারপোর্টে (বাংলাদেশে, বিশেষ করে কক্সবাজারে) সিকিউরিটিরা হাত দিয়ে সারা শরীর চেক করার নামে যাত্রীদের যেভাবে হাতায়, সেটা বিরাট অস্বস্তির ব্যাপার! 
আমার সিট পড়ল জানালার পাশে। মাঝখানের সিট খালি। আইল সিটে এক বুড়া সাদা লোক। তার মাথায় একটা অদ্ভুত ধরনের টুপি। 
আমি জীবনে কাউকে এ রকম ছোট টুপি পড়তে দেখি নাই। বুড়াটা মনে হয় টাক। টাক মাথা ঢাকতে অনেকেই তো টুপি পরে। কিন্তু এই টুপিটা আমাদের দেশের হুজুরদের টুপির মতো, রংটা অবশ্য কালো। ঠিক মাথার তালুটা ঢেকে রাখা সাইজের টুপি এইটা। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলতে লাগল, সে একটা অতিরিক্ত ধার্মিক লোক। এইটা তার ধর্মীয় কোনো ব্যাপার। কিন্তু কোন ধর্মের এমন অদ্ভুত টুপি হতে পারে, সে ব্যাপারে কিছুই আমার মনে পড়ল না। 
সে আমার দিকে তাকায়ে সৌজন্যের হাসি হাসল। তারপর বলল, তুমি বাথরুমে যেতে চাইলে আমাকে ডেকে দিয়ো। 
কিসের বাথরুম, কিসের কী! ছয়টা ঘণ্টা আমি কম্বল গায়ে দিয়ে গভীর ঘুম। যেমন তেমন ঘুম না, মাঝখানের খালি সিট দখল করে ঘুম! যখন ঘুম ভাঙল দেখি টুপিওয়ালা বুড়োটা একটা বই পড়তেছে। আমাকে জাগতে দেখে আবার হাসল। তারপর মাঝের সিটের ট্রে-টা দেখায়ে বলল, তোমার খাবার এখানে রেখেছি। তুমি কি ভেজ না নন-ভেজ আমি তো বুঝতে পারছিলাম না, তাই চিকেন নিয়েছি। তুমি ভেজ হয়ে থাকলে আমার খাবারটা নিতে পারো। আমি দুটোই খাই। আর একটা ওয়াইন রেখেছি। হুইস্কি খেলে এয়ার হোস্টেসদের ডেকে নিতে হবে। আমি খুবই দুঃখিত তোমার অপছন্দের খাবার নিয়ে থাকলে। 
আমি খুবই অবাক হয়ে গেলাম। তার মতো রসকষহীন চেহারার বুড়ো দেখলেই আমার কেন যেন মনে হয়, এরা সারা দিন অন্যকে ধমকায়, আর বকবক বকবক করে। আমি বোধহয় এই দুঃখেই এভাবে ঘুমায়ে গেছিলাম। এই বুড়া তো বকবক দূরের কথা, কী যত্ন করে আমার জন্য খাবার রেখে দিল! 
আমি মাথা নেড়ে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর এক ঘণ্টা পরে প্লেন থেকে নামতে দিল আমাদের। বসে থাকতে থাকতে এমন না বিরক্ত লাগতেছিল! নামার সময় বুড়োটা আমার লাগেজ ওপর থেকে নামায়ে দিল। আমি অসম্ভব লজ্জা পাইলাম। আমি ইয়াং মানুষ, কোথায় আমি ওর লাগেজ নামায়ে দিব! ছি ছি ছি। 
এমন সময় মনে পড়ল কোথায় আমি এমন টুপি দেখছি। সিনেমায়। ইহুদিদের মাথায়। এগুলার নাম ‘ইয়ামাকা’ টাইপের কিছু হবে। জীবনে প্রথম কোনো ইহুদি লোক দেখলাম। আমি তাকে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে গেলাম। 
এয়ারপোর্ট না যেন কারওয়ান বাজার। এত মানুষ সেখানে! কেউ কালো, কেউ সাদা, কেউ বাদামি। তবে লাইন ধরানোর বেশির ভাগ লোকগুলাকে দেখে মনে হইল, ইন্ডিয়ান। 
একা একা ট্রাভেল করা আমার কাছে ডালভাত। কিন্তু ভয় এই ইমিগ্রেশন। সবাই আমাকে বলছে, ওরা অপমানজনকভাবে চেক করে, অমুক জানতে চায়, তমুক পেপার চায়! 
ইমিগ্রেশনে একটা কথাও বলে নাই। আমি ভাবছিলাম, আমি মেশিনে ঠিকমতো পাসপোর্ট ঢুকাতে পারব না। উল্টা ঢুকাব। সেটা হয় নাই। চোখ স্ক্যান করার সময় মনে হচ্ছিল আমার চোখ বারবার বন্ধ হয়ে যেতে চাচ্ছে। ভাগ্যিস হয় নাই। সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। 
ঝামেলা হইল লাগেজ নিতে এসে। হাজার হাজার ট্রলি কিন্তু কিছুতেই আমি একটা ছুটাতে পারলাম না। আমার তিনটা লাগেজ। লাগেজভর্তি বই। এইগুলা টেনে নিয়ে বাইরে বের হওয়া আমার একার পক্ষে অসম্ভব। তাই এই রুগ্ণ দুস্থ শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে ট্রলি ছুটানোর চেষ্টা করলাম। ট্রলি আমাকে পাত্তাই দিল না। 
অথচ আমার চেয়েও রুগ্ণ এক সাদা মেয়ে এসে যখন একটা ট্রলিকে টাচ করল, তখন সেটা গড়গড় করে ওই লাইন থেকে সামনে বের হয়ে আসল। আমি তো হাঁ হয়ে গেলাম। কী রেইসিস্ট ট্রলি! কেন রে বাবা, তোকে যে আমি এতক্ষণ জীবন দিয়ে টানাহেঁচড়া করলাম! 
আমি মেয়েটাকে বললাম, এক্সকিউজ মি, আমারও তো একটা ট্রলি দরকার। আমি তো কোনোভাবেই বের করতে পারতেছি না। আমাকে কি একটু সাহায্য করবে? 
মেয়েটা আমাকে পাশের লাল বাক্স দেখায়ে বলল, এখানে পে কর। ট্রলি আপনাআপনিই তোমার কাছে চলে আসবে। 
মনে মনে নিজের হাবলামির জন্য নিজেকে শাসালাম। ইহা আমেরিকা মামা, বাংলাদেশের মতো সব ফ্রি ফ্রি পাইছ নাকি? 
লাগেজ নিয়া বের হয়ে যাইতেছি ঠিক, এমন সময় চোখাচোখি হইল এক সাদা রঙা, নীল চোখা কাস্টমস অফিসারের সাথে। আমাকে দেখে সে ভুবন ভোলানো হাসি হেসে বলল, কোন দেশ থেকে আসছ? 
আমিও হেসে বললাম, বাংলাদেশ। 

ফ্রিডম টাওয়ারের সামনে লেখক
ফ্রিডম টাওয়ারের সামনে লেখক

সে চোখ কপালে তুলে বলল, ব্যাংলাড্যাশ? আসো আসো আমার সাথে আসো। 
ওর ভাব দেখে মনে হইল এইমাত্র ও একটা মফিজ পাইছে। 
হাঁটতে হাঁটতে বলল, have you brought mangoes from your bangladesh? 
আমি স্পষ্ট শুনলাম ম্যাঙ্গো। কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস হইল না। আম নিয়া আসব কেন! আমি কি রাজশাহীর লোক! 
আমাকে কোনো দিন কোনো এয়ারপোর্টে কাস্টমসের লোক ধরে নাই। এই প্রথম। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। 
তাই বললাম, sorry. What do you mean? 
সে হাত দিয়ে বাতাসে গোল গোল চিহ্ন এঁকে বলল, mango! Delicious fruit of Bangladesh. Haven’t you bring some mango from your country? 
আমি বললাম, no. No fruits, no foods. Only books. 
সে চেহারা বানায়া বলল, are you sure? No mango? Dried fish? 
আমি আবার বললাম, no, no, no foods. I am a writer. Came here for a book signing. I’ve brought books only. You can check. 
ততক্ষণে স্ক্যানারের সামনে পৌঁছে গেছি আমরা। অফিসার ওইখানের লোকগুলারে চোখ টিপে বলল, ব্যাংলাড্যাশ থেকে আসছে। 
ও আর ওর কলিগদের হাসাহাসির মানে ছিল এ রকম—বাংলাদেশ থেকে আসছে মফিজ। আর লাগেজ ভরে আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-পেয়ারা আনে নাই! চিড়া মুড়ি খই, খাওয়ার শেষে দই—আনে নাই! তা কি হয়! 
আমিও মনে মনে বললাম, কার পাল্লায় পড়ছ তো জানো না। এই হাসির মজা দেখাচ্ছি তোমারে। 
অফিসারকে বললাম, mango–কে আমাদের ভাষায় আম বলে। আমার লাগেজগুলা অনেক ভারি আমি ওঠাতে পারি না। তুমি একটু কষ্ট করে মেশিনে উঠায়ে দাও। 
ও বলল, sure sure. I’m doing this. But are you sure there’s no aamh, your favourite fruit! 
যেন আমি ওর তালতো বোন! মশকারি করে। 
বলে লাগেজ ওঠাতে গিয়ে টের পেল মশকারি কাকে বলে। তিনটা লাগেজ ওই উঁচু মেশিনে দিতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেল ওর। বলল, too heavy. 
এবার আমার পালা। আমি বললাম, foods aren’t heavy. Books are. 
বলে উল্টা পাশে গিয়ে আমার ট্রলি নিয়ে গিয়ে সেটার ওপর হাত রেখে দাঁড়ালাম। এর মানে আমার লাগেজ আবার ট্রলিতে উঠায়া দিবি। আমি লাট সাহেবের মেয়ে। এত কষ্টের কাজ করতে পারি না। 
কিছু বলতে অবশ্য হয় নাই। বেচারা লজ্জায় কাঁচুমাচু করে নিজেই উঠায়া দিছে। আর বলছে, আমেরিকায় অনেক মিষ্টি ‘আম’ আছে। তুমি অবশ্যই খেয়ো। বেস্ট অব লাক। 
আমি বাইরে বের হয়ে দেখি অনেক লোকের মাঝখানে আমার আমেরিকান উকিল বাপও দাঁড়ানো। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। আমি ভাবলাম, ওরে বাবা, এসেই পড়লাম না ফেরার দেশে! 
পার্কিংয়ে যেতে যেতে আমার রেইসিস্ট ট্রলির গল্পটা আমার বাপকে বললাম। সে হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেল। আমাকে বলল, গ্রাইম্যা কোথাকার! 
এমন সময় দেখলাম আমার সহযাত্রী টুপিওয়ালা বুড়োটা পাশের গাড়িতেই উঠতেছে। আমি আমার বাপকে বললাম, এই লোকটা আমার পাশে বসছিল। খুব হেল্পফুল। আচ্ছা, ও কি ইহুদি? 
আমার বাপ অনেক কষ্টে রাগ চাপল। বলল, হ্যাঁ। ওরা সাধারণত খুব ভালো হয়। কিন্তু ও ইহুদি কি না, এইটা দিয়া তোর দরকার কী? 
আমি বললাম, আরে, আমি ওর মতো টুপি পরা লোক তো জীবনে দেখি নাই। ওর টুপিটা দেখে আমার এমন হাসি পাইছিল। মানুষ কি শুধু টাকের জায়গার তালুতে টুপি পরে নাকি? 
আমার আমেরিকান বাপের মাথা চকচকে ফুটবল স্টেডিয়াম। তার প্রধান নেশা নানা ধরনের টুপি কেনা। আমার এ কথায় সে দাঁত কিড়মিড় করে আমার দিকে তাকাল। বলল, এইটা টুপি না। ইয়ামাকা। গাধা কোথাকার। 
বিকাল চারটা বাজে তখন। ঝলমলে রোদ নীল আকাশে। তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাস্তা বেশ বড়, অনেক গাছ পালা, ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে কয়েকটা বাড়ি দেখা যায়। সব দোতলা কাঠের বাড়ি। রাস্তায় একবারও ঝাঁকি লাগে নাই। আর রাস্তা সব উল্টা। মানে আমাদের ড্রাইভাররা গাড়িতে বসে ডান দিকে, ওরা বসে বাম দিকে। রাস্তা সব বাম লেইন। সব রাস্তার ওপরে সবুজের ওপরে সাদা রঙে নানা কিছু লেখা আছে। কোন রাস্তা সামনে, ডান দিকে কয় নাম্বার এক্সিট। আমার বাপ গুগল খালার কথা শুনে শুনে গাড়ি চালাচ্ছিল। চারদিকে কোনো ময়লা নাই, মানুষও নাই। তবু বিদেশ বিদেশ টাইপ কিছু মনে হইল না আমার। 

একটা বড় ইটের দালানের পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার বাপ বলে উঠল, এইটা মেন্টাল হসপিটাল। ভালো করে চিনে রাখ। এইটা হলো নিউইয়র্কের পাবনা মেন্টাল হসপিটাল। 
আমি বললাম, কেন? এইটা চিনে আমি কী করব? 
নির্জন একটা রাস্তা। যেসব চার লেন, ছয় লেনের রাস্তা পার করে আসলাম, সে তুলনায় এটা খুবই ছোট। চারপাশে ঘন হয়ে আসা গাছপালা। আমার বাপ একদিন এই রাস্তায় হারায়ে গেছিল। তখন সন্ধ্যা। তার ওপর তার সাথে গাড়ি ছিল না। পুরা পথ হেঁটে হেঁটে ভয়ের চোটে জান হাতে নিয়ে বাসায় গেছে সে। সেটা কি ভূতের ভয়ে নাকি হাসপাতাল থেকে পালানো পাগলের ভয়ে—জানতে চাইলাম, কিন্তু বাবা বলতে রাজি হইল না। 
এমন সময় দেখলাম একটা দামি গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনের জানালা থেকে একটা কুকুর মুখ বের করে আছে। খুব সুন্দর একটা ছোট্ট কুকুর, গা–ভর্তি চুল, আমি কুকুরের প্রজাতি চিনি না, দেখে বেশ দামি কুকুরই মনে হলো। কুকুরটা জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাতাস লাগাচ্ছে ওর চুলে। এ রকম দৃশ্য আমি জীবনেও দেখি নাই। বাংলা সিনেমায় কখনো কখনো নায়কের ছাদখোলা জিপে নায়িকাদের এমন আরামের ভঙ্গি করতে দেখা যায়। তবে কুকুরকে? কুকুরের এমন শ্যাম্পু করা সোনালি চুল নায়িকাদেরও হয় না। 
এতক্ষণ এত মানুষ দেখে, রাস্তা দেখে, গাছ দেখে, বাড়ি-গাড়ি দেখে আমার যেইটা মনে হয় নাই, এই প্রথম আমার সেইটা মনে হইল—আমি একটা অদ্ভুত দেশে এসে পড়ছি। যেইখানে কুকুরেরা গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে আপন মনে হাসে!