রি-বর্ন ডল

সিলভিয়া ভেবে পায় না মেরিলিনকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চাইলেই এত বিরক্ত হয় কেন রোমেল! মেয়েটাকে একদম ভালোবাসে না ও। অবহেলার এই ভাবনা মেয়ের প্রতি আরও মনোযোগী করে তোলে সিলভিয়াকে। সে দিনরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায় মেরিলিনের অনাহূত অবস্থান। মেয়েটার বুনো ঝোপের মতো কফিকালো আর কোঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ে আঁচড়ে মাথার দুপাশে টেনে ঝুঁটি করে দেয় সে গোলাপি রিবন দিয়ে। রোমেলকে শুনিয়ে শুনিয়ে মেরিলিনকে বলে, ‘মেরি, মাই লাভ, আজকে আমরা তোমার চাচার বাসায় যাব। চাচার বাসা না বলে চাচির বাসা বলাই ভালো, কারণ তোমার চাচা হচ্ছেন তোমার চাচির হাতের পুতুল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে পুতুল তোমার চাচির খুব অপছন্দ। এটাও একটা কারণ হতে পারে, যে কারণে তিনি আমাকে দেখতে পারেন না। যাই হোক, তবু আমরা তোমার চাচির বাসায় বেড়াতে যাব—যেমন প্রতি মাসে একবার যাই। আমরা বাসায় ঢোকার পর ওনাকে খবর দেওয়া হবে। উনি দোতলার মার্বেলসিঁড়ি দিয়ে চারদিকে চার্ম ছড়াতে ছড়াতে এমনভাবে নেমে আসবেন যেন আমরা তাঁর দর্শনার্থী—তার দেখা পাওয়ামাত্র আমাদের বেবাক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারপরে তাঁর চোখ পড়বে তোমার দিকে। অপরিসীম বিরক্তি নিয়ে চোখ কুঁচকে তিনি বলবেন, আবার মেরিলিনকে আনলে কেন? এনিওয়ে সিলভিয়া, ইউ আর লুকিং লাইক আ ডিভা। হা হা হা। এই হাসিতে যে কটাক্ষ আছে, তা আমার বুককে সবজি ঘষার গ্রেটারের মতো ঝাঁজরা করে দেবে, কিন্তু তোমার বাবা কিচ্ছুটি বলবে না। কারণ, তিনিও তোমার চাচির হাতের পুতুল। ওনারা দুজন একই মতের মাতব্বর,’ বলতে বলতে বেবির ডায়াপার চেঞ্জ করতে বসে সিলভিয়া। ডায়াপারের স্ট্রাপটা লাগানো শেষ করে তাকায় রোমেলের দিকে, ‘তুমি ঠিক করে দাও আজকে মেয়েটাকে কোন ফ্রকটা পরাব। এই যে এই সাদা ফ্রিল দেওয়া ড্রেসটা, এটা পরালে মেরিলিনকে দেখতে লাগে রাজহাঁসের মতো—শুভ্র, গর্বিত, ব্যক্তিত্বময়ী। আর এই গোলাপি এ লাইন ড্রেসটা পরলে ওকে মনে হয় স্ট্রবেরি মিল্কশেক, না হয় তো ব্লসম—পাওয়ারপাফ গার্লসের ‘ব্লসম’—ব্লসম নিজেও একজন সুপার হিরো এবং তারকাছে কিনা সবকিছুই খুব সুন্দর। আসো, আমার কাছে আসো। কোন ড্রেসটা পরাব বলো তো?...আচ্ছা থাক এত বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। বলতে হবে না তোমাকে। এই পিংক ড্রেসটাই পছন্দ আমার মেরির। এই ড্রেসটাই পরবে আমার মাম্মাটা।’

জামা পরাতে পরাতে সিলভিয়া মেরিকে বুকে টেনে নেয়, ‘দেখেছ কী দুষ্টু হয়েছে মেয়েটা আমার? কিছুতেই মোজা পরাতে পারি না তাকে। নাহ্! সে শুধু নিজের পা নিয়ে মুখে পুরে দেয়। আর ভু-বু-উ-উ করে। টুকুন বুড়ি এইটা আমার, টুকুস বুড়ি, নাম্পা সোনা চাঁদের কণা। এই মেয়ে, এই, মা বল। বল মা-আআআ! আমি তোমার মা হই গো। তুমি আমার মেয়ে। আমার মেরিলিন, আমার সুপার স্টার। আমি তোমাকে সব সময় ফলো করি—তোমার ইউটিউব ব্লগস, তোমার ইনস্টাগ্রাম, তোমার ফেসবুক পেজ—সব। আমি তোমার ফ্যান গো ফ্যান,’ বলে মেরিলিনের চুলের গন্ধ নেয় সিলভিয়া।

রোমেল দেখতে পাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে আরও আরও বেশি মা হয়ে উঠছে সিলভিয়া বাচ্চা পুতুলটাকে নিয়ে। ঘটনাটার শুরু তাকে দিয়েই। রোমেলের কাছে এই সংসারটাই সব। এটিই তার দুনিয়া। এটিই তার ইউনিভার্স। ফস্টার হোমে বড় হওয়া রোমেলের অনেক কষ্ট। অনেক ট্রমা। মানুষের প্রতি বিশ্বাস তার খুবই নড়বড়ে। একমাত্র সিলভিয়াকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে সে কেন যেন। নিজের বাবার কথা জানেনা সে, জানতেও চায় না। মনে হয়, আরেকটি জঘন্য কৃমিকীট, তাকে নিজ চোখে না দেখলেও জীবনটা চলে যাবে তার। তবে মায়ের জন্য বড় কষ্ট হয় রোমেলের। মায়ের ডায়েরি পড়ে জেনেছে সে, বাবাই মাদকাসক্ত করে তুলেছিল তার ষোড়শী মাকে। তারপর বিভিন্নভাবে লোকটা মাকে ব্যবহার করত নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য। তাই ওই লোকটাই যে তার বাবা, সে ব্যাপারে তার নিজেরও সন্দেহ আছে। আসলে খুব ভিতু ছিল তার মা। দু-দুটো বাচ্চা ছেলে নিয়ে মহিলা কুঁকড়ে থাকতেন সংসার আর স্বামী হারানোর ভয়ে। রোমেল হওয়ার সময়ই প্রচণ্ডভাবে আসক্ত ছিল তার মা, তাই জন্মের পর রক্তসূত্রে আসক্তিটা পায় সে। এখন রোমেল বুঝতে পারে, এ ধরনের বাচ্চারা খুব বিরক্তিকর হয়, সারা দিনমান কাঁদে। মায়ের পেটে থাকার অভ্যাস—ড্রাগস চায় শিশুর শরীর। অভাবে কষ্ট হয়। কাঁদে। সরকার থেকে এ ধরনের বাচ্চাদের স্নেহযত্ন দেওয়ার জন্য, দেখাশোনা করার জন্য দয়ালু স্বেচ্ছাসেবী মানুষদের আহ্বান করা হয়। ধীরে ধীরে একসময় ড্রাগের প্রভাব থেকে মুক্ত হয় এ শিশুরা, কিন্তু আসলেই মুক্ত হয় কি! সে নিজে কি মুক্ত হয়েছে তার অভিশপ্ত জন্মের প্রভাব থেকে? নাকি আসক্তির মতো সেই মাতৃগর্ভের স্মৃতিগুলোই শাসন করে চলেছে তার বর্তমান। তাই নিজেকে এরং সিলভিয়াকে লুকিয়ে রাখে সে সবার থেকে।

সংসারটা তার খুব ভালোই চলছিল, সব ঠিকঠাক। কিন্তু সমস্যা হলো—সিলভিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলোনা—তাদের সন্তান হবে না কোনো দিন। এই বাস্তবতা হজম করার চেষ্টায় খুব ম্রিয়মাণ আর ক্ষীণকায় হয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু তারা তো একজন আরেকজনকে ভালোবাসবে বলে, একে অপরের অপূর্ণতা মেনে নিয়েই নিজেদের আনন্দে রাখবে বলে এমন একাত্ম হয়েছে। তাই সিলভিয়ার মন রাখতেই একটা বাচ্চা জোগাড়ের জন্য রোমেল খুঁজতে শুরু করে সব কটি অ্যাডপশন সেন্টার। কেউ বাচ্চা দিতে রাজি হয় না তাদের। বিরক্ত হয়ে ওঠে রোমেল রিজেকশনের সম্মুখীন হতে হতে। তারপর একদিন অদ্ভুত এক ওয়েবসাইটের খোঁজ পায় সে, নাম ‘রি–বর্ন ডলস’। এখানে যে পুতুলগুলো পাওয়া যায়, তারা দেখতে সত্যিকারের মানুষের মতো। একদম নিখুঁত, অবিকল মানুষের বাচ্চা। অনেক নিঃসন্তান দম্পতি বা সন্তান হারানো পোস্ট-ট্রমাটিক পিতা–মাতা এ ধরনের পুতুল তাদের কাছে নিয়ে রাখেন। তারা পুতুলগুলো যত্ন করে খাওয়ান, ডায়াপার চেঞ্জ করে দেন, এমনকি শপিংয়ে বেড়াতে নিয়ে যান। অনেকবার নাকি এমনও হয়েছে যে গাড়িতে লক করে রেখে যাওয়া রি-বর্ন ডল দেখে পথচারী কেউ শিশুটিকে উদ্ধার করতে পুলিশে ফোন করেছে। পুলিশ এসে শেষে দেখে, মানবপুতুল। ইউটিউব ভর্তি অনেক ব্লগও আছে এ ধরনের পুতুলশিশুদের নিয়ে। একাধিক রি-বর্ন ডলও পালন করেন কেউ কেউ। ভালোবাসা তৈরি হয় পুতুলগুলোকে ঘিরে আর পুতুলগুলোও নিশ্চয়ই একাকিত্ব ঘোচাতে পারে বাবা-মায়েদের।

সিলভিয়ার মাতৃত্বকে সম্মান করে এমন একটা কাস্টম-মেড রি-বর্ন ডল অর্ডার দেয় রোমেল। তারপর থেকেই বদলে যেতে শুরু করেছে সিলভিয়া। পুতুলটার নাম রেখেছে সে ‘মেরিলিন’। মেরিলিন মনরো থেকে মেরিলিন—সিলভিয়ার প্রিয় তারকা। নার্সারি বানিয়েছে সে ঘরের একটা কোনায়। সেখানে মেরিলিন মনরোর একটা বাণী বাঁধিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছে। তাতে লেখা—‘I am trying to find myself. Sometimes that's not easy.’ যত দিন যাচ্ছে, সারা দিন খালি মেরিলিন আর মেরিলিন। একদিন রাতে সিলভিয়া বলল, মেয়ের জ্বর। রাত দুটোর সময় বাধ্য হয়ে ওষুধ নিয়ে আসতে হলো। পাগলামি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে শত্রু হয়ে উঠেছে রোমেলের একমাত্র ভাই, যে কিনা পৃথিবীর সঙ্গে রোমেলের একমাত্র যোগসূত্র। এমনিতে প্রায় সারা দিনই ঘরের ভেতর বসে কাটায় রোমেল। তা মাসে একবারও কি সে তার ভাইয়ের বাসায় যেতে পারে না? তাতেও কেন বাধা দিচ্ছে সিলভিয়া? রোমেল শুনল, সিলভিয়া মেরিলিনকে বলছে, ‘তোমার চাচা–চাচি আসলে তোমার বাবাকে নিয়ে যেতে চায় তাদের কাছে। আমাদের থেকে দূরে অনেক দূরে।’

আর সহ্য করতে পারল না রোমেল। এবার চিত্কার করে ওঠে সে, ‘দোহাই লাগে সিলভিয়া, সিলভি আমার, একটু চুপ করো। আমরা কোথাও যাচ্ছি না। আর কোনো দিন কোথাও যাব না। তুমি যেভাবে ভালো থাকো, শান্তিতে থাকো, সেভাবেই থাকব আমরা। শুধু সুস্থ হয়ে ওঠো ছোট্ট পাখিটা আমার। আমরা কেউ কাউকে কষ্ট দেব না। কখনো লড়াই করব না, কখোনো না। নো ঝগড়াঝাঁটি, সব সময় একসঙ্গে থাকব আমরা।’ হেসে ফেলল সিলভিয়া, ‘দেখো তো মেরিলিনকে ছাড়া ফ্যামিলি সেলফিটা সম্পূর্ণ হয় আমাদের? আসো আমার বেবিকে মাঝখানে নিয়ে একটা ছবি তুলি, তারপর আপলোড করব ওর ফ্যান পেজে।’ রোমেল কোলে তুলে নিল মেরিকে। চুমু দিল কপালে, চোখের পাতাটা যেন একটু কেঁপে উঠল মেরির। সিলভিয়া ঠিকই বলে, মেরির চোখ দুটো একদম তার মতো গোল গোল হয়েছে। কাস্টম–মেড পুতুলটা সিলভিয়া আর তার ছবি দেখে বানানো। তাদের জেনেটিক সন্তানের মতো করে।

রোমেল মেরিলিনকে নিয়ে বসতেই যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলতে গেল রোমেল, মেরিলিনকে কোলে নিয়েই। ডোরহোল দিয়ে দেখে নিল ভাইয়া এসেছে দরজায়। পেছনে আরও দুজন মানুষ—তাদের মুখ পাথরের মতো শক্ত। আতঙ্কিত মুখে ফিসফিস করে রোমেল ডাকল সিলভিয়াকে, ‘সিলভি, ওরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।’ সিলভিয়া দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল রোমেলকে। দরজায় দমাদ্দম বাড়ি পড়ছে। সিলভিয়া ভয় পাচ্ছে। মেয়েটার চোখ দুটোও যেন ভয়ে আর আতঙ্কে গোলাপি হয়ে উঠছে। সিলভিয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে নিল। বলল, ‘তুমি–না বলেছিলে মাসে মাসে গিয়ে দেখা করে এলে ওরা আর আমাদের বিরক্ত করবে না!’ রোমেল সিলভিয়াকে নিয়ে সোফায় বসাল, তাকে জড়িয়ে ধরে মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমি সারা জীবন যে নির্ভরতা খুঁজেছি, তা তুমি আমাকে দিয়েছ। আমাকে আমার মতো করেই ভালোবেসেছ। আমরা সব সিদ্ধান্ত দুজনে মিলে নিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার একবারের জন্যও মনে হয়নি তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কারও কাছে চলে যাবে। আমি যে জীবনের, যে সংসারের স্বপ্ন দেখেছি, তুমি তাইই দিয়েছ আমাকে। এখন শোনো, কয়েক মাস পরে ওরা আমাকে আবার ছেড়ে দেবে। তুমি অধৈর্য হয়ো না। তুমি আর মেরিলিন আমার জন্য অপেক্ষা কোরো।’

সিকিউরিটি থেকে ডুপ্লিকেট চাবি এনে দরজা খুলে ঢুকে পড়েছে ভাইয়া। আর পাথর-লোকগুলো ঘিরে ফেলেছে তাদের। নির্বিবাদে উঠে পড়ল রোমেল। স্ত্রী-সন্তানের সামনে কোনো ভয়ংকর দৃশ্যের অবতারণা হোক, চায় না সে। ভাইয়া চিত্কার করে বলল, ‘তুই দরজা খুলছিলি না কেন? তোর প্রতি মাসে কাউন্সেলিং করতে যাওয়ার কথা, যাসনি কেন? বাসাটা কেমন গার্বেজ করে রেখেছিস! চারদিকে পুতুল। কী ধরনের পাগলামি এসব? মেডিকেল থেকে লোক এসেছে, তোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না কেউ। আমাকে ডেকে আনল। আবার তোকে ছয় মাসের জন্য অ্যাসাইলামে থাকতে হবে। আমার কিচ্ছু করার নেই।’ লোক দুটোর সঙ্গে যেতে যেতে বিড়বিড় করে রোমেল বলল, ‘তোমরা যে পৃথিবীতে থাকো, সেটাই অ্যাসাইলাম। আমি তোমাদের মতো স্বর্গের অপেক্ষায় থাকি না, আমি স্বর্গে থাকি। I am trying to find myself. Sometimes that's not easy.’

রোমেলকে নিয়ে লোকগুলো চলে যাচ্ছে, পেছনে পড়ে থাকছে রোমেলের সাজানো স্বর্গ আর দুটো পুতুল—একজন সিলভিয়া আর একজন তার কন্যা মেরিলিন। তাদের দুজনের চোখভরা জল। সত্যিকারের ভালোবাসা পেলে পুতুলও মানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ সেটা বুঝতে পারে না।