মোহেনজোদারো, উর্দুতে লেখা একুশের কবিতা

নওশাদ নুরী (ডানে) এবং শামসুর রাহমান
নওশাদ নুরী (ডানে) এবং শামসুর রাহমান

ভাষা কেবল মুখের জিনিস নয়, ভাষা হচ্ছে চেতনার শরীর। ভাষা না থাকলে চৈতন্য থাকে না। যা শুধু আমিই অনুভব করি, তা কোনো অনুভব নয়। যা অনুভব করি, তা অন্যকে বোঝাতে না পারলে, সেই না–পারার বেদনা বোঝাতে হয়। নয়তো অনুভব আদৌ অস্তিত্বমান হয় না। মির্জা গালিব যেমন বন্ধুকে অনুযোগ করে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘চিঠি যদি না–ই লিখবে, তবে কেন লিখবে না, সেটাই লিখে পাঠাও।’ না বলতে পারলে, বলতে না পারার বেদনা বলতে হয়।

নওশাদ নুরী এই দেশের মাটিতে এসেছিলেন নিজ মাতৃভূমি বিহার থেকে তাড়া খেয়ে। প্রগতিশীল লেখক সংঘের তরুণ কর্মী ছিলেন। ছিলেন কবি। সদ্য স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের জওহরলাল নেহরু যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবী তখন দুই শিবিরে বিভক্ত। এমনি করে মার্কিন শিবিরে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতায় তরুণ নওশাদ নুরী কবিতা লিখলেন, ‘দে দে রাম দিলা দে রাম, দেনেওয়ালা সিতারাম’। নেহরু যেন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রওনা হলেন। প্রগতিশীল লেখক সংঘের বিশাল খোলা সভায় সেই কবিতা পাঠ করলেন নুরী। এরপর পথে, ট্রেনে ভিখারিরা সেই গান গেয়ে ভিক্ষা চাইতে লাগল। হুলিয়া জারি হলো কবির বিরুদ্ধে। নওশাদ নুরী পালিয়ে আজকের বাংলাদেশে এলেন।

ছিলেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী। সাম্যবাদে মুক্তি বলে বিশ্বাস রাখতেন। ওদিকে ভারতে উর্দু ভাষা তখন নিজে রাষ্ট্রের কাছে কোণঠাসা হওয়া শুরু হয়েছে। লোকের মুখের সাধারণ ভাষাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্য ক্ষতিকর বলে ধরা হচ্ছে। ১৯৬৯ সালে মির্জা গালিবের মৃত্যুর শতবার্ষিকীতে ভারতে বহু ধুমধাম করে আয়োজন হলো। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তরে তখন বিদ্বেষের বিষ। কোণে কোণে ভাষার রাজনীতিতে বিভেদের আওয়াজ। এসব কাণ্ড দেখে একজন কবি, অতিজনপ্রিয় গীতিকার সাহির লুধিয়ানভি কবিতায় লিখলেন:

যে শাসনের কাল এই সজীব ভাষাকে দলে গেল
সেই শাসন কেন মৃতের জন্য দুঃখ করে?
গালিব তো নিজে উর্দুরই কবি ছিলেন
উর্দুকে নিষ্পেষণ করে গালিবের ওপরে করুণা কেন?
এ এক আজব কারবার! ইংরেজদের হাতে হিন্দু–মুসলমানদের জন্য আলাদা ভাষা তৈরি হলো—উর্দু আর হিন্দি। আসলে এই দুই নামে আলাদা দুই ভাষা ছিল না। একটা ভাষাকে ভেঙে দুই ভাষা তৈরি হয় ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। ভারতবর্ষের ভাগ হওয়ার বীজ বোনা হয় তখন থেকেই। এখন ভারতে উর্দু গাদ্দারের ভাষা। আর পাকিস্তানে সে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রগতিশীল কবি–সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষার পক্ষে অবস্থান নিলেন। তাঁরা সক্রিয়ভাবে বাংলার পক্ষে নিলেন। সেই সুদূর পূর্ব বাংলার উত্তরে পোস্টার লাগল দেয়ালে:
জুবানবন্দি নেহিঁ চলেগি, নেহিঁ চলেগি
(ভাষার মুখে কুলুপ আঁটা চলবে না, চলবে না।
সেই সাহির লুধিয়ানভির কবিতা নিয়ে দেয়ালে লেখা হলো:
জুল্ম তো ফির জুল্ম হ্যায়, বাঢ়তা হ্যায় তো মিট জাতা হ্যায়
খুন ফির খুন হ্যায়, টপকেগা তো জম জায়েগা
(অত্যাচার তো অত্যাচার, বাড়লেই তার পতন
রক্ত তো রক্ত, ঝরলেই তা দানা বাঁধে)

নওশাদ নুরী উর্দু ভাষার কবি। কিন্তু বায়ান্নর আন্দোলনে কলম ধরেছিলেন বংলা ভাষার পক্ষে
নওশাদ নুরী উর্দু ভাষার কবি। কিন্তু বায়ান্নর আন্দোলনে কলম ধরেছিলেন বংলা ভাষার পক্ষে

উর্দু প্রগ্রেসিভ রাইটারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রেস বিবৃতি দিল। উর্দু ভাষা উন্নয়নের সংগঠন সারা পাকিস্তান আঞ্জুমানে তরক্কিয়ে উর্দু সরকারের ভাষানীতির পক্ষ নিল বলে আঞ্জুমানের পূর্ব পাকিস্তান শাখা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিল।

এমন আবহ না হলেও নওশাদ নুরী কোন পক্ষে যেতে হবে ঠিক করতে ভুল করলেন না। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারির পরপরই কবিতা লিখলেন বাংলার জনগণের পক্ষে। সে কবিতার নাম—মোহেনজোদারো।
মোহেনজোদারো, সেই সিন্ধু সভ্যতার মরে যাওয়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এই নামের অর্থ, ‘মৃতদের ঢিপি’। সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু পত্রিকা ‘আফকার’–এর ১৯৫২ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ছাপা হয় এই কবিতা। আফকার মানে ভাবনা নামের এ পত্রিকায় ছাপা কবিতায় নওশাদ নুরী তাঁর বন্ধু, দেশবাসীদের আগাম সতর্কবার্তা জানাচ্ছেন। যেমন করে হারিয়ে গেছে দূর সেই অতীতের ভাষা, কোন অজানা কারণে, আজ আবার তেমনই কোন দুর্যোগ নেমে আসছে বাংলা ভাষার ওপর। বন্ধুরা, সাবধান। নিজেদের ভাষার যত প্রকাশ আছে, সব সামলে রাখো। যেন এই দুর্যোগের জোয়ার অতীতের মতো আর কোনো ভাষাকে মুছে ফেলতে না পারে।

এই কবিতা যখন লিখছেন, নওশাদ নুরী তখন সরকারি চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায়। জরুরি তলব এল। ফরমান পাওয়া গেল, ‘ঘোষণা দিয়ে এই কবিতা প্রত্যাহার করো, নয়তো চাকরি ছাড়ো।’ নওশাদ চাকরি ছাড়লেন। ফিরে এলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। নিজের স্বাধীনতা অর্জন করে এই ভূখণ্ড বাংলাদেশ হলো। ২০০০ সালে এই মানুষদের প্রতি বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে, নিজের মানুষদের মধ্যে শেষনিশ্বাস নিলেন নওশাদ নুরী।

মোহেনজোদারো
হয়তো কোন ঝড়
হয়তো কোন নদী
হয়তো বিজয়ী কেউ
হয়তো কোন লুটেরা
ধুলোর নিচে কৃষ্টির শহর
ধুলোর নিচে বুলি ভাষা
আর তাকে ঐতিহাসিকেরা!
লোকে বলে মৃতের টিলা
কোন মহামারি তো এসেছিল নিশ্চয়ই
কোন দুর্যোগ তো এসেছিল নিশ্চয়ই

আমার শহরের বাসিন্দারা!
নিজের পুঁথি, নিজের গীতা
নিজের নিজের লোককথা
নিজের নিজের গীতিমালা
নিজের নিজের বর্ণমালা
নিজের নিজের বুলি ভাষা
পাতা, পাথর, চামড়া, প্যাপিরাস
তামা, লোহায় লিখে রাখো
আবার এসেছে সেই মহামারি
আবার নেমেছে সেই দুর্যোগ