সংকটের কাব্যিক চিত্রায়ণ

যেকোনো কবি সময়কে জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে শব্দগুলো একত্র করে ফুটিয়ে তোলেন লেখনীর মাধ্যমে। কবি মাত্রই সময়ের ধারক। কবি জাতির ভাবনাকে ভাষায় প্রকাশ করেন, জাতির প্রয়োজন, সংকট ও সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেন। গ্রিক সাহিত্যে কবিকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার সঙ্গে তুলনা করা হয়।

সাম্মি ইসলাম নীলা একুশ শতকের উদীয়মান কবি, যাঁর কলম সময়ের সংকটকে চিত্রায়িত করতে পেরেছে উপমা ও উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে বাস করে ‘আরেক দুনিয়া’কে কল্পনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন কুয়াশামাখা বর্তমান সময়ের হাহাকার, সাবলীলভাবে অনভ্যস্ত জীবনে অবসাদেরও বর্ণনা করেছেন, দিনলিপি এঁকেছেন চরম সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে নিখুঁত শৈলী দিয়ে।

আবার এসব কলম চাইলেও বাদ দিতে পারে না শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করতে। ‘ধীরে এসো বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থে রয়েছে ৩১টি কবিতা। প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই বর্তমানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কবিতাগুলোয় রয়েছে প্রাণের আবেশ, রয়েছে জীবনের খণ্ড খণ্ড কিছু স্থির ও অস্থির চিত্র। অর্থাৎ একুশ শতকের জীবনের হাহাকার ও সংকটকালীন মুহূর্ত উঠে এসেছে স্বমহিমায়। এখান থেকে উতরে যাওয়ার আহ্বান কিংবা আকুতিও রয়েছে প্রবলভাবে সাম্মি ইসলাম নীলার কবিতায়। কবিতায় নীলা অন্য রকম একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে ‘আকাশের কোটি কোটি টুকরো’ নেমে আসবে, মানুষ শিখে নেবে আত্মরক্ষার কৌশল। সেখানে থাকবে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ কিন্তু কোনো ফুল থাকবে না। এই ফুল না থাকাকে কবি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন অন্যভাবে অর্থাৎ ‘মৃত দুনিয়ায় জীবন্ত ফুল থাকে না’। এখানে টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতার একটি অনুষঙ্গের প্রসঙ্গ সামনে আনা যায়। সেখানে বৃষ্টির শব্দ শোনা গেলেও বৃষ্টির ফোঁটা দেখা মেলে না। তবে ‘আরেক দুনিয়া’ কবিতায় কবি আশার সঞ্চারও করেছেন, এমন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে ‘বাস্কেট ভরতি ফুলের ঘ্রাণ’ থাকবে। 


‘বিধবা বেহালা’ কবিতায় ‘তুমুল শীত’ আর ‘কুয়াশার তোড়ে’র চিত্রকল্প উঠে এসেছে অনিন্দ্যসুন্দরভাবে। শীত আর কুয়াশার এতই তোড় যে মানুষ ডাকনাম ভুলে গেছে। শীত যেমন কষ্টে জর্জরিত সময়কে নির্দেশ করে, তেমনি কুয়াশা নির্দেশ করে সেসব উপাদান, যা জীবনে শীত নামিয়ে আনে, আনে দুঃখ ও দুর্দশা ইতিহাস।

‘ফড়িংয়ের চোখে পৃথিবী’ কবিতায় যাবতীয় হাহাকারের কথা তুলে ধরেছেন। ‘এত ক্ষুদ্র চোখে/তুমিও কি দেখতে পাও/যাবতীয় হাহাকার?’ তারপর বিভিন্ন চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি হাহাকারের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। হাহাকার কিংবা ‘বিশুদ্ধ মৃত্যুর ঋণ’ সবকিছুই সমাজের সংকটের রূপ মাত্র। ফড়িংয়ের ক্ষুদ্র চোখেও সেসব বাদ পড়ে না। একই রকমভাবে ‘পাগল’ কবিতায় মানুষ আর পাগলের পার্থক্য খুঁজতে ব্রত হয়েছেন কবি। অত্যন্ত সাবলীলভাবে বলেছেন, ‘চলো, মানুষ আর পাগলের মানে খুঁজি...’। দারিদ্র্যপীড়িত ও খাদ্যবঞ্চিত মানুষ যখন খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে, উচ্ছিষ্ট হলেও খেয়ে বাঁচতে চায়, সভ্যসমাজ তাদের পাগল বলে আখ্যায়িত করে। সমাজের এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজ ও সময় সচেতন কবি। এখানে লালগালিচায় হাঁটা মানুষদের সঙ্গে না-খেয়ে থাকা মানুষের তুলনামূলক বর্ণনাও এসেছে। ভোঁতা হয়ে যাওয়া মানুষীয় অনুভূতির কথাও উল্লেখ করতে তিনি ভোলেননি। মানুষ হতে চাওয়া লোকগুলো যখন খেতে চেয়েছে, তখন তাদের পাগল আখ্যা দেওয়া মানুষদের প্রসঙ্গ এনে ঐশ্বরিক সাহায্যের জন্য হাত পেতেছেন কবি। এ কণ্ঠস্বর মূলত দলিত ও পীড়িত মানুষের, এ কণ্ঠস্বর আমাদের নজর এড়িয়ে যাওয়া হাজারো জনগোষ্ঠীর।


ধীরে এসো বসন্ত
সাম্মি ইসলাম নীলা
পাঞ্জেরী প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
দাম: ১২০ টাকা

‘এ কেমন জীবন’ কবিতায় কবি অবসাদের বর্ণনা দিয়েছেন। ‘রেলগাড়ি আসে/রেলগাড়ি যায়’ লাইন দুটি কবিতায় পাঁচবার ব্যবহার করেছেন। রেলের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে কবি ক্লান্ত, তার কোনো পরিবর্তন আসেনি। রেলগাড়ি গতিশীল জীবনের প্রতীক। রেলগাড়ি স্টেশনে আসে, স্টেশন থেকে চলেও যায়। কবির জীবনে আসে না গতি, ছোঁয়া লাগে না প্রবহমানতার। ফলে কবির জীবনে জন্ম নিয়েছে একধরনের অবসাদ। অবসাদ থেকেই কবি প্রশ্ন করেছেন ‘এ কেমন জীবন’। এ জীবন তো কবির প্রত্যাশিত নয়। প্রতীকী অর্থে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে অবসাদ এসেছে, পৃথিবীতে যে অবসাদ এসেছে, সেটাও মিলিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে।

‘তফাৎ’ কবিতায় অতিরঞ্জিত ভাষায় কষ্টের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর হয়ে কাটিয়েছেন ৩০০ বছর। ডাক্তারকে মনে হয় যমদূত। তাপে গলে বরফে পরিণত হন তিনি। এখানে বাস্তব জীবনের সঙ্গে চিন্তার জগতের পার্থক্য খুঁজতে চেয়েছেন বোধ করি।

‘শূন্যতা’ কবিতায় হাহাকারাচ্ছন্ন কবি কাগজকলমে শূন্যতা লেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। ‘টেস্ট ম্যাচ’ কবিতায় বিবেক জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিভ্রান্ত মানুষ, জাগ্রত করো বিবেক।’ পুরো কবিতাগ্রন্থের সারমর্ম হতে পারে এই লাইনটি। একুশ শতকের বিভ্রান্ত মানবজাতিকে লক্ষ্য করে কবি বিবেক জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন। পুরো বইতে হাহাকারের চিত্র তুলে ধরেছেন একটি লক্ষ্য নিয়ে। আর এই অভীষ্ট লক্ষ্য হলো মানুষের বিবেক জাগ্রত করা।

‘জলপাই রঙের দিন’ কবিতায় স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। শৈশবের রঙিন দিনলিপি এঁকেছেন।

রোমান্টিসিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো না-পাওয়ার বেদনা। কবির কবিতায় এই না-পাওয়ার আকুতি ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। এই না-পাওয়ার আকুতিকে সংকটের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়। ‘টালমাটাল ঘোর’ সময়কে এঁকেছেন শব্দে। ‘ধীরে এসো বসন্ত’ কবির আশাবাদ, তিনি জাতিকে, পাঠকদের সুন্দর স্বপ্নও দেখিয়েছেন।

‘ধীরে এসো বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম ‘আমন্ত্রণ’ কবিতার প্রথম লাইন থেকে নেওয়া হয়েছে। কাগজে ফুটে থাকা মিথ্যে ফুলের মাঝেও কবির হৃদয়ে বাজছে মোলায়েম সুর। কবি চাইছেন চোখের নদীতে ঢেউ উঠুক, সেখান থেকে ব্যথাতুর হিম উড়ে যাক। পুরো কবিতাটাই বসন্তকে আহ্বান ও কষ্টকে বিদায় জানিয়ে লেখা। শুধু এই কবিতাতে নয়, বরং কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কটি কবিতাতে কোনো অজানা এক বসন্তের জয়গান গেয়েছেন।

আমার মনে হয়েছে কাব্যগ্রন্থের নামকরণ সার্থক হয়েছে। সার্থক হয়েছে এই অর্থে যে বসন্ত যদি শুভদিনের প্রতীক হয়, তাহলে এমন দিন ধীরগতিসম্পন্নই হওয়ার কথা। বর্তমানে যে জীবন দেখছেন কবি কিংবা জীবনের যে অবসাদ ও হাহাকারের মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন কিংবা মধুর শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে স্মৃতিকাতর হচ্ছেন, এখান থেকে মুক্তির পথ খুব একটা সোজা না কিংবা সুদিন খুব নিকটে নয় যদিও বসন্তের দিনের স্বপ্ন কবি আমাদের দেখিয়েছেন। বিবেক জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন, এটাই হতে পারে পুরো কাব্যগ্রন্থের সারমর্ম।

লেখক: সাফি উল্লাহ্, কথাসাহিত্যিক ও প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়