বৈঠকি মেজাজে লেখাজোখার সাত-সতেরো

লেখক, পাঠক বা বই প্রত্যেকেরই আলাদা কিছু গল্প থাকে। লেখাজোখা বা বইপত্রের জগতে এসব গল্পকথার ভূমিকা প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা একটি গ্রন্থ কিংবা একজন লেখককে পাঠকের দরবারে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করে, পাঠকের মানসপট পরির্তন করে দেয়। কখনোবা বদলে ফেলে পাঠাভিজ্ঞতা। একজন সৃজনশীল লেখক যখন এসব গল্প নির্মোহভাবে বলার চেষ্টা করেন, সংগত কারণেই তা হয়ে ওঠে কৌতূহলোদ্দীপক। কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের ‘টিকিটাকা’ গ্রন্থটি এমনই কিছু কৌতূহলী গল্পকথার মলাটবদ্ধরূপ। বৈঠকি মেজাজে সরস গদ্যে সাহিত্যের নানা অলিগলি ঘুরেছেন ওয়াসি আহমেদ। কথা বলেছেন—তাঁর প্রিয় বই, লেখা ও লেখক নিয়ে, বঞ্চনা ও প্রাপ্তি নিয়ে। সাহিত্যযাপনের কড়চা হিসেবেও গ্রন্থটি বেশ বৈচিত্র্যময় ও অভিনব।

পুরোনো বই সংগ্রহের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে গ্রন্থটির শুভসূচনা করেছেন। সত্তরের গোড়ার দিকে তাঁর বই সংগ্রহের স্মৃতি দিয়ে শুরু। তিনি তখন কলেজের শিক্ষার্থী, নিউমার্কেট কিংবা নীলক্ষেত থেকে তিন-চার টাকায় সংগ্রহ করতেন পৃথিবীর সব বিখ্যাত বই। সানোয়ার মিয়া নামের এক বই বিক্রেতা ছিলেন, বইয়ের ব্যাপারে খুব সমঝদার। কে কোন ধরনের পাঠক, এসব খুব খেয়ালে থাকত তাঁর। রুচিভেদে তাঁর ক্রেতাদের জন্য বই তুলে রাখতে ভুলতেন না। এ এক দারুণ স্মৃতিকথা। এখন এসব সমঝদার বই বিক্রেতা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বিক্রেতা তো বিক্রেতা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বইয়ের সমঝদার প্রকাশক খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। পাঠকের কথা আর নাই–বা বললাম।

পুরোনো বই সংগ্রহ নিয়ে ওয়াসি আহমেদের অভিজ্ঞতা বিস্তর। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তো তিনি পুরোনো বই সংগ্রহ করতেনই, বিদেশ-বিভুঁইয়ে গেলেও পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতে দ্বিধান্বিত হতেন না। পাঠকেরা সব সময় যে বই কিনতে যান তা কিন্তু নয়, বই ঘাঁটতেও যান কখনো কখনো। ওয়াসি আহমেদ পুরোনো বই ঘেঁটেছেন কিংবা সংগ্রহ করেছেন বহু জায়গা থেকে। মেলবোর্ন, দিল্লি, বার্মিংহাম, শিকাগো কিংবা আয়ওয়া কোথা থেকে পুরোনো বই নেননি তিনি। ‘পুরোনো বইয়ের ডেরায়’ শিরোনামের নিবন্ধটি পড়ে যা মনে হয়েছে—ওয়াসি আহমেদ লেখক হিসেবে যেটুকু সিরিয়াস, তার অধিক বই তাঁর সংগ্রহে। তা–ই তো হওয়া উচিত—আগে পাঠক পরে লেখক। পাশ্চাত্যের পুরোনো বইয়ের দোকান নিয়ে বেশ মজাদার কিছু তথ্য দিয়েছেন লেখক, তার সব কটি বলা যাবে না। পড়ে নিতে হবে। তবে একটি তথ্য আপনাদের না বলে পারছি না, তা হলো, তাঁর দেখামতে অধিকাংশ বইয়ের দোকানদার থাকেন নারী আর দোকানে ঘুরঘুর করে বিশালদেহী বিড়াল। আজব!

কথাসাহিত্যিকের জবানে সাহিত্যের তত্ত্বকথাও গল্পের মতো সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘টিকিটাকা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় গদ্য ‘বই বনাম ঘোড়দৌড়ের ময়দান’। দ্রুত পঠন নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা করেছেন তিনি। তবে তা শ্রেণিকক্ষশাসিত কোনো সাহিত্য সমালোচনা নয়—আলাপী বিশ্লেষণ। চিত্তাকর্ষক।

স্বল্প পরিসরের একটি গদ্যে উপন্যাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্ক জুড়েছেন ওয়াসি আহমেদ—স্ব-আয়োজিত তর্ক। তর্কের নাম রেখেছেন ‘উপন্যাসের মৃত্যু’। ইংরেজ ঔপন্যাসিক উইল সেলফের কথা—‘উপন্যাসের মৃত্যু ঘটে গেছে’কে প্রতিপাদ্য করে লেখক খোলামেলা যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন। উপন্যাস কি সত্যিই হারিয়ে যাবে? না অন্যান্য মাধ্যমের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে যাবে। যদি টিকেই যায়, তবে কে হবে সে সার্ভাইভার—উপন্যাস না অপন্যাস? জটিল প্রশ্ন!

শত চেষ্টা, জোর-জবরদস্তি করেও লেখা বের হচ্ছে না। অথচ মনে কত কথা, মাথায় কত চিন্তা, পাঠবিষয়ক নানা ভাবনা কিলবিল করছে; লেখার বেলায় শূন্য। লেখকের এ রকম সংকট নিয়ে আড্ডা জমাতেও ভোলেননি তিনি। সংকটটির নাম রাইটার্স ব্লক হলেও আদর করে তিনি তাঁর নাম রেখেছেন—কলমের নোঙর। কী বাহারি নাম!

রাইটার্স ব্লকের সম্মুখীন হয়েছেন পৃথিবীর বড় বড় লেখক। বিদেশি অনেকের গল্পই তো আমরা জানি। কিন্তু বাঙালি লেখকদের রাইটার্স ব্লক নিয়ে তো তেমন একটা আলাপ–আলোচনা নেই। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ; তিনি এত লিখেছেন। কখনো কি রাইটার্স ব্লকের সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর কলমকেও কি নোঙর ফেলতে হয়েছিল! এমনই কিছু প্রশ্ন রেখে মজমা জমিয়েছেন ওয়াসি আহমেদ। দারুণ সে মজমা।

ছোট-বড় লেখকদের প্রায়ই জীবনের একটা সময় প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। লেখক জীবনে ‘না’ শব্দটি শোনেননি, এমনজন খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। আর ‘না’ অধিকাংশ সময়ই প্রকাশকদের কাছ থেকেই শুনতে হয়। বিশ্বসাহিত্যে এসব ‘না’-ই একসময় ইতিহাস রচনা করেছে। ‘প্রকাশকদের না’ নামধারী গদ্যটি আপনাকে জানাবে প্রত্যাখ্যাত লেখকের জীবনের সেসব ইতিহাস।

পাঠকের মৃত্যু সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি ওয়াকিবহাল। কিন্তু পাঠকের পূর্ণজন্ম বা নবজন্ম নিয়ে আমরা তেমন একটা ভাবিনি। তবে ওয়াসি আহমেদ ভেবেছেন—পাঠক কেবল যে মারা যান, তা নয়; তাঁরা পুনরায় জন্মেনও; নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর পাঠরুচি নিয়ে। দশ বছর আগে আপনি যে রুচি বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি বই পড়েছেন, দশ বছর পর তা পরিবর্তন হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় নতুন এক পাঠকের। নিজের পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখক এসব কথাই আমাদের জানিয়েছেন—‘পাঠ বদলে যায়’ নিবন্ধে।

‘টিকিটাকা’ গ্রন্থে পছন্দের বই, গল্প কিংবা কবিতা নিয়ে দিলখোলা আলোচনায় মেতেছেন ওয়াসি আহমেদ। কিছুটা উচ্ছ্বাস, কিছুটা খেদ আবার খানিকটা আবদার দেখিয়েছেন এসব আলোচনায়। তবে সংযত ছিলেন। অতিরঞ্জন কিংবা আবেগ কখনোই পাত্তা পায়নি। তিনি লিখেছেন—বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লব দাশকে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নিয়ে। মোস্তফা সিরাজের ‘উড়ো চিঠি’র একটি যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন, যা পাঠকের পক্ষ থেকে সিরাজের প্রতি দায় শোধ করবে। এই পরম্পরায় মঈনুস সুলতানের ‘কাবুলের ক্যারাভান সরাই’-এর পাঠপ্রতিক্রিয়াটি সত্যিকার অর্থেই একটি আদর্শ গ্রন্থালোচনা।

‘পত্রিকাওয়ালারা সব লেখককে সম্মানী দেন না, প্রকাশকেরা বই ছেপে লেখকের পাওনা মেটাতে যারপরনাই কুণ্ঠিত—এ মোটেও বিচ্ছিন্ন অভিযোগ নয়। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় শতভাগ সত্য, অন্তত আমাদের প্রেক্ষাপটে। যতদূর জানি, বাঙালি লেখকদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু লেখালেখি জীবনের সেই গোড়ার দিকেই এ নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন।’ ওয়াসি আহমেদ নিজেও কিছুটা সোচ্চার হয়ে লেখকদের সম্মানীর ব্যাপারে কলম ধরেছেন—‘মিনিমাগনার চুমকুড়ি’ নামের গদ্যে।

সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বাজারে খুব কথা চলে। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। আলাপটা হলো, সাহিত্যের জন্য পুরস্কার কি খুব জরুরি বা পুরস্কার লেখালেখির পরিপূরক না লেখালেখি পুরস্কারের পরিপূরক। এভাবেই সময়োপযোগী একটি আলাপের অবতারণা করেছেন লেখক, যা অনেক প্রশ্ন তৈরি করে আবার কিছু প্রশ্নের উত্তরও প্রদান করে।

সাহিত্যের নানা চোরাগালি ঘুরে ফিরেছেন ওয়াসি আহমেদ। সফর করেছন লেখালেখির নানা নগরবন্দর। বিচিত্র বিষয় আর নতুন নতুন জগৎ নিয়ে তাঁর এই মজলিস। যেন দহলিজে জমে ওঠা বৈকালিক আড্ডা। এটা-ওটা নিয়ে তুমুল হইচই।

‘টিকিটাকা’য় সাহিত্যসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়েই টুকটাক বলেছেন। বই, বইয়ের লেখক আর পাঠককে নিয়ে যেহেতু লিখতে বসেছেন সুতরাং বইচোরকেও ছাড়েননি। তাদের নিয়ে লিখেছেন—‘টাকাকড়ি আসবাবপত্রের মতো কাগজের বইও যে চুরি হওয়ার যোগ্যতা রাখে তা শিশু বয়স থেকেই জেনে আসছি। আর বড় বয়সে পৌঁছে জানলাম—কে না বইচোর!’ লেখাটি পাঠ করে বইচোর বা না চোর উভয়েই নষ্টালজিক হতে বাধ্য। সত্যিই।

নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুকের সংগ্রাম ও তাঁর বই নিয়ে লিখেছেন। তাঁর সঙ্গে নিজের সাক্ষাৎ-স্মৃতিও বলেছেন। দিল্লিতে তাঁদের দুজনের দেখা হয়েছিল; তা ছিল উষ্ণ-আন্তরিক এক সাক্ষাৎ। ওয়াসি আহমেদ নিজের ব্যক্তিগত বা লেখকজীবন যাপনের গল্প এর আগে খুব একটা করেননি, তবে ওই গ্রন্থে পাঠকদের কাছে লেখকজীবনের দু–একটা অধ্যায়ের খানিকটা প্রকাশ করেছেন। ২০১৬ সালে আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন। সেখানকার টুকরো টুকরো স্মৃতি তিনি হরফবদ্ধ করেছেন, ‘আওয়া কড়চা’ শিরোনামধারী তিনটি ক্রমানুসারী গদ্যে। আমাদের পরিচিত করেছেন সাহিত্যির এক আধুনিক ও মেধাবী প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে।

গ্রন্থটি পড়ে বিপুল আনন্দ লাভ করেছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে রসেভরা গদ্যের মাদকতা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। যদিও গদ্যগুলোর খুব একটা ধারাবাহিকতা নেই এবং অনেক ক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ত ও বেশ আঁটোসাঁটো। লেখক অবশ্য বইটি শুরুর আগে এ ব্যাপারে ছোট একটা কৈফিয়ত দিয়ে রেখেছেন—শুরুতে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই প্রথম আলোর শিল্প ও সাহিত্য সাময়িকীর জন্য লেখাগুলো লিখেছেন। লেখক এগুলোকে খুচরা গপ্পোসপ্পো বলতে চান। বাস্তবে তা বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হিসেবেই থাকবে।

গ্রন্থটি তিনি উত্সর্গ করেছেন—কবি আলতাফ শাহনেওয়াজকে। ধারণা করি, এ লেখাগুলো তিনিই তাগাদা দিয়ে আদায় করেছেন। এমন অমূল্য সম্পদ আদায় করে নেওয়ার জন্য তাঁর প্রতিও রইল শুভেচ্ছা।

সাহিত্যের ভিন্ন-বিচিত্র দিক নিয়ে ২৭টি খণ্ড-গদ্যের ‘টিকিটাকা’ এ গ্রন্থ। লেখাজোখার জগৎ নিয়ে অনন্য একটি গদ্যগ্রন্থ, যা কৌতূহলী ও সচেতন পাঠকের মনে খোরাক জোগাবে। পাঠানন্দ দেবে। সর্বোপরি পাঠকের দৃষ্টিকে বিস্তৃত ও দূরগামী করবে।

টিকিটাকা

ওয়াসি আহমেদ
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রকাশক: বাতিঘর
পৃষ্ঠা: ১২৬
দাম: ২৪০ টাকা।