বাংলার 'প্রত্নতত্ত্বের গুরু'

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদ নিয়ে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করেন যে মানুষটি, তিনি আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (১ অক্টোবর ১৯১৮—২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্বচর্চায় অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে অনেকে ‘প্রত্নতত্ত্বের গুরু’ বলেন। এই অসাধারণ পণ্ডিত ও কর্মবীর তাঁর ইন্তেকালের তিন মাস আগেও লেখালেখির কাজ অব্যাহত রেখেছেন।

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ছিলেন এ দেশের পথিকৃৎ প্রত্নবিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, পুথিসাহিত্যবিশারদ, লেখক ও অনুবাদক। এ ছাড়া তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়া সংগঠক ও প্রশাসক। ১৯১৮ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের দড়িকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। তিনি অবিভক্ত বাংলার শেষ বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ডেপুটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ১৯৪৮ সালে চাকরি শুরু করেন এবং সংস্কৃতি ও ক্রীড়াসচিব পদ থেকে ১৯৭৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তৎকালীন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে মহসিন বৃত্তি লাভ করেন।

যাকারিয়া ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং মেধাতালিকায় দশম স্থানসহ আইএ পাস করেন। এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তারপর দুই বছর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক পদে নিযুক্ত ছিলেন।

সেই সময় যাকারিয়া বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে প্রায়ই ভ্রমণে যেতেন। তখনই মহাস্থান তথা প্রাচীন পুণ্ড্রনগরবিষয়ক প্রত্নতত্ত্বে তাঁর আগ্রহের সূচনা হয়। ভাস্কর্য, মূর্তি, শিলালিপি, স্থাপত্যিক কীর্তির প্রতি প্রবল অনুরাগের ফলে তিনি অবহেলিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্নবস্তু বিষয়ে অনুসন্ধানী হয়ে ওঠেন। এরপর এসব অমূল্য ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে মনোযোগী হন।

উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে যোগদানের সুবাদে তিনি গবেষণার কাজে কিছু প্রয়োজনীয় সুবিধা পেয়েছেন। দিনাজপুর জেলায় যুগ্ম সহকারী কমিশনার পদে যোগদানের পর তিনি পুরোদস্তুর প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খননের কাজ শুরু করেন। একজন আমলা ক্রমেই হয়ে ওঠেন একজন প্রত্নতাত্ত্বিক। প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রত্নতত্ত্বের এই ব্যয়বহুল ও শ্রমসাধ্য কাজে তিনি গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। চাকরির বিধিমোতাবেক তিনি নতুন নতুন জেলায় বদলি হন। ফলে সুবিধা হলো এই, তিনি একের পর এক জেলাভিত্তিক প্রত্নসম্পদের জরিপ সম্পন্ন করতে পারেন। ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’। এই গ্রন্থ শিকড়সন্ধানী প্রত্নবিশেষজ্ঞ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার গবেষণালব্ধ কাজের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ দেশের সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য নিয়ে ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থটি এককথায় একটি অমূল্য প্রকাশনা। প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের জন্য এটি একটি দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ। বলা যায়, প্রায় সমগ্র দেশের প্রত্নসম্পদ বিষয়ে এটি একটি কোষগ্রন্থ। এই গ্রন্থ থেকে সারা দেশের প্রায় সব জেলার প্রত্নসম্পদ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। মেমব্রিজ, অক্সফোর্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সম্পর্কে গবেষণার জন্য এই বই ব্যবহার করছেন। নিরলস অধ্যবসায়, জ্ঞান, কষ্টসহিষ্ণু মানসিকতা ও গভীর দেশপ্রেম থাকলে এ ধরনের গ্রন্থ রচনা সম্ভব। বিস্ময়কর কাজ নিঃসন্দেহে। তথ্য-উপাত্ত-বিশ্লেষণে তাঁর দক্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয় এই গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাসনির্ভর বিভিন্ন ভাষায় লেখা কিছু দুষ্প্রাপ্য বইও বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনূদিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে:

‘তবকাত-ই-নাসিরি’, মূল লেখক: মিনহাজ-ই-সিরাজ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহাবত জঙ্গী’।

‘মোজাফফরনামা’।

‘নওবাহার-ই-মুরশিদ কুলি খান’, মূল লেখক: করম আলী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। 

‘সিয়ারুল মুতাখখিরিন’।

এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের সম্পাদনার কাজ করেন। সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে আছে: ‘কুমিল্লা জেলার ইতিহাস’, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস’। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘আর্কিওলজিক্যাল হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’, ‘গ্রামবাঙলার হাসির গল্প’সহ সাতটি উপন্যাস। ২০১০ সালে ঝিনুক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশের প্রত্নকীর্তি’ বইটির প্রথম খণ্ড। দিব্যপ্রকাশ থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি’ বইটি। প্রথম খণ্ডে হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগ আর দ্বিতীয় খণ্ডে মুসলিম যুগ বিষয়ে লেখা হয়েছে। আরও প্রকাশিত হয় ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ বইটি। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি পত্রিকা, জার্নাল ও সাময়িকীতে একাধিক ভাষায় ছাপা হয়েছে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ।

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া প্রাচীন পুথিসাহিত্য নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। সীতাকোট বিহারে খনন চলাকালে যাকারিয়া প্রাচীন প্রত্নসম্পদের খোঁজে তৎপর থাকেন। সেই সময় ঘোড়াঘাট ডাকবাংলোর নৈশপ্রহরী নইমউদ্দিন সরকারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর যাকারিয়া বুঝতে পারেন, এই ব্যক্তি স্থানীয় প্রাচীন ইতিহাসের একজন বোদ্ধা আর ইতিহাসকেন্দ্রিক অনেক প্রাচীন পুথিও তাঁর মুখস্থ। তাঁরই সূত্র ধরে তিনি যান গোবিন্দগঞ্জ থানার চকনেওয়া গ্রামের তৈয়ব আলী সরকারের বাড়িতে। তৈয়ব আলী সরকারের বাবা খয়রুজ্জামান সরকার ছিলেন অনেক প্রাচীন পুথির লিপিকার। এখান থেকে তিনি সংগ্রহ করেন অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান পাঁচটি প্রাচীন পুথি:

‘গুপিচন্দ্রের সন্যাস’, কবি শুকুর মাহমুদ।

‘গাজী কালু চম্পাবতী’, শেখ খোদা বখশ। 

‘বিষহরার পুথি’, জগজ্জীবন ঘোষাল।
‘বিশ্বকেতু’, দ্বিজকাশুপতি।
‘সত্য পীরের পুথি’, কৃষ্ণ হরিদাস।

এ ছাড়া দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থান, রংপুর, বগুড়া ও চট্টগ্রামের নানা স্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন বহু বিখ্যাত বাংলা ও সংস্কৃত পুথি। যার মধ্যে রয়েছে: ‘হালু মীরের পুথি’, ‘মালাধর বসুর পুথি’।

দেশবরেণ্য প্রত্নবিদ, বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সভাপতির পদও অলংকৃত করেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসবিষয়ক তাঁর অমূল্য গ্রন্থগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সমগ্র জীবনে তিনি বিপুল কাজ করেছেন। তাঁর কর্ম নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা ও মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এবং একজন নিভৃতচারী কর্মবীর।

এবারের বইমেলায় কীর্তিমান এই লেখকের প্রথম প্রকাশনা প্রকাশ করেছে তাঁর ‘সিয়ার-উল-মুতাখিরিন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড। গত বছর প্রকাশিত হয় প্রথম খণ্ড।