দংশন

সৌন্দর্য সব সময় আকর্ষণ করে না, কখনো কখনো দংশনও করে। সুন্দর দেখলেই মানুষ মুগ্ধ হয়, আপ্লুত হয়, কিন্তু আমি কষ্ট পাচ্ছি কেন? আমি কি আপ্লুত হতে পারি না! আমি কি মুগ্ধ হতে পারি না! তাহলে আমার ভেতর এমন কী খামতি আছে, যার জন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি? প্রশ্নটা জাগতেই নিজের ওপর খানিকটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। আসলে এটা মনে হয় কষ্ট হবে না। এটা মনে হয় অন্য কিছু। সুন্দরকে মানুষ হস্তগত করার জন্য যে প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, আমি তার কোনো কিছুই করতে পারছি না বলে আমার ভেতর একটা হাহাকার তৈরি হয়েছে। নিজেকে অন্যদের মতো পরিচালিত করতে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারি, আমি যা, আমি তাই-ই। অন্যদের মতো করে নিজেকে পরিচালিত করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়!

বিমুগ্ধ রজনী ভোর হতে চলল। আমার তৃষ্ণা ফুরোয় না। হঠাৎ একটা রবীন্দ্রসংগীত মনে পড়ল। ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে/ আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।’ শুধু তা-ই নয়, সে সঙ্গে একজন শিল্পীকেও আমার চোখের সামনে আকুতিভরা কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা ছড়াতে দেখলাম। মনে হলো এইমাত্র সংগীতটি গীত হলো। থিয়েটার ইনস্টিটিউটের মঞ্চে বসে শিল্পী উষসী। গানের গহিন সারমর্ম তার চোখে-মুখে অদ্ভুতভাবে খেলা করছে। রবীন্দ্রসংগীত শুধু শোনার নয়, তা যে দেখারও বিষয়, এই শিল্পীর গান না শুনলে হয়তো সেটা বুঝতাম না।

কিন্তু ঠিক এই সময় এমন একটি চিত্র আমার চোখে ভাসছিল বলে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তার অদ্ভুত ডাগর ডাগর চোখের বিস্তৃত সাদা অংশের ঘূর্ণমান কালো মণিতে হোঁচট খেলাম, তখন আবারও যন্ত্রণা শুরু হলো। নিশিদিন যেন তারই আশায় পথ চেয়েছিলাম আমি। হুট করে এমন অনুভূতি কেন জন্ম নিল, তা কাউকে বোঝানো কী যে মুশকিল, তা টের পাচ্ছি। মনে হয়, এর আগে যা দেখেছি সব ম্লান। কোনো কোনো মানুষকে দেখার পর এমন উপলব্ধি আমার হয়! মনে হয় আগের সব পরিচিতরা এর কাছে কিছুই না। তার সঙ্গে পরিচয় না হতে পারলে জনমটাই বৃথা হয়ে যেত। ঠিক এমনই এক সংকট মুহূর্তে আমি দণ্ডায়মান। ভুল হয়েছে, ক্ষমা করবেন। আমি আসলে দণ্ডায়মান নই, বেশ তৃপ্তি নিয়ে বসে আছি। দীর্ঘ রজনী জেগে থেকেও আমি তৃপ্তি নিয়ে বসে আছি। আমার চোখে-মুখে অদ্ভুত মুগ্ধতা। আপনারা হয়তো ভাবছেন কেন এই মুগ্ধতা? আস্তে আস্তে সবই বলব। তবে ‘ধৈর্য’ বলে যে শব্দটি আমরা ব্যবহার করি, সেটি আপনার থাকতেই হবে। কারণ, এটা কোনো নিছক গল্প নয়! তবে এটা কী? এটা কারও জীবন থেকে উঠে আসা একটি ঘটনার বিবরণ। আবার এমনও হতে পারে, এটি কিছুই নয়! তাহলে আপনি কষ্ট করে এটি জানার জন্য উদ্‌গ্রীব হবেন কেন? কারণ, হতে পারে এটি আপনার জীবনেই ঘটে যাওয়া একটি মামুলি কাহিনি।

২.
রংচটা রোদ্দুরে জীবন শুকিয়েছে আমার। যেকারও জন্যই এটা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু ব্যতিক্রমও থাকতে পারে! আমি হয়তো তা-ই। না হয় আমার জীবনটাও অন্য রকম হতে পারত। একটা মানবী খুব কি আর কষ্ট দিতে পারে! একটা মানবীই নিয়েই কি আর জীবন কাটতে পারে! যারা বলে তারা নেহাত সত্যিটাকে মিথ্যে করে ছাপায়। না হয় তাদের সত্যি বলার সাহস নেই। যাহোক, আমি ছিলাম বেশ আমুদে একজন লোক। হইচই আর আড্ডাবাজিতে সেরা। কিন্তু আমার আমোদে এমন করে কেউ ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দেবে, সেটা আমি বুঝিনি। সম্পর্কের বেড়াজাল টপকিয়ে সাঞ্জানা যখন আমার হলো, তখন হাতের মুঠোয় স্বর্গটাকে পেয়েছি বলে বিভ্রম হয়েছিল। এটা নিয়ে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এই যে মানুষ মনে করে একটা মানুষকে সে পেয়েছে, সেটা কী করে সম্ভব। যারা পায়, তারা কি আসলেই পায়! সত্যিটা ভাবতে গিয়ে মনের ভেতর কেবল তোলপাড় আর ঝড়-তুফানের শব্দই পেয়েছি আমি। মানুষ মানুষকে পাওয়া খুব কঠিন নয় কি ব্যাপারটি! শরীর পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ মানুষটি আত্মস্থ করেছি বলে যে উপলব্ধি জাগে, সেটা তো মনটাকে ঘিরেই। কিন্তু মানুষের মনটা তো এত সহজ নয়। আপনারা হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। করেন, সমস্যা নেই। খেয়ালি মনটাকে যদি কেউ হস্তগত করতে পারে, তাহলে সে ধন্বন্তরি জাদুকর কিংবা খুব সৌভাগ্যবান। তবে আমার কেবল মনে হয়, সে মিথ্যাচারই করে গেল। কারণ, মানুষের মন আপাতত পেয়েছি, এ বোধ ঠিক আছে। জনম জনম তাকে হস্তগত করে রাখবেন, এ বোধ বিবেচনায় আমরা ঠাঁই দিই না। আচ্ছা, এসব কথা থাক, আমি সাঞ্জানার কথা বলি। যে আর এ পৃথিবীতে নেই।

আমার জীবনে সে এসেছিল। এ ব্যাপারটাও এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। কিছু ছবিতে কিছু অনুভবে আর কল্পনায় সে বিরাজ করছে এখন। এ ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জীবনবাবুর রাঙা রাজকন্যার মতো সে যে রং নিয়ে চলে গেছে দূরে। এ জটিল সত্য আমি একা একাই উপলব্ধি করি। সাঞ্জানা যেখানে হারিয়ে গেছে, প্রতিবছর আমি সে জায়গায় যাই। পূর্ণিমার জোয়ার এলে আমি সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে সাঞ্জানাকে খুঁজে বেড়াই। এমন ভাবলেই আমার নিজেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্র বলে মনে হয়। সেই যে মনে আছে ‘অতসী মামী’কে? ট্রেনে করে ছুটে চলেছেন বিরান ভূমিতে। পূর্ণিমার রাতে বিশাল মাঠে একাকী বাঁশি বাজিয়ে মামাকে খুঁজবেন।

দুজনই এক সত্তা যেন আমরা। আমি আর ‘অতসী মামী’। ‘অতসী মামী’ গল্পের এক চরিত্র আর আমি? জানি না আপনারাই বলুন, আমি কে?

সাঞ্জানার সঙ্গে আমার ভালোবাসা বেশি দিন গড়াতে পারেনি। কেন গড়াল না, সেটা আপনারা বুঝতেই পারছেন। তবে এটা কি নিছক একটা দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনেও অন্য কিছু লুকিয়ে আছে, সেই ভাবনা আমাকে প্রায় উন্মাদ করে তোলে। নানা রকম যুক্তিতর্কের বিষয় নিয়ে আমি চিন্তা করলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার তখন আহমদ ছফার ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসের সেই শিক্ষকের চরিত্রটির কথা মনে পড়ে। যে কিনা বছরে ছয় মাস সুস্থ থাকে আর বাকি সময় পাগল হয়ে যায়। তাই এ বিষয়ে যখনই খোঁড়াখুঁড়ি করতে চাই, তখনই আমার তার কথা মনে পড়ে, মনটা চুপসে যায়। লাগাম ছেড়ে আমি তখন কোনো কিছুতে জোর করে নিজেকে যুক্ত করি।

সাঞ্জানা ছিল পোয়াতি। সমুদ্রের ঢেউ এসে ওকে আপন করে নিয়েছে। কী সহজেই বলে ফেললাম কথাটি। তাই না? মনে পড়ে গেল শামসুর রাহমানের ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতাটি, এতে ভদ্রলোকের ছেলেটি গ্রামের পুকুরে একখণ্ড পাথরের মতো ডুবে গিয়েছিল। আর সে ঘটনাই তিনি কিছুদিন পর এক অতিথিকে অনায়াসে বলে ফেললেন। কারণ, স্মৃতিরও ক্ষয় আছে। সবকিছু আস্তে আস্তে ক্ষয় হয়। না হয় দগদগে উনুনের তাপ নিয়ে মানুষগুলো অনেক বেশি শূন্য হয়ে যেতে হয়। আমি কি শূন্য হইনি? নিজেকে এ প্রশ্ন করতেই কেমন জানি বিমিশ্র প্রতিক্রিয়া উঠে আসে। এর জবাব কী হতে পারে। আপাতত সহজ মনে হলেও আমার কাছে তা কেবলই জটিল থেকে জটিলতর।

সাঞ্জানার সঙ্গে সেই পূর্ণিমার রাতটির কথা মনে পড়ে। আকাশে মুখর ছিল চকচকে রুপার থালার মতো চাঁদ। চুয়ে পড়া জোছনা অঞ্জলি ভরে পান করার তৃষ্ণায় মুখর ছিলাম আমরা। বসে ছিলাম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সৈকতে। তখন জোয়ার ছিল হয়তো কিংবা জোয়ার ফুরিয়ে ভাটার খরস্রোত। হাতের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে সাঞ্জানা মুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম, এই শরীরে নৃত্যকলার প্রয়োজন নেই। আমার কথার রেণু তার মস্তিষ্কে কোনো আলোড়ন তুলল না। সে অদ্ভুত গ্রীবাভঙ্গি করে কোমল বাহুলতায় সুরের ইন্দ্রধনু ধরে কদলীসদৃশ পুরুষ্ট ঊরুতে কামনার বান ডাকিয়ে প্রজাপতি ভঙ্গিমায় ভাসতে লাগল। নীরব দর্শক হয়ে চাঁদের আলোয় নির্জন সৈকতে চোখ দুটো অবিশ্বাস্য হয়ে তাকিয়ে রইল। এত ছুটোছুটি করছিল, আমি কিছুক্ষণ পরপর ভয়ে আঁতকে উঠছিলাম। কারণ সাঞ্জানা ছায়া হয়ে উঠছিল। আমার চোখ তার নৃত্যের গতির সঙ্গে গতি ঠিক রাখতে পারছিল না। তাকে চোখের তারায় ধরে রাখতে পারলাম না। মনে হলো সে ঢেউয়ের ওপর নৃত্য করতে দরিয়াতেই নেমে গেছে। সাদা সাদা ঢেউয়ের মাথায় তার চিহ্ন খুঁজতে লাগলাম। সেখানে জোছনার ঢল চুমু খাচ্ছে তরঙ্গের মরাল গ্রীবা। কোথাও সাঞ্জানার ছায়া নেই। সাঞ্জানা গেল কোথায়? চুপ করে এসে বসে থাকি। অজানা আতঙ্কে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকলেও তা নিজের ভেতরেই বেঁধে রাখি। ইচ্ছা করছিল চিত্কার করে চারদিক জানিয়ে দিতে যে সাঞ্জানা হারিয়ে গেছে। কারণ, তখনো আমার বিশ্বাস ছিল, সাঞ্জানা হারিয়ে যায়নি। যেকোনো মুহূর্তে নৃত্যরত সাঞ্জানা হালুম করে এসে আমাকে চমকে দেবে। বলবে, কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম, তাই না?

তাই নিজের বুকের থরহরি কম্পন চেপে ধরে অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু সাঞ্জানার ফেরার সময় আর হয় না। এরপর নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ওপরে ফেলতে ইচ্ছে করল। ভাবলাম, আমি কী গাধা। কারণ, সাঞ্জানা বিহ্বলতাড়িত হয়ে নৃত্যরত অবস্থায় ঢেউয়ের দোলায় চড়তে চড়তে স্রোতের টানে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ কথা আমার মাথায় কেন আসেনি, তা বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কত জায়গায় ছুটোছুটি করলাম, কোনো ফল হলো না। মৃত সাঞ্জানাকে যেকোনো সময় ফিরে পাব বলে কয়েক দিন কাটিয়ে দিলাম সাগরতীরে। কিন্তু তাও আমার ভাগ্যে জুটল না।

৩.
ট্রেনের দুলুনিতে তার চোখ বুঝি কয়েকবার লেগে এল। আমি দেখলাম মুদ্রিত অক্ষির অপরূপ শোভা। চোখের পাতাটি কী করে একটি পদ্মদিঘি আর তার কালো ভ্রমরটিকে ঢেকে রেখেছে তার মায়াময় খেলা। অকপটে বলতে পারি, এ রীতিমতো অন্যায়! আমার গালে দুটো চটাস করে থাপ্পড় কষিয়ে দিলেও আমি অবাক হব না। অবশ্য আমরা দুজনেই চোর-পুলিশ খেলছি। সে তাকালেই আমার দৃষ্টি পালাচ্ছে। যেন আমি কিছুই জানি না। আমি মনে হয় তাকেই বিরক্তই করছি। কারণ, সে যখন তড়িত্স্পৃষ্টের মতন জেগে উঠছে, তখন বেশ লজ্জায় নত হয়ে পড়ছে। মনে হয় সে ভাবছে, ইশ্‌, আমার ঘুম লেগে এসেছিল দুচোখে! যদিও আমার ভাবনাটি ছিল তুমি ঘুমাও, আমি জেগে আছি। কিন্তু তার চোখে-মুখে অপরিসীম এক লজ্জা আরক্ত করে রেখেছিল তার কপোল। তার অবুঝ নয়ন দুটি যেন বারবার দুঃখ প্রকাশ করে বলতে চাইল, ঘুমটা বড্ড জ্বালাচ্ছে, কিছু মনে করবেন না। আমি আপনার কোনো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি না তো!

আরে না না, কী যে বলেন। ঠিক আছে সব। আপনার যেমন ইচ্ছা। মোটেও অসুবিধে হচ্ছে না আমার।

হৃদয়ে বকুল ছড়িয়ে আমার উন্নত মস্তিষ্ক আরও কিছু কল্পনার জাল বুনতে লাগল। এমনই তো হয়, তাই না? কখনো কখনো কাউকে ভালো লাগলে এমন করেই মনে মনে তাকে পরিচিত করে, নিজের অনুকূলে যা ভাবা যায়, তাই আমি ভেবে নিই। অন্যের ক্ষেত্রে কেমন হয় জানিনে, আমার এমনই হয়। চট্টগ্রাম এসে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেক যাত্রী নেমে গেল আবার অনেক যাত্রী নতুন করে উঠে এল। আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কারণ, তার গন্তব্য যদি এখানেই শেষ হয়ে যায়! কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বসেই রইল। জানালা দিয়ে লোকজনের ছুটোছুটি দেখতে লাগল। আর মাঝেমধ্যে আমাকেও পরখ করতে লাগল। সব মিলিয়ে কত সময় খেয়াল নেই। এরই ফাঁকে কেউ কেউ সতেজ হয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাতরাশ বিতরণ শুরু হবে। তার আগে অবশ্যই ট্রেনটি চলতে শুরু করবে বলে কয়েকজন আলাপ জমিয়েছে। উঠে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে আসব, ভরসা পাচ্ছিনে। কারণ আমার মনে হলো, আমি উঠে গেলেই সে লাগেজ নিয়ে নেমে যাবে। এমন অদ্ভুত ভয় কেনইবা আমাকে পেয়ে বসল বুঝলাম না। সাঞ্জানা যেন এখন ওই মেয়েটির মধ্যে এসে ভর করেছে। সাঞ্জানার তিরোধান দিবস আজ তিন বছর পূর্তি হতে চলল। আগামীকাল চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করবে।

আমি চতুর্থবারের মতো পূর্ণিমার সৈকতে রাত্রিযাপন করে সাঞ্জানাকে খুঁজব। কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। কারণ, ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। এই ট্রেন আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাগরসৈকতের রানি কক্সবাজারে গিয়ে পৌঁছাবে। এবার ওঠা যেতে পারে। গিয়ে ওয়াশরুমে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাশতা এল। খুব বেশি খিদে পায়নি। রাতভর যে অপরূপ সুধা পান করেছি, তা যেন এখনো আমাকে ভরিয়ে রেখেছে। তাই নাশতায় হাত না দিয়ে চুপ করে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের লুকোচুরি আবার অনেক দিন পর ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার উপস্থিতি ভুলেই যেন কিছুক্ষণ আকাশ পারে লুটোপুটি খেয়ে এলাম। চোখ পড়তেই দেখলাম সেও নাশতার বক্সে হাত ছুঁয়ে অপেক্ষা করছে। তাহলে তার সঙ্গে মিল রেখে আমিও শুরু করতে পারি। শুরু করলাম। সে মনে হয় হাসল। আমি আড়চোখে দেখলাম। চোখের ভাবে এতটা আপন আর কোনো দিন হয়নি! আজই দেখলাম এবং বুঝলাম। বিনিদ্র রজনীর ক্লান্তি বুঝি এবার আমায় পেয়ে বসল। প্রহরী দুচোখ কখন যে মুদে এল বলতে পারি না। যখন দুই নয়ন আবার নিমীলিত হলো তখন বুকের কাছটা বড্ড শূন্য শূন্য মনে হলো। একটা উত্কণ্ঠা বুঝি চোখে মুখে গেড়েই বসেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার উপশম হলো। সে একরাশ স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে আবারও তার স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করল। আমার চোখের পাতা ঘুমে আর জড়িয়ে এল না। তাকে চোখে চোখে রেখেই আমরা কক্সবাজার এসে পৌঁছালাম।

এবার যেন বিরহব্যথায় আমার প্রাণ বিগলিত হতে শুরু করল। একদিকে সাঞ্জানা, অন্যদিকে এই অপরিচিতা। সাঞ্জানার দর্শনে নিজেকে উৎসর্গ করেছি ভেবে অপরিচিতার গন্তব্য কিংবা তাকে আর চোখে চোখে রাখ গেল না। এখানে গতি সকলকে অস্থির করে রেখেছে। সে হারিয়ে গেল। বিষণ্ন মনে বুক করা হোটেলে এসে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠলাম। আর ঘুম থেকে উঠে মনটা আবার সেই অপরিচিতার জন্য কেমন-কেমন করে উঠল। মনে হলো সে আমার খুব কাছেই রয়েছে। আমি তাকে মিছেমিছি খুঁজেই পাচ্ছি না। তৈরি হয়ে বের হতে যাব আর তখনই আমার হার্টবিট দ্রুতলয়ে চলতে লাগল। আমার পাশের রুম থেকে সেও বের হয়ে আসছে। অদ্ভুত যোগাযোগ। এ জন্যই আমার অবচেতন মন বারবার বলছিল, সে আমার কাছেই রয়েছে।

সেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ঘুমিয়েছিলেন বুঝি?

আমি উত্তর দিতে ভুলে গেছি। কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললাম, হ্যাঁ।

এখানে এসে কেউ ঘুমায় নাকি!

তাহলে কি সবাই জেগে থাকে?

সে হাসল। না বলছিলাম। সাগরে যাননি, গোসল করেননি, এসব আরকি!

তা আপনি গিয়েছেন তো? সে ব্যথভরা চোখ তুলে উত্তর দিল, না।

তাহলে?

আমি ওসবের জন্য এখানে আসি না। রাতে যাব বিচে।

আমি বললাম, আমিও এখানে ওসবের জন্য আসি না। আমিও একজনকে খুঁজতে এসেছি। আমিও রাতে যাব বিচে।

সে কি আমার কথায় মনে কষ্ট পেয়েছে? বুঝলাম না। কেমন মনমরা হয়ে চলে গেল আপন গন্তব্যে। সারা রাত কত কল্পনা ছিল তাকে ঘিরে। মনে মনে কত কথা বলেছি তাকে নিয়ে। যখন সত্যি কথা হলো তার সঙ্গে, তখন তাকে ধরে রাখতে পারলাম না। একটা ব্যথা, একটা পরাজয় আমাকে গ্লানিতে আচ্ছন্ন করে রাখল। কিছুই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি তাকে। আমার তো অনেক কিছু জানার ছিল। হবে নিশ্চয়। তা আর অপূর্ণ থাকবে না মনে হচ্ছে। যেহেতু ধাপে ধাপে সব হচ্ছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। খেলাম। এদিক-ওদিক খুঁজলাম তাঁকে। কোথাও পেলাম না। ফিরে এলাম রুমে। ভেতরে আছে কি না নক করতে চাইলাম, মন সাড়া দিল না। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার রাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

রাত নেমেছে বাইরে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। আমার চোখে আবার সাঞ্জানা জেগে উঠেছে। আমি বের হয়ে সৈকতের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চাঁদের জোছনা অকৃপণভাবে ভরিয়ে তুলেছে সৈকত। আর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে জোয়ার। ঢেউয়ের অগ্রভাগে সাঞ্জানা নৃত্যরত অবস্থায় ধরা দেবে আমার চোখে। আস্তে আস্তে কোলাহল থেমে আসছে। মনে হচ্ছে সাঞ্জানা ফিরে আসছে। একটা ছায়ামূর্তি অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তাকে চেনা না গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না সে নারীকে। চেনা চেনা মনে হলো ওই নারীকে। কাছে গিয়েই তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলাম।

আপনি কি আমার পিছু নিয়েছেন?

একই প্রশ্ন আপনাকে আমিও করতে পারি।

ঠিক তাই। করতে পারেন। তবে আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি। যে তিন বছর আগে ঠিক এই জায়গায় হারিয়ে গিয়েছে।

আমিও একজনকে খুঁজতে এসেছি যে বছর তিনেক আগে এই জায়গায় হারিয়ে গিয়েছে। আমরা পরস্পর চমকে উঠি দুজনের মিল দেখে। আমার অপরিচিতা খুঁজছেন একজন পুরুষ। আর আমি একজন নারী। আমি সাঞ্জানার কথা বলতেই তিনি চমকে উঠে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি সাঞ্জানাকে চিনতেন? আমি বললাম সাঞ্জানা আমার কে ছিল। কিন্তু সে যা বলল, তারপর আমাদের দুজনের ভাবনাকেই এক রূঢ় বাস্তবতায় এনে দড়াম করে আছাড় মেরে ফেলল।

আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রী সাঞ্জানা পোয়াতি ছিল। এই সৈকতে তিনি তাকে বছর চারেক আগে হারিয়ে ফেলেছেন। তিন বছর আগে সে স্মৃতিই রোমন্থন করতে আমরা এখানে এসেছিলাম। সে রাতে সেও স্ত্রীর কষ্ট ভুলতে না পেরে দৃষ্টির আড়ালে চলে যান।

আমার চোখের সামনে ঘটনার প্যাঁচ লেগে যায়। তারপর এক এক করে জট খোলার জন্য আমরা আলোচনায় বসি। আমার কাছে সবকিছুই সাজানো মনে হয়। আর মনে হয় সবকিছুই মরীচিকা।