ছোট ছোট গল্প

ফেরা

ইয়াসিন বাড়ি ফিরল একত্রিশ বছর পর।

তাকে দেখতে পাড়া-প্রতিবেশী এসে ভিড় করল। বারো বছর বয়সী ইয়াসিনকে যারা দেখেছে, তাদের কেউই তাকে চিনতে পারল না। ইয়াসিনের বড় ভাই তাকে  জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি যে আমার ভাই, তার প্রমাণ কী?’

ইয়াসিন বলল, ‘পাগারের কান্দাত পিছলা খাইতে গিয়া শামুকে আপনের পাছা ছিলা গেছিল না?’

ইয়াসিনের বড় ভাই নিজের পশ্চাদ্দেশে শামুকে কাটা দাগ স্পর্শ করে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমিই আমার ভাই ইয়াসিন।’

সেদিন বিকেলবেলা আকাশে খুব মেঘ করল। পাড়া-প্রতিবেশী বাড়ি ফিরে গেলে ইয়াসিন সেই মেঘমেদুর বিকেলে বাড়ির কামরাঙাগাছের নিচে বসে নয়াবাড়ির পাশের খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ইয়াসিনের ভাই জিজ্ঞেস করে, ‘এত দিন কনে আছিলা, ইয়াসিন?’

ইয়াসিন মৃদু হাসে।

অনেকেই তাকে একই প্রশ্ন করে, ‘এত দিন ধইরা কোথায় কী করলা, ইয়াসিন?’ সে কখনো জবাব দেয়, কখনো কিছুই বলে না।

ইয়াসিনকে দেখা যায় দক্ষিণের বাগিচায় একটা মাচানের ওপর বসে আছে চুপচাপ। কখনো সে খালের পাড় ধরে কিংবা দিয়াড়ে ধানখেতের আল ধরে হেঁটে হেঁটে পূর্বশুকদেবপুরের দিকে যায়।

গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে সে এক ড্রাগ ডিলারের হাতে পড়েছিল। কেউ বলে ভুয়াপুর লঞ্চঘাটে কুলিগিরি করত। কেউ বলে নারায়ণগঞ্জে এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বালুর ব্যবসা দেখত। কেউ বলে খুনের মামলায় বহু বছর জেল খেটে এসেছে।

এক তুমুল বৃষ্টির দিনে দেখা যায় ইয়াসিন শিশুদের একটি দলে ভিড়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।

অন্য দিন কেউ দেখে দক্ষিণের বাগিচায় কিশোরদের একটি দলের সঙ্গে ডাংগুলি খেলছে।

এরপর থেকে এই শিশু-কিশোরদের সঙ্গেই তাকে দেখা যেতে থাকে। কখনো আম কাটার চাকু হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ভিটা থেকে অন্য ভিটায়। কখনো পানিতে নেমে পিঠালিগাছের বীজ দিয়ে জলের খেলা খেলছে, কখনো মহিষের পিঠে চড়ে নেমে যাচ্ছে খালের পানিতে।

গ্রামবাসীর কেউ কেউ তার এসব কাণ্ড দেখে অবাক হয়। যারা তাকে বারো বছর বয়সে দেখেছে, তারা ভীষণ আলোড়িত হয় এই ভেবে, এ তো সেই বারো বছরের ইয়াসিন!

ছায়া ডিঙানো
সংসারের চাকায় পিষ্টপ্রায় আবদুল মতিন অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি জীবন পাল্টাবেন। বাঁচবেন অন্যভাবে, অন্য কোনো উপায়ে।

কিন্তু তিনি জানেন না কীভাবে জীবন বদলানো যায়।

এক বন্ধু উপদেশ দিল, ‘সদ্​গুরু ধরো। পারো তো আজমত শাহ ফকিরের কাছে যাও।’

ফকিরের আস্তানায় গিয়ে সাধুসঙ্গ নিয়ে এক মোক্ষম মুহূর্তে আবদুল মতিন ধ্যানমগ্ন ফকিরের কাছে আরজি পেশ করেন, ‘গুরুজি, আমি জীবন বদলাতে চাই। বাঁচতে চাই অন্য উপায়ে। পথ বলে দেও।’

গুরু গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘নিজের ছায়াকে ডিঙিয়ে যাও।’

‘কিন্তু নিজের ছায়াকে কী করে ডিঙাব, সে তো অসম্ভব কাজ।’

‘তবে নিজে তুমি যার ছায়া, তাকে ডিঙিয়ে যাও।’

‘তা কীভাবে পারব, গুরু?’

‘প্রথমে তার চূড়ায় ওঠো, তারপর লাফ দাও।’ এ কথা বলে গুরু নীরব হন। কোনো প্রশ্নেরই আর জবাব দেন না।

আবদুল মতিন সাধুসঙ্গ শেষে বাড়িতে গিয়ে ভাবতে শুরু করেন, কার ছায়া আমি? কিসের ছায়া? তার চূড়ায় কী করে ওঠা যাবে?

এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আবদুল মতিন নির্জনবাস শুরু করেন। চুপচাপ বসে থাকেন। প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্ন আসে মনে। সেসবের উত্তর খোঁজেন। এভাবে অনেক দিন যায়। তার ভাবনার জগতে শুধু কুয়াশা। সেই কুয়াশা বাতাসে দোলে, সরে যায়। কিন্তু কিছু জিনিস একেবারেই স্থির যেন শিকড় গেড়ে আছে তার ভেতর। ওগুলো অনুসরণ করে ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকেন তিনি, যেন এক অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। একসময় শীর্ষবিন্দুটা চোখে পড়ে। সেখানে পৌঁছে দেখতে পান চারদিকে অপূর্ব দৃশ্যপট।

এবার লাফ দেওয়ার পালা।

দায়
‘আপনারা বলছেন বয়লার বিস্ফোরণে যারা মারা গেছেন, তারা নিজেরাই তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কীভাবে?’

‘কারণ, বিস্ফোরণটা অদক্ষতার কারণে ঘটে।’

‘কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর জন্য তো কারখানার ব্যবস্থাপক দায়ী।’

‘না। দেখুন, অদক্ষ হলেও এত দিন ধরে কাজ করে তাদের মধ্যে একটা স্কিল ডেভেলপ করার কথা, কিন্তু করে নাই। এর জন্য তো অন্য কেউ দায়ী হতে পারে না।’

‘বয়লারটা বানানো হয়েছে স্থানীয়ভাবে, লোহার পাত দিয়ে। ওটা তৈরির সময় কোনো প্রকৌশলীর পরামর্শও নেওয়া হয় নাই।’

‘তা ঠিক। কিন্তু বয়লারটা তো এত দিন ঠিকঠাকই চলছিল।’

‘কারখানার দারোয়ান মারা গেছে। তার এই মৃত্যুর জন্য সে কীভাবে দায়ী?’

‘খেয়াল করেন, বয়লার বিস্ফোরণের পর আগুন যখন কেমিক্যাল–ভর্তি দুটো ট্যাংকলরি পর্যন্ত পৌঁছায়, ততক্ষণে দারোয়ান কিন্তু সরে পড়তে পারত। কিন্তু সে সরে নাই। এদের সমস্যাটা হলো গেটের পাশে বসে থাকতে থাকতে এরা একরকম জড়তায় ভোগে—যা–ই ঘটুক না কেন, গেট থেকে নড়বে না।’

‘আর পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে থাকা রিকশাওয়ালা, সে কীভাবে দায়ী?’

‘এই রিকশাওয়ালা, দেখেন সে মারা পড়ত না যদি সে একটু বেশি জোরে কিংবা একটু বেশি ধীরে রিকশাটা চালাত। সে হয়তো আয়েশ করে রিকশা চালিয়ে আসছিল, যদি তার তাড়া থাকত, হয়তো সে আরেকটু বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারত, আর যদি সে মৃদুমন্দ গতিতে গান গাইতে গাইতে, অনেকেই যেটা করে, এসে পড়ত পুকুরপাড়ের কলাগাছের ঝোপ পর্যন্ত, সে নিশ্চয়ই মারা পড়ত না। কিন্তু এমন একটা গতিতে সে রিকশা চালিয়েছে, যখন বয়লারটা বিস্ফোরিত হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে সে ওখানে গিয়ে পৌঁছে এবং তার গায়ে আগুন ধরে যায়। একটু যুক্তি খাটিয়ে দেখুন, দায়টা কেন তারই।’