'ব্যস্ত শহরে মানুষ যেন বইপাড়ায় ঘোরার নাগরিক আনন্দ পায়, সেই চেষ্টা করেছি'

এবারের বইমেলার পরিসর যেমন বেড়েছে, তেমনি এর নান্দনিক স্থাপনা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছবি: এনামুল করিম নির্ঝর
এবারের বইমেলার পরিসর যেমন বেড়েছে, তেমনি এর নান্দনিক স্থাপনা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছবি: এনামুল করিম নির্ঝর
>বইমেলার নান্দনিক স্থাপত্য–নকশা করেছেন এনামুল করিম নির্ঝর, যা মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। মেলা নিয়ে এই স্থপতির মুখোমুখি হয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

আলতাফ শাহনেওয়াজ: দুই বছর ধরে কোনো সম্মানী না নিয়ে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বইমেলার নকশা করছেন আপনি। অভিজ্ঞতা কেমন?
এনামুল করিম নির্ঝর: শুধু নকশা নয়, বলতে পারেন পরিকল্পক হিসেবে ভূমিকা নিতে হয়েছে। লোগো থেকে শুরু করে অন্য যত গ্রাফিক ও অন্যান্য বিন্যাসের নজরদারি এবং পরামর্শ, নতুন নতুন আইডিয়া যোগ করা—সবই করতে হয়েছে। হ্যাঁ, টাকাপয়সা ছাড়া কাজ করেছি। সবকিছুর মধ্যে টাকাপয়সার গন্ধ খুঁজতে হবে কেন? আমার কাছে বিষয়টা একধরনের দায়িত্ববোধ, ভালো লাগা বা নিজেকে অনুপ্রাণিত করার উদ্যোগ। এ কারণে দুই বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছি আমি ও আমার অফিস সিস্টেম আর্কিটেক্টস।

গত বছর বাংলা একাডেমি আমাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে এই দায়িত্বের আহ্বান জানায়। আমিও সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ি। 

আমি মনে করি, উদ্​যাপন বা উৎসব–স্থাপত্য হিসেবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে উঠতে পারে। আমাকে এমন সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এ ছাড়া সদস্যসচিব যেভাবে সব সময় সহযোগিতা করেছেন, সেটা আসলেই উদ্দীপনা জোগায়।

আলতাফ: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এবারের বইমেলার পরিবেশ, পরিসর ও নকশা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বইমেলার স্থাপত্য–নকশা করতে গিয়ে কী কী বিষয় কাজ করেছিল আপনার মাথায়?

নির্ঝর: যেকোনো স্থাপত্য নকশা করার আগে সবার আগে বিবেচনাবোধটাকেই গুরুত্ব দিতে হয়। তারপর চলে বাস্তবতা মেনে চাহিদাগুলোকে যতটা সম্ভব যথার্থভাবে সমাধান করার কাজ। মেলার সামনে যে রাস্তার উন্নয়নকাজ চলছে, সেটাকে মাথায় রেখে প্রথম থেকেই পরিকল্পনায় যেটা ছিল—রাস্তাটা হচ্ছে বাস্তবতা। পার্কের বেষ্টনীর ঠিক পরের জায়গাটুকু নিশ্বাস এবং তারপর স্বাধীনতা স্তম্ভের জলাধারের পাশে ব্যবস্থাপনা। এই চিন্তা থেকে ব্যবস্থাপনার প্রাঙ্গণকে কয়েকটা চত্বরে ভাগ করা হয়েছে।

আমাদের ঢাকা শহরের নাগরিক জীবনে যে বাস্তবতা ও সংগ্রাম, এখানে না পারি কারও প্রতি কৌতূহলী হতে, না পারি কোনো দিকে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে। এই পরিকল্পনায় প্রধান বিষয় ছিল বইমেলায় আগত সবাই যেন স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ রয়েছে, তার সঙ্গে যেন নিজেকে যুক্ত করার উৎসাহ পায়। গ্রন্থমেলা এবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এ কারণে ‘শেকড়’, ‘সংগ্রাম’, ‘মুক্তি’ ও ‘অর্জন’ নামে পুরো আয়োজনকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগগুলো করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনকে নতুন করে বোঝার জন্য। বাংলা একাডেমি চত্বর ‘শেকড়’। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে বাকি তিনটি চত্বর ‘সংগ্রাম’, ‘মুক্তি’ ও ‘অর্জন’। প্রতিটি চত্বরের কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন তথ্য এবং উক্তি দিয়ে  স্থাপনা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে ‘বঙ্গবন্ধু পাঠ’ নামের একটা পরিসর, যেখানে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত মুজিব বর্ষের বইপাঠের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে ‘হাতেখড়ি’ নামে একটা জায়গা, যেখানে বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে বিশিষ্ট কারও হাত ধরে বাচ্চার হাতেখড়ি করাতে পারেন। এ রকম ছোট ছোট অনেক কিছু চেষ্টা করেছি নতুনত্ব হিসেবে। একটা বোধ যদি ক্রমশ জাগানো যায়, পার্ক দখল করে মেলা নয়, বরং পার্কের মধ্যে একটা বইয়ের মেলা কীভাবে হতে পারে, আসুন সেই চেষ্টা করি। জানি, রুগ্​ণ নাগরিক সুবিধার শহরে হুট করে তো সবকিছু ঠিক হবে না। পরিমাণমতো টয়লেট, আলো, দিকনির্দেশনা, বসার জায়গা, প্রতিবন্ধীবান্ধব করার চেষ্টাসহ আরও জরুরি বিষয় নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। 

আলতাফ: নকশার ক্ষেত্রে গতবারের চেয়ে এবারের ভিন্নতা কোথায়?

নির্ঝর: মূল ভিন্নতা বিন্যাসে—বিস্তারে এবং বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে পরিসর বিভাজন অর্থপূর্ণভাবে করার মধ্যে। মূল প্রবেশপথ বাড়িয়ে পুরো বিন্যাসকে ছড়িয়ে দিতে হয়েছে প্রাঙ্গণকে বিস্তৃত করে। গতবার শুধু স্বাধীনতাস্তম্ভের জলাধারের একটা পাশ খুলে স্টল–প্যাভিলিয়নগুলোকে কিছুটা সমান্তরাল করেই সবার আনন্দ টের পাওয়া গিয়েছিল। তাই এবার শুরুতেই মনে হয়েছে, এমন একটা আবহ তৈরি করতে হবে, যেন সেখানে গিয়ে ব্যস্ত শহরের ভেতর মানুষ একটা বইপাড়ায় ঘোরাফেরা করার নাগরিক আনন্দ পায়। সে চেষ্টাই করেছি। মোটা দাগে এটাই সবচেয়ে বড় ভিন্নতা। আর স্বাধীনতাস্তম্ভের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত করা। 

আলতাফ: যেভাবে বইমেলার নকশা করেছেন, সে অনুযায়ী তা বাস্তবায়িত  হয়েছে কি? রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো হয়েছে কি?

নির্ঝর: এ কাজের বড় চ্যালেঞ্জ বাজেট, সময়সীমার অনিশ্চয়তা, মেলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পুরোনো অভ্যাস। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়, সংস্থার মন রক্ষা করে কাজ করতে হয়। মেলার জন্য নির্ধারিত বাজেট নেই। অদ্ভুত কায়দায় এটি হয়। একটি স্পন্সর কোম্পানি দয়া করে যে টাকা দেয়, সেই টাকা দিয়ে যেভাবে ম্যানেজ করা যায়, সেভাবে কাজটি করতে হয়।

রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনা তো পারস্পরিক বিষয়, এটা এককভাবে কেউ সফল করতে পারে? বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ যখন সামগ্রিক আগ্রহের জায়গায় এসে দাঁড়াবে, তখন এটা জাতিগত রুচিবোধ, নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হবে। আমরা সবাই তো মোটামুটি অভিযোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি—আমার কোনো দায়িত্ব নেই, সব অন্যরা ঠিকঠাক বিদেশের মতো করে দেবে, নাকি? ভবিষ্যতে কিছু স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করতে চাই, যাতে এগুলো প্রতিবার তৈরি করতে না হয় এবং ভাঙতে না হয়। 

আলতাফ: অনেকেই বলছেন, বইমেলায় আরও বসার জায়গা করার দরকার ছিল।

নির্ঝর:  শুধু বসা নয়, আরও অনেক কিছুরই দরকার ছিল, যেটা আগেই বলেছি। তবু তো স্বাধীনতাস্তম্ভের জলাধারের দুই পাশ যুক্ত হওয়ায় কিছু নির্বাচিত বসার জায়গা রয়েছে। আসলে এসবের জোগান দেবে কে? এবার তো শেষ পর্যন্ত বাড়তি টয়লেট, প্রয়োজনীয় আলো, যথার্থ দিকনির্দেশনাসহ আরও অনেক কিছুই করতে পারিনি। যেমন পারিনি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা লেন করতে, বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুদের জন্য বাড়তি অংশগ্রহণমূলক পরিসর বানাতে। আসলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো জরুরি ও সম্মানজনক আয়োজনে যদি সরকারের কোনো বরাদ্দ না থাকে, তাহলে কে করবে এর সমাধান? আমি তো স্বেচ্ছাশ্রমে করছি। উচিত কথা বললে আমি টিকতে পারব কি না জানি না। তবে বাংলা একাডেমির যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে। ভবিষ্যতে যদি আমাকে সুযোগ ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়; সময়, প্রস্তুতি, অর্থ বরাদ্দ ঠিকমতো হয়, তবে আগামী বইমেলাকে একটা উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে পারি।

আলতাফ: সারা বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?

নির্ঝর: সারা বছর উদ্যানকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে সবার আগে দরকার বুদ্ধিদ্বীপ্ত স্থাপত্য সমাধান, যা প্রয়োজন মিটিয়ে নকশার পাশাপাশি ভিন্নমাত্রার অংশগ্রহণমূলক শৈল্পিক আবহ যোগ করবে। আসলে নাগরিককে তো উৎসাহ দিতে হবে, অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে পরিচ্ছন্ন থাকার। তা না হলে রাতারাতি কোত্থেকে তার দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে। আর আয়োজনগুলোকে পারস্পরিক করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে আমাদের মতো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পাগলদের উদ্যোগে উৎসাহ দিতে হবে। এখানে সারা বছর হয়টা কী? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক আয়োজনের জন্য যে অস্থায়ী ব্যবস্থাগুলো করা হয়, তা হয় সম্পূর্ণ বিবেচনাহীনভাবে। এ ছাড়া আরেকটা বিষয় সবাই জানেন, উদ্যানের বেশ বড় অংশ মাদকাসক্তদের ঠিকানা। সেটাকে মুক্ত করতে চাইলে সবার আগে দরকার অভিভাবকের ইচ্ছা। আমি বা আমরা তো বুদ্ধি নিয়ে দাঁড়িয়েই আছি। এখানে সকালে যাবে একদল শরীরচর্চা করতে, বিকেলে প্রেম করতে, রাতে বিভিন্ন আয়োজনে যোগ দিতে। তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিলে সেটা সব আয়োজনের জন্যই আশীর্বাদ হতে পারে। আসলে পাবলিক ইন্টারেস্ট আর খুচরা উদ্যোগ না ভেবে একটা ভবিষ্যন্মুখী বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান প্রয়োজন।