'গোলাপের নাম' উপন্যাস সম্পর্কে কিছু কথা

উমর্বেতো একো
উমর্বেতো একো

১৩২৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের শেষাশেষি ইতালির একটি বেনেডিক্টীয় মঠে এসে উপস্থিত হয়েছেন মধ্যবয়স্ক ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসী বাস্কারভিলের উইলিয়াম ও তাঁর সঙ্গী বেনেডিক্টীয় শিক্ষানবিশ আদেসা, যিশুখ্রিষ্টের দরিদ্রবিষয়ক একটি বিতর্কে অংশ নেওয়ার জন্য। তাঁরা মঠে পৌঁছে দেখেন, সেখানে এক সন্ন্যাসীর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে। উইলিয়ামের ওপর দায়িত্ব পড়ে এই মৃত্যুরহস্য উদ্‌ঘাটনের। দেখতে দেখতে সাত দিনের মধ্যে, বীভত্স এবং রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন আধা ডজন সন্ন্যাসী।

এই হচ্ছে ইতালির অত্যন্ত প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, চিহ্নবিদ্যাবিশারদ, শিক্ষক উমবের্তো একো (৫ জানুয়ারি, ১৯৩২-১৯-এ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬) রচিত ৫০০ পৃষ্ঠার বৃহদায়তন উপন্যাস ‘Il nome della rosa’ বা ‘গোলাপের নাম’-এর কঙ্কাল-কাঠামো।

ইতালীয় ভাষায় লেখা উপন্যাসটি প্রথম ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর নানা ভাষায় অনুবাদসহ (উইলিয়াম উইভারকৃত ইংরেজি ভাষান্তরসহ) পাঁচ কোটির বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। স্রেফ আধা ডজন খুনের রহস্য জানার জন্য জগতের এত পাঠক নিশ্চয়ই বইটি কেনেননি বা পড়েননি, যদিও একোর গোয়েন্দাপ্রবর যেভাবে এই হত্যারহস্য উন্মোচন করেন, তা যেমন অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সেই সঙ্গে হতবুদ্ধিকর রকমের আনন্দদায়ক।

কোনো (রহস্য) উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হলে সেটার বিক্রি বাড়ে, বিশেষ করে সেই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় যদি শ্যন কনারির মতো কোনো ভুবনজয়ী তারকা অভিনয় করেন (উল্লেখ্য, বিখ্যাত পরিচালক জাঁ-জাক আনু ১৯৮৬ সালে উপন্যাসটিকে ভিত্তি করে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যেটি লেখককে তুষ্ট করতে পারেনি এবং মার্কিন মুলুকে ততটা আদৃত হয়নি, যদিও ইউরোপে বেশ সাড়া ফেলেছিল। এক বালিকা তো একটি বইবিপণিতে উপন্যাসটি দেখে এমনকি বলে উঠেছিল: ‘ও, এরই মধ্যে ওরা সিনেমাটি থেকে একটা বই লিখে ফেলেছে!’)। এ ছাড়া বই পুরস্কার পেলেও সেটির বিক্রি বাড়ে। ‘গোলাপের নাম’ ইতালির সবচেয়ে সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার Premio Strega এবং ফরাসি দেশের Prix Médicis-সহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছে। কিন্তু সম্ভবত এসব কারণে ‘Il nome della rosa’ বা ‘গোলাপের নাম’ পাঠকের এমন আশ্চর্য সমাদর লাভ করেনি।

করেছে এই কারণে যে হত্যারহস্য উন্মোচনের কঙ্কাল-কাঠামোটি নির্ভর করে উমবের্তো একো চিহ্নবিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্ব, বাইবেলের নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, মধ্যযুগের দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্যতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, ইত্যাদি সহযোগে একটি চমকপ্রদ ইতিহাস-আশ্রিত কাহিনি নির্মাণ করেছেন। সেই সঙ্গে এটি জ্ঞানের সংরক্ষণ বনাম জ্ঞানের বিতরণ গ্রন্থাগার, বই, গোলকধাঁধা, বই, আর অনুবাদ নিয়েও রচিত একটি উপন্যাস; আর এই অনুবাদের সূত্র ধরে আসে সাইন বা প্রতীক, ও চিহ্নবিজ্ঞানেন (সেমিওলজি) প্রাসঙ্গিকতা—শুধু গ্রন্থ অনুবাদ নয়, বরং গোটা জগৎকেই একটি গ্রন্থ হিসেবে ধরে নিয়ে সেটার মেলে ধরা সংকেতগুলোর পাঠোদ্ধার করে জগতের যাবতীয় রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের বিষয়টি।

গোলাপের নাম ছবির সেটে উমর্বেতো একো, শন কনোরি ও চলচ্চিত্রের অন্য অভিনয় শিল্পীরা
গোলাপের নাম ছবির সেটে উমর্বেতো একো, শন কনোরি ও চলচ্চিত্রের অন্য অভিনয় শিল্পীরা

গোয়েন্দা বা রহস্যকাহিনি বা হুডানিটের একটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা হলো মূল রহস্যটি উন্মোচিত হওয়ার পর, অর্থাৎ খুনি বা অপরাধীর পরিচয় পাঠক একবার জেনে যাওয়ার পর বইটির প্রতি সেই পাঠকের আর কোনো আকর্ষণ থাকে না বললেই চলে। সেই সঙ্গে রয়েছে ভাষার ব্যাপারটি। বেশির ভাগ রহস্য বা গোয়েন্দাকাহিনির ভাষাই যেন প্রায় একই রকম: ছোট ছোট সাধারণ শব্দে ছোট ছোট, টান টান বাক্য, যার প্রায় প্রতিটিতেই যেন রহস্যকে ঘনীভূত করার একটা চেষ্টা এবং দীর্ঘ বাক্য পরিহার করার একটা প্রবণতা। ‘গোলাপের নাম’ সেদিক থেকে বিরল ব্যতিক্রম। এখানে কোনো কোনো বাক্য এমনকি শতাধিক বাক্যেরও একটি জটিল সমাবেশ, বিষয়বস্তু আর সিনট্যাক্সের দিক থেকে। উপন্যাসটির ভাষার সৌন্দর্য এমনই যে এটি পাঠের অব্যবহিত পর অন্য কোনো থ্রিলার বা গোয়েন্দাকাহিনির ভাষা পাঠকের কাছে নিতান্তই জোলো বলে মনে হতে পারে, সেই ক্লিশে ব্যবহার করে বলা যায় যে ‘পাতায় পাতায় রহস্য ও উত্তেজনার টান টান আকর্ষণ’ না থাকলে সেই বইটি কিছুদিন তার পক্ষে আর পড়ে ওঠা সম্ভব নাও হতে পারে।

তবে এ ক্ষেত্রে আমরা, সংগত কারণেই, একটি প্রহেলিকার কথা উল্লেখ করতে পারি। এ ধরনের জটিল গ্রন্থের অনুবাদে আমরা সাধারণত দীর্ঘ, পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভূমিকা দেখে থাকি, হয় অনুবাদকের নিজের লেখা বা আমন্ত্রিত ভিন্ন কোনো লেখকের সেই সঙ্গে থাকে প্রচুর টীকা-ভাষ্য (জেমস জয়েসের ইউলিসিস এর চিনীয় অনুবাদে ৫০০০-এরও বেশি টীকা রয়েছে।) কিন্তু উমবের্তো একোর ‘Il nome della rosa’ উপন্যাসের উইলিয়াম উইভারকৃত তর্জমায় (এবং অন্য কোনো উপন্যাসে তো বটেই এমনকি ইতালো কালভিনোর ‘ইনভিজিবল সিটিজ’ নামক গ্রন্থেও) এ ধরনের কোনো ভূমিকা নেই বা টীকা-ভাষ্য নেই। তারপরেও গ্রন্থটির এই বিপুল জনপ্রিয়তা বিস্ময়কর বৈকি। কারণ উপন্যাসটি বিশেষত মধ্যযুগের শেষ পর্বের নানান ঐতিহাসিক ঘটনা এবং গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উল্লেখে ভরপুর। এখানে উল্লিখিত হয়েছেন অসংখ্য সন্ত [যেমন এজিলাফ (Agiluf), আলদেমার (Aldemar), ফলিনো-র অ্যাঞ্জেলা (Angela of Foligno), মন্টেফাল্কোর ক্লেয়ার (Clare of Montefalco) ], বিভিন্ন হেরেটিক বা ধর্মদ্বেষী ব্যক্তি বা দল [আর্নল্ডিস্ট (Arnoldist), বেগার্ড (Beghards), বিতোচি (Bizochi), ভালদেনসীয় (Waldensians), উইলিমাইট (Williamites) ]; রয়েছে ককেইন (Cockaigne), কিমেরিয় কুয়াশা (Cimmerian fog), ব্লেমিয়ে (Blemmyae) আর ফ্যালারিসের ষাঁড়ের (Bull of Phalaris) মতো নানান পৌরাণিক উল্লেখ। উপন্যাসের গোলকধাঁধাময় গ্রন্থাগারের তাকগুলোয় মুখ গুঁজে থাকা অনেক নিতান্ত তুচ্ছ এবং অখ্যাত লেখকের নাম আর গ্রন্থের কথাও উল্লেখ করেছেন একো। আর আছে, অসংখ্য লাতিন, ফরাসি এবং জার্মান শব্দ, শব্দবন্ধ, বাক্য ও অনুচ্ছেদ, যেসবের অনুবাদ লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই সরবরাহ করেননি। ফলে, সব মিলে, উপন্যাসটি পাঠের ক্ষেত্রে তৈরি হয় এক দুস্তর বাধা। তারপরও উপন্যাসটির অত্যাশ্চর্য জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হিসেবে একোর এই কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে লোকে সাদামাঠা জিনিসে বিরক্ত; তাঁরা চান কোনো লেখা, উপন্যাস ইত্যাদি তাঁদের পাঠক্ষমতা, বৃদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করুক। একটি সেরেব্রাল উপন্যাস বোধ হয় এ জন্যই বেস্ট সেলার হয়। দুষ্ট লোকেরা অবশ্য স্টিফেন হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ নামের গ্রন্থের বিপুল কাটতির দিকে ইঙ্গিত করে বলতে পারেন যে সেটি যেমন মানুষ হকিংয়ের খ্যাতি ইত্যাদি দেখে কিনেছিল, কিন্তু শোনা যায় অনেকেই তা পড়েনি, তেমনি অত্যন্ত জটিল উপন্যাসের তালিকায় প্রায়ই ঠাঁই করে নেওয়া ‘গোলাপের নাম’ও যতজন কিনেছিলেন, তার বেশির ভাগই সেটি শেষ করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

গোলাপের নাম বইয়ের প্রচ্ছদ
গোলাপের নাম বইয়ের প্রচ্ছদ

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ‘গোলাপের নাম’ যখন বের হয়, তখন একোর বয়স ৪৮, এবং তাঁর পরিচিতি তখন দর্শন, চিহ্নবিদ্যা এসব তাত্ত্বিক, ভারী ভারী গ্রন্থ রচনার জন্য। এমন একজন মানুষই ১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলে দিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে ছোটবেলা থেকেই তাঁর আখ্যান বা ন্যারেটিভের প্রতি একটি স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল, দশ–বারো বছরেই তিনি নানান গল্প লিখেছেন, এমনকি কয়েকটি উপন্যাসের শুরুর দিকটা রচনা করেছিলেন। আর তাঁর সব গবেষণাকর্মের কাঠামোই হুডানিটের। এমনকি তাঁর শিক্ষকেরাও বলেছেন যে টমাস একুইনাসের ওপর রচিত তাঁর ডক্টরাল থিসিসেও এই কাঠামোটি লক্ষ করা যায়।

‘গোলাপের নাম’ অবশ্যই প্রথম উপাখ্যান নয়, যেখানে আমরা কোনো সন্ন্যাসী বা যাজককে গোয়েন্দার ভূমিকায় দেখতে পাই। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য জি কে চেস্টারটনের ফাদার ব্রাউন, হ্যারি কেমেলম্যানের ‘র‌্যাবাই’ (ডেভিড স্মল) উপন্যাসসমূহ এবং এলিস পেটার্সের ‘ক্যাডফায়েল ক্রনিকলস’, যেখানে ‘গোলাপের নাম’-এর মতোই একজন রহস্যভেদী মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসীকে ঘিরে কাহিনি আবর্তিত হয়। তবে ‘গোলাপের নাম’ সম্ভবত এ কারণে একটি বিশিষ্টতার দাবি করতে পারে যে উপন্যাসটি একই সঙ্গে এই জঁরটির একটি সমালোচনা এবং প্যারডিও বটে।

এই বইয়ের সমস্ত পাণ্ডিত্য, রহস্যের ঘনঘটা ভাষার সৌন্দর্য, গাম্ভীর্য, পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার বিস্ময়ের পাশাপাশি কাণ্ডজ্ঞান আর সহনশীলতা, মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা দোষত্রুটির প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্লীন সুরটি এই বইয়ের একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।

‘গোলাপের নামে’ এবারের বই মেলায় সদ্যই প্রকাশিত হয়েছে, প্রকাশক বাতিঘর।