আমির আজিজের 'সব মনে রাখা হবে'

রজার ওয়াটার্স এবং আমির আজিজ
রজার ওয়াটার্স এবং আমির আজিজ

কবিরা ফিরে এসেছেন। তাঁরা ফিরে এসেছেন চিলিতে। ফিরে এসেছেন ভারতের আসামের মিয়া কবিতা হয়ে। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের, ‘হাম দেখেঙ্গে’, হাবিব জালিবের, ‘দস্তুর’ অথবা রাহাত ইন্দোরির ‘এ কারও বাপের হিন্দুস্তান না’ হয়ে। মন্ত্র কবিতা হলে স্লোগানও কবিতা হতে পারে। কবিতা যদি সময়ের ঘটে যাওয়া মোচড় ধরতে না পারে, তাহলে সময়ও তার কথা ভুলে যায়। চিরকালীন হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজের কালকে ধরতে পারা। বাতাসের সমুদ্রের মাঝে ডুবে থাকার মতো আমরা বর্তমানে ডুবে থাকি। আর তাই বর্তমানকে বুঝতে পারা সবচেয়ে কঠিন। এই বর্তমানে জমে থাকে সমগ্র অতীত। বর্তমানে বীজ হয়ে থাকে ভবিষ্যৎ।

ফয়েজের ‘হাম দেখেঙ্গে’ কবিতা জীবনের শেষ বয়সে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিল। হাবিব জালিব প্রকাশ্যে রাজপথে বহুবার বেধড়ক মার খেয়েছেন, জেল খেটেছেন সামরিক স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে। সেই কবিতাগুলো এখন গান হয়ে, স্লোগান হয়ে মুখে মুখে ফিরছে ভারতের, পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের। আমির আজিজ জন্মেছেন ১৯৯০ সালে। এই বয়সেই তিনি নাম লিখিয়েছেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, হাবিব জালিবদের তালিকায়।

প্রায় এক বছর আগে এই তরুণ কবি ইউটিউবে ‘আচ্ছে দিন ব্লুজ’ নামে একটা ভিডিও প্রকাশ করেন। বিজেপির ‘আচ্ছে দিন’ প্রচারণার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আসে এই ভিডিও। আমিরের ভিডিও ভাইরাল হয়।
এর ১১ মাস পর আরেকটা ভিডিও আসে। এবার আমির আজিজ ভারতজুড়ে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। সেই স্বর আর ভারতের সীমানায় আটকে থাকল না। আমির আজিজ তখন বিহারে কানহাইয়া কুমারের এক জনসভায় গেছেন। উদ্দেশ্য, তাঁর কমরেডের সভায় কবিতা পড়বেন। সেখানে ইন্টারনেট পৌঁছায় না। নয়তো আমির আজিজ জানতে পারতেন যে এর কিছুক্ষণ আগে লন্ডনে আরেক জনসভা শুরু হয়েছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবিতে। পিংক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার সেই সমাবেশে আমিরের কবিতা পাঠ করছেন। সব য়াদ রাখখা জায়েগা।
বিহারের পাটনার এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে বিশ্বজুড়ে অন্যায় আর অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠেন। কম বয়সে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৬ সালে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। নিজের দরিদ্র গ্রামের ছবি এবার তাঁর কাছে তুলনা করা সম্ভব হয় বাইরের সঙ্গে। ‘ফিল্ম কম্প্যানিয়ন’কে তিনি বলছেন:
‘বিহারকে বলা যায় ভারতের সামন্তবাদের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতীক। সেখানে থাকলে এসবই দেখতে পাবেন। কিন্তু এই দেখাকে বোঝা, তা অন্যকে বোঝানোর জন্য তেমন ভাষা তো চাই! আর যখনই সেই ভাষা পেয়ে যাবেন, আপনার প্রকাশও বুঝে যাবে কোন দিকে যেতে হবে।’
জামিয়াতে আমির গিটার তুলে নিলেন। গান হলো তাঁর নিজেরই লেখা কবিতা। সুরও নিজের। বিষয় নিজের দেখা অসাম্যে, বঞ্চনায় জীর্ণ মানুষের জীবন। শ্রোতা হলো নিজের আড্ডার বন্ধুরা। সেই কবিতা চারপাশে যা ঘটছে তারই বয়ান। কোন জটিল প্রতীক, উপমা নেই তাতে। যাদের জন্য লেখা, তাদেরই জীবন থেকে শব্দ নিয়ে লেখেন আমির।
চারপাশে এত কিছু ঘটে চলছে! এর মাঝেও যে কবিকে বিষয় খুঁজে মরতে হয়, আমির তেমন কবি নন। নিজের আবেগ প্রকাশ করতে তাঁকে বোধ্য কোনো উপমার কাছে মাথা নত করতে হয় না। শ্রোতারা তাঁকে বুঝতে পারেন। কারণ, তাঁর কবিতার অভিধান হলো বাস্তব, বর্তমান আর অনস্বীকার্য বাস্তব ঘটমান জীবন।
আমিরের কিছু কবিতা ভিডিও হয়েছে। অনুবাদ হয়েছে সামান্য কয়েকটা। সামাজিক মাধ্যমে সেসব কবিতা তোলা আছে। ‘আচ্ছে দিন ব্লুজ’–এর পর প্রকাশ করেছেন ‘ব্যালাড অব প্যাহলু খান’। প্যাহলু খান আলওয়ারে ২০১৭ সালে গোরক্ষকদের হাতে বর্বরভাবে পিটুনিতে নিহত কৃষক। বীভৎস সেই ঘটনার সূত্র ধরে আমির ভারতের সেক্যুলারিজমের হালহকিকতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
সিএএ–বিরোধী এক সমাবেশে পড়লেন ‘ম্যায় ইনকার করতা হুঁ’ নামে এক কবিতা। এ যেন পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনের বিরুদ্ধে হাবিব জালিবের বিখ্যাত কবিতা ‘ম্যায় নেহি মানতা’র আজকের পাঠ। আমির বলছেন:
তোমরা নিশ্চয়ই গুলি করতে পারো আমাদের
গুলিতে আমরা মরে যাবই এমন কোনো কথা নেই
নিশ্চয়ই মরতে ভয় লাগে আমাদের
তবে সেই ভয়ে আমরা ভয় পেয়ে যাব এমন কোনো কথা নেই
...
অন্যায়কে না বলা বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ
আমি আস্বীকার করি সেই পদক্ষেপ ফিরিয়ে নিতে

আমির  আজিজ
আমির আজিজ

এবার আমির আজিজ আর নিজ ক্যাম্পাসে আটকে থাকতে পারলেন না। ভারতব্যাপী আন্দোলনের পক্ষের মানুষদের আওয়াজ হয়ে গেলেন। এর পরপরই এল ‘সব য়াদ রাখখা জায়েগা’। এবার তিনি ছড়িয়ে গেলেন দেশের সীমা পার হয়ে দেশে দেশে।
কবিতা না লিখে আমিরের উপায় নেই। কবিতা তাঁর বিলাস নয়। নিউজক্লিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘আধার কার্ডে আমার নাম আমির আজিজ। আমাকে বিপদে ফেলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আমার সব গান, সব কবিতা একটা শক্তি। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর যে সহিংসতা ঘটছে, একজন শিল্পী সেই ভয়াবহতা, সেই বেদনার উত্তরে আর কোনো উপায়ে সাড়া দিতে পারে?’
নাগরকিত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রীদের নিয়ে লিখলেন, ‘জামিয়ার মেয়েরা’ নামে কবিতা:
রাজাদের আবরণ তুলে ছুড়ে ফেলে
ইশারায় বিপ্লব করে জামিয়ার মেয়েরা
আমির হতে চেয়েছেন অভিনেতা। গান আর কবিতাকে তিনি নিতান্ত ব্যক্তি–অনুভূতির জন্য জমা রেখেছিলেন। সেই কবিতা আসলে অন্য সবার, যা ঘটনাচক্রে তিনি লিখে ফেলছেন। সেই অনুভূতি এত সৎ, এত জোরাল যে আমির না চাইলেও কবি হয়ে গেছেন। কবি বোধ হয় এমন করেই হতে হয়।


সব মনে রাখা হবে
আমির আজিজ
তোমরা রাত লেখো আমরা লিখব চাঁদ
তোমরা জেলে ঢোকাও দেয়াল ভেঙে লিখব আমরা
তোমরা এফআইআর লেখো, আমরা প্রস্তুত
তোমাদের হত্যাকাণ্ডের সব প্রমাণ লিখব
তোমরা আদালতে বসে মশকরা লেখো
আমরা রাজপথে দেয়ালে লিখব ইনসাফ
বলব এমন জোরে যেন বধিরও শোনে
এমন স্পষ্ট লিখব যেন অন্ধও পড়ে ফেলে

তোমরা কালো পদ্ম লেখো
আমরা লিখব লাল গোলাপ
তোমরা জমিনে জুলুম লেখো
আকাশে লেখা হবে বিপ্লব
সব মনে রাখা হবে
সবকিছু মনে রাখা হবে, সব

তোমাদের লাঠি গুলিতে নিহত হয়েছে যে বন্ধুরা আমাদের
তাঁদের স্মরণে হৃদয় বিরাণ করে রাখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব

কালি দিয়ে তোমরা মিথ্যে লিখবে জানি
আমাদের রক্ত দিয়েই সই, সত্য নিশ্চয়ই লেখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব

মোবাইল টেলিফোন ইন্টারনেট ভরদুপুরে বন্ধ করে
ঠান্ডা অন্ধকার রাতে পুরো শহর নজরবন্দী করে
হাতুড়ি নিয়ে অতর্কিতে আমার ঘরে ঢুকে পড়া
আমার সারা শরীর আমার ছোট্ট জীবন চুরমার করে যাওয়া
আমার হৃদয় মনিকে চৌরাস্তার মাঝে মেরে
নিজের পালে ফিরে তোমার এমন নির্বিকার হাসি
সব মনে রাখা হবে, সব

দিনে মিষ্টি কথা সামনে এসে
সব ভাষায় আধো আধো বলা—সব ঠিক আছে
আর রাত হলেই অধিকার চাওয়া মানুষের ওপর লাঠি, গুলি চালানো
আমাদের হামলা করে আমাদেরই আক্রমণকারী বলা
সব মনে রাখা হবে, সব

এই সব ঘটনা লিখে রাখব আমি আমার হাড়ে
আমি আছি তা প্রমাণের দলিলপত্র চাও আমার কাছে
আমি থাকার প্রমাণ তোমাকে দেওয়া হবে নিশ্চয়ই
তোমার শেষনিশ্বাস পর্যন্ত চলবে এই লড়াই
সব মনে রাখা হবে, সব

কেমন করে দেশকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছ মনে থাকবে এই কথাও
কেমন আদরে চেয়েছি আমরা তাকে অটুট রাখতে মনে থাকবে এই কথাও

যখনই জগতে কাপুরুষতার কথা উঠবে, তোমার অপকর্মের কথা মনে রাখা হবে
যখনই জগৎ বলবে, কাকে বলে বাঁচা, আমাদের কথা মনে রাখা হবে
কিছু মানুষ তো ছিল, যাদের সংকল্প ভাঙতে পারেনি লোহার হাতকড়া
কিছু মানুষ তো ছিল, যাদের বিবেক কিনতে পারেনি ইজারাদারের কড়ি
কিছু মানুষ তো ছিল, যারা দাঁড়িয়ে ছিল নুহের প্লাবন হওয়ার পরও
কিছু মানুষ তো ছিল, নিজের মৃত্যুসংবাদের পরও বেঁচে ছিল যারা

পলক ভুলে যাক চোখকে ঢাকার কথা
পৃথিবী যাক ভুলে অক্ষপথে ঘোরা
মনে থাকবে আমাদের কাটা ডানার ওড়া
মনে থাকবে এই স্লোগান আমাদের এই ভাঙা গলা

সারা জীবন যেন দেওয়া যায় তোমাদের নামে অভিসম্পাত
কলঙ্ক যেন লেপন করা যায় মূর্তিতে তোমাদের
তোমাদের নাম তোমাদের ভাস্কর্য টিকিয়ে রাখা হবে
সবকিছু মনে রাখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব