জেবুন্নাহারের প্রথম প্রেম

দয়াগঞ্জ কলেজের সিনিয়র প্রভাষক জেবুন্নাহার তৃতীয় চিরকুটটি পেল তার ৩৫তম জন্মদিনের দিন। প্রথমবার চিঠি পেয়ে জেবুন্নাহার বিরক্ত হয়েছিল। ভেবেছিল নির্ঘাত কোনো ইঁচড়েপাকা ছাত্রের কাজ। দ্বিতীয় চিঠিটি পেয়ে জেবুন্নাহার সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। এবং আজ, তৃতীয় চিঠিটা পেয়ে জেবুন্নাহারের কেমন ভালোই লাগল! আর তা ছাড়া চিঠিখানা একটু সাহসীও বটে!

‘শুভ জন্মদিন জেবু!
যদি মাঝরাতে কল দিয়ে এ কথাটাই বলি, কেমন হবে বল তো?’

কেমন হবে? জেবু, মানে জেবুন্নাহার জানে না। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে তার!

শৈশবেই মা–বাবাকে হারানো জেবু বড় হয় মামাবাড়িতে। পড়াশোনায় ভালো ছিল। সুশ্রীও ছিল। ২০ পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসা শুরু হয়। আর কী অদ্ভুত! একটা সম্বন্ধও টিকল না! জেবুর কাছে আজও ব্যাপারটাকে রহস্যময় মনে হয়। একটা মেয়ে দেখতে–শুনতে ভালো, পড়াশোনায় ভালো, হ্যাঁ, মা–বাপ মরা মেয়ে অভাবী মামার কাছে বড়, সেটা হয়তো একটা ডিজ-অ্যাডভান্টেজ, কিন্তু তাও একেবারে বিয়ে না হওয়ার মতো, এমন তো না!

দেখতে দেখতে জেবুর পড়াশোনার পাট চুকোয়, বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার হয়ে একটা সরকারি কলেজের প্রভাষকও হয়ে যায়, কিন্তু হৃদয়ে প্রেমের দিন আর এল না। দু–একজন যে দুর্বলতা দেখায়নি তা না, কিন্তু মেয়ে তো, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের জোরটা প্রবল। কোন পুরুষ প্রাণীর কী মতলব, তা বেশ ভালোই বুঝতে পারে জেবু। তাই আত্মসম্মানে টগবগে জেবু কারও জালেই ধরা দেয়নি। শীত আসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় বসন্তেরা। জেবুর ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে থাকে নিরন্তর। ইদানীং আর ইচ্ছেটাও জাগে না। জেবুর গেছে যে দিন, একেবারেই গেছে!

ঠিক যে সময়টাও জেবু ইচ্ছেহীন, ক্লান্ত, বিষণ্ন প্রাণ এক হয়ে উঠছিল, তখনই সাদাকালো বায়োস্কোপে একগাদা ক্রেয়ন গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিল একটা চিরকুট।

জেবু চিরকুটটা পেয়েছিলেন ভোরে। গ্রীষ্মের দিন, জানালার নেট টেনে পাল্লা খুলেই শোয় জেবু। কেউ একজন রাতের কোনো এক সময়ে জানালার নেটটা আলগোছে সরিয়ে চিরকুটটা গলিয়ে দিয়ে গেছে। সেই থেকে সারাটা দিন ভীষণ আনমনা কেটেছে জেবুর। ক্লাসে বসে ছিল চুপ করে। টিচার্স রুমেও আড্ডায় খুব একটা অংশ নিতে পারেনি। কল কি আসবে আজ রাতে?

জেবু আজ একটু সকাল সকালই বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়ি বলতে হোস্টেল। ছাত্রী ও কর্মজীবী মেয়েদের। সিকিউরিটির ব্যাপারে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের একটা প্রকাশ্য আলস্য আছে। মফস্বল এলাকা। সবাই সবার পরিচিত। কীই–বা হবে! সে আলস্য থেকেই জেবুর মেঝেতে এক এক করে তিনটি চিরকুটের উদয়।
দুইটা বাজে। জেবু গোসলে যাচ্ছিল। কী ভেবে যেন আজ ফোনটা নিয়ে নিল সঙ্গে!

দুপুর গড়িয়ে যায়। জেবু অন্যমনস্কভাবে ভাত চিবোয়। ফোন বাজে না। জেবুর কেমন একটা অভিমান হয়। কেন এ অভিমান, কার উদ্দেশ্যে এই গাল ফোলানো, জেবু জানে না। জানতে চায়ও না। মনে কত কিছুই তো ঘটে, সব সময় কারণ–অকারণ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায় নাকি? ৩৫তম গ্রীষ্মে জেবুর হৃদয় যে নতুন শাড়ি পরতে শেখা এক অষ্টাদশীর মতো কাঁপছে, তারও কি কোনো ব্যাখ্যা আছে?

বিকেলে কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল, কে জানে! মনে ঝড় বইতে থাকলে শরীরের কেমন যেন একটা ক্লান্তি আসে। জেবুর ঘুম ভাঙল যখন চারপাশ অন্ধকার, ঘড়ির কাঁটায় রাত আটটা, ঘরে আলো দেওয়া হয়নি। অন্যদিন হলে জেবু তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বালত। আজ কেমন ইচ্ছে করছে না। জেবু ফোন দেখে। নিরু কল দিয়েছিল দুবার। বিকেলে চা-টা খেতে নামেনি বলেই হয়তো।
আচ্ছা, মাঝরাত মানে ঠিক কয়টা? বারোটা? নাকি আরও গভীর রাত? জেবু ঘড়ি দেখে। ৮টা ৫৫। টিভিতে একের পর এক চ্যানেল পাল্টায় জেবু। কোথাও ভালো কিছু নেই আজ। তাও স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় সয়ে যায় অপেক্ষাটা। মাঝে একবার উঠে ডাইনিংয়ে গিয়ে দুটো খেয়ে আসে। নিরু জানতে চায় বিকেলে নামেনি কেন। শরীরটা ভালো নেই বলেও এড়িয়ে যেতে পারে না জেবু। নিরু এসে কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘কই, জ্বর নাই তো!’ শরীর খারাপ মানেই জ্বর থাকবে, এই ধারণার উৎপত্তি কোথা থেকে কে জানে!

জেবু দাঁত ব্রাশ করে করে শুতে যায়। লাইট নেভানোর আগে সব সময় একবার ঘড়ির দিকে তাকায় জেবু। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। সাড়ে এগারোটা। জেবুর বুকটা একবার প্রচণ্ডভাবে ধক করে ওঠে! এরপর একদম পিনপতন নীরবতা। বুকের ভেতর আর কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। ভোরের সেই উচ্ছ্বাস কেমন যেন বেদনার মতো ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। ভেসে যাওয়ার ঠিক আগে আলো নিভিয়ে খাটের ওপর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে জেবু। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদে। একটা স্বপ্নে ভেসে যাওয়া দিন এক ধাক্কায় প্রি-টেস্টের রুটিনের মতো ছককাটা বাস্তবে ফিরে আসে।

জেবু সামলে নেয়। একদিনের কিশোরীকাল পেছনে ফেলে ফের নারী হয়ে ওঠে। নিজের চেয়েও শক্ত করে জানালার গ্রিল আঁকড়ে বসে থাকে। আস্তে আস্তে আকাশটা ফরসা হয়ে আসছে। আহ! কত দিন পর ভোর দেখল জেবু! রাত ফুরিয়ে আসার আগে বাতাসে ভোরের গন্ধ পাওয়া যায়। জেবু সেই ভোরের গন্ধে প্রাণভরে শ্বাস নেয়। একটু পরেই ফজরের আজান দেবে। আলোয় ভেসে যাবে শহর। জেবু খোঁপায় দায়িত্বের কাঁটা বিঁধিয়ে কাঁধে তুলে নেবে তার স্কুলশিক্ষকসুলভ বড় ব্যাগটা।

খাটের ওপর পড়ে থাকা ফোনটার ভাইব্রেশন টের পায় জেবু। ইচ্ছে হয় না তাকাতে। শব্দটা ক্লান্ত হয়ে মিলিয়ে যায় একটা সময়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফের ভোরের দিকে চোখ রাখে ও। আকাশের আলোর রেখা ফুটে ওঠে জেবুর ঠোঁটে!