'পরশপাথর' এবং বাঙালির চ্যাপলিন

তুলসী চক্রবর্তী  অভিনীত কিছু ছবি
তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত কিছু ছবি

অ্যান্ড্রু রবিনসন বলেছিলেন, ‘chakravarti recalls Chaplin to his best. Instead of moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog’s which he opens wide with every emotion known to man. ’

হাওড়া থেকে তুলসী চক্রবর্তী হামেশাই হেঁটে আসতেন টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায়। উদ্দেশ্য ছিল পথচলতি মানুষ আর তাদের জীবন ও ম্যানারিজম কাছ থেকে দেখা। এই দেখাটাই তাঁর অভিব্যক্তিতে অবয়ব পেত সিনেমার পর্দায়, নাটকের মঞ্চে। চ্যাপলিন যেমন ছিলেন একজন কমপ্লিট অভিনেতা, তুলসী চক্রবর্তীও ছিলেন তেমনই একজন।
অথচ জীবনে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাননি তুলসী চক্রবর্তী। পাওনা হিসেবে ছিল অপমান, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর শুধুই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।

একসময় সার্কাসের এই সাবেক কর্মী একটি শটের আগে মেকআপ রুমে মেকআপ করতে গিয়ে দেখলেন মেকআপ ম্যান দায়সারা গোছের মেকআপ করছেন। যখন তুলসীবাবুর মেকআপ নেওয়ার পালা এল, তখন ‘মেকআপটা একটু ভালো করে করে দে বাবা’ বলায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে মেকআপ ম্যান জানিয়েছিলেন, ‘ই! মেকআপ করবে মেকআপ? কী এমন চরিত্র করেন যে মেকআপ করবেন? যান যান. . . । ’

তুলসী চক্রবর্তী
তুলসী চক্রবর্তী

‘পথের পাঁচালী’তে প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের চরিত্র করার সময়ই সত্যজিৎ রায়ের নজরে পড়েন তুলসী চক্রবর্তী। পরে সত্যজিৎ রায় যখন তাঁকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন ‘পরশপাথর’–এ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন আনন্দে।
শুটিংয়ের সময় লোকেশনে তাঁর জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন সত্যজিৎ রায়। বিস্মিত তুলসী চক্রবর্তী বারংবার ড্রাইভারকে বলতেন, ‘বাবা, আমি গাড়ি চেপে শুটিং করতে যাচ্ছি. . . এ যে আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। ’
সত্যজিৎ রায় একটি অমোঘ কথা বলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী সম্বন্ধে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ের কদর এই পোড়া দেশে কেউ করে না। তবে আমেরিকায় জন্মালে উনি নিশ্চিত অস্কার পেতেন। ’
যদিও ‘পরশপাথর’–এর জন্য সত্যজিৎ রায় তাঁকে প্রতিদিন এক শ টাকা পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছিলেন, ‘ওরে বাবা! আমি এত টাকা পাওয়ার যোগ্য নই। আর সিনেমাপাড়ায় যদি রটে যায় আমি রোজ এক শ টাকা নিচ্ছি, আমি আর কাজ পাব না, মানিকবাবু। ’
প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে আজীবন লড়াই করলেও মুখের হাসি ছিল অনাবিল। অনুপকুমারকে ছেলে বলতেন তুলসী চক্রবর্তী। প্রবল শীতে একবার অনুপকুমার তুলসী চক্রবর্তীকে একটি কোট কিনে দেওয়ায় অনুপকুমারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন।

সত্যজিতের মতে, তিনি যদি হলিউডে অভিনয় করতেন, নির্দ্বিধায় অস্কার পেতেন। তাই তো মানিকবাবু তাঁকে ভারতের মরিস শিভালিয়র মানতেন। তিনি তুলসী চক্রবর্তী। অনবদ্য একজন অভিনেতা, সাংঘাতিকভাবে বাংলার কীর্তন, যাত্রা, থিয়েটার বা অর্কেস্ট্রার দেশোয়ালি গন্ধ লেগেছিল তাঁর অভিনয়ে। তিনিই বোধ হয় বাংলা চলিচ্চত্রের চার্লি চ্যাপলিন।
কৃষ্ণনগরে জন্ম। বাবা ছিলেন রেলের কর্মচারী। তাই ছোটবেলায় ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলার এ গ্রাম-সে গ্রামে। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ার পর চাকরির খোঁজে চলে আসেন কলকাতায়, জোড়াসাকোয় জেঠার বাড়িতে। গান জানতেন, গিরিশ পার্কের কাছে এক ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চাও শুরু করেন। জেঠুর ছিল অর্কেস্ট্রার দল, সেখানে শ্যামাসংগীত গাইতেন কিন্তু জেঠা নিজের দল ছেড়ে স্টার থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর তুলসী চক্রবর্তী কাজ নিলেন মদের দোকানে। তা–ও বেশি দিন টিকল না। পড়াশোনা বিশেষ জানতেন না। তাই চাকরি মিলল না। ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দিয়েছিলেন বার্মায়। যে জাহাজে করে তিনি যাচ্ছিলেন বার্মায়, তাতে ছিল এক সার্কাসের দল। ভিড়ে গেলেন তাদের সঙ্গে। ক্লাউন সাজতেন সার্কাসে। সেটিই বোধ হয় কমেডিয়ান হয়ে ওঠার এপিলগ।
এই সার্কাসের জোকার থেকে টলিউডের আইকনিক কমেডিয়ান হয়ে ওঠার গল্পে অনেকগুলো স্তর আছে। কখনো স্ট্রাগল, কখনো কমপ্লিমেন্ট, কখনো মধ্যবিত্ত ভ্যালুজের দীপ্তি—সব মিলিয়ে এই কাহিনি মেলোড্রামাটিক, ট্র্যাজেডিক আর কোথাও বিস্মৃতির।
সার্কাস ছেড়ে চলে আসার কারণ জিজ্ঞাস করলে বলতেন, ‘শরীর থেকে জন্তুজানোয়ারের গন্ধ বেরোচ্ছে দেখে চলে এলুম। ’ ফিরে এলেন। চিৎপুরের ছাপাখানায় কাজ নিলেন। সেই ছাপাখানায় থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ছাপার সময় আলাপ হলো তৎকালীন স্টার থিয়েটারের মালিক অপরেশবাবুর সঙ্গে। তাঁর উৎসাহেই শিখলেন তবলা, পাখোয়াজ, ঢোল এমনকি নাচও। অপরেশ মুখার্জিই তালিম দিলেন টপ্পা গানের। চার ভাগের একভাগ মাস মাইনেতেই ছাপাখানার কাজ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে তিনি যোগ দিলেন স্টার থিয়েটারে। প্রথম স্টেজে অভিনয় ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে, ১৯২০ সালে। সেই থেকে শুরু। ১৯৬০ সালে শেষ মঞ্চে অভিনয় করেন শ্রেয়শী নাটকে। প্রথমে স্টার, পরে মদনমোহন থিয়েটার, প্রায় ৪০ বছরের থিয়েটার জীবনে ৪২টি নাটকে অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী।

অসম্ভব ভার্সাটাইল ছিলেন। খোল বাজিয়ে কীর্তন গাইতেন, দরকারে তবলা বাজিয়েছেন নির্ধারিত তবলচির অনুপস্থিতিতে, নিজের গলায় ছবিতে গান গেয়েছেন, আবার কবিতে তাঁকে নাচেও সাবলীল দেখিয়েছে। ১৯৩২ সালে প্রথম সিনেমায় এলেন ‘পুনর্জন্ম’–এ। পরবর্তী সময়ে অভিনয় করেছেন দাপটের সঙ্গে। সে উত্তমকুমারই হোন বা ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র বা জহর গাঙ্গুলী, সুচিত্রা বা মলিনা দেবী—সবার সঙ্গেই তিনি ছিলেন সপ্রতিভ। ‘সাড়ে ৭৪’–এর মেস–মালিক তাঁকে ছাড়া ভাবাই যায় না। বরাবরই পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও নিজেকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতেন অভিনয়ের গুণে। কেউ প্রশংসা করলে বলতেন, ‘আমি একটু চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেড়াই। এবার চরিত্রমতো তাদের তুলে ধরি। যেখানে যা লাগে আরকি! এই চরিত্র করার জন্য ভালো অভিনয় করার দরকার হয় নাকি? তোমার চারপাশে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও। ’ পরিবেশ থেকে শিখে নেওয়া যে নিছক পাভলভের প্রতিবর্ত ক্রিয়া নয়, এক নিখুঁত, মন ছুঁয়ে যাওয়া অভিব্যক্তি, তা প্রমাণ করে গেছেন তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোতে, মেস–মালিক বা বৈষ্ণব, টোলের পণ্ডিত বা মুদি, কেরানি বা হোটেলের ম্যানেজার—যে চরিত্রেই অভিনয় করেছেন, কেবল মুগ্ধতা দিয়েছেন। হাসতে বাধ্য করেছেন তবু একবারের জন্যও ভাঁড় মনে হয়নি।
‘পরশপাথর’-এ তিনিই প্রোটাগনিস্ট! পরশুরামের পরেশ দত্তকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। ‘পরশপাথর’ ছবি রিলিজের সময় কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বলতেন ‘এইবারে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনো এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে, তা সেসব মুখ তো দুরবিন দিয়ে খুঁজে বার করতে হতো। এ আমি কী হনু রে! ’
সাহিত্যিক শংকর তাঁর ‘মানব সাগর তীরে’ বইতে লিখেছেন, ‘যদি তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, নৃপতি চ্যাটার্জির মতো অভিনেতা বিদেশে জন্মাতেন, তাহলে তাঁদের স্মরণে এক-একটি সরণি থাকত। ’ অথচ এই বঙ্গদেশে তিনি উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। হাওড়ার কৈলাস বসু লেনের ঘুপচি বাড়িতে দারিদ্র্যকে প্রতিবেশী করে বেঁচে ছিলেন, পরোপকারী এ মানুষটি। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চলাফেরা করতেন। নিজের বাড়িটাও দান করে দিয়েছিলেন এলাকার পুরোহিতদের জন্য। যেদিন চলে গেলেন হইচই হয়নি, ভিড় উপচানো শোভাযাত্রাও হয়নি। কিন্তু ভালোবাসা উপচে পড়েছে।

চার্লি চ্যাপলিন
চার্লি চ্যাপলিন

পরশপাথর ছিলেন নিজেই। যা ছুঁয়েছেন সোনা হয়েছে। তাঁকে ছাড়া হয়তো হতোই না ‘পরশপাথর’। যিনি ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টি মতো হিন্দি সিনেমা করেছেন আর দরজি তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছেন নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। ভেবে তিনি আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘উফ! এ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি! ’
আমরাও ভাবতে পারিনি, চ্যাপলিনের জীবনের সঙ্গে কীভাবে গোল্লা গোল্লা চোখ, ফতুয়া পরা মানুষটির দর্শন। দুঃখকে কেমন নিজস্ব মননের অনুঘটকে জারিত করে, এমন অসামন্য সব কাজ, সহজ কমেডির ভাষায় যিনি লিখতে পারেন, তিনি অবশ্যই তুলসী চক্রবর্তী, টালিউডের পরশপাথর।
এত গুণ সত্ত্বেও তিনি নিজেকে তুলনা করতেন বাড়ির হেঁশেলের হলুদ হিসেবে। তাঁকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ বানাতে পারতেন না, তা তাঁর অন্তিমজীবনেও স্পষ্ট করে বলে গেছেন। উত্তমকুমার অভিনীত প্রায় তিন ডজন সিনেমায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী। যদিও ‘পরশপাথর’ ছাড়া আর সেভাবে কোনো সিনেমায় মুখ্য চরিত্র পাননি। ‘সাড়ে ৭৪’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘একটি রাত’ ইত্যাদি ছবিতে কোথাও তিনি মেস–মালিক, কোথাও হোটেল–মালিক, কোথাও–বা সরাইখানা-ধর্মশালার মালিক হলেও সব কটি চরিত্রে তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বোধ হয় তাঁর অভিনয়প্রতিভা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। পরশুরামের কলম থেকে বেরোনো পরেশ দত্তকে ছবিতে অবলীলায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।

জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে যে বালকটি একদা ঢুকেছিল থিয়েটারপাড়ায়, পরবর্তীকালে সেই বালকই হয়ে উঠল এক স্বনামধন্য অভিনেতা। তুলসী চক্রবর্তী নামটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। তাঁর একটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, অপরটি নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে ৭৪’। অথচ বহু ছবিতে তিনি ছোট–বড়–মাঝারি নানা চরিত্রে কত বিচিত্র রকমের অভিনয় করে গিয়েছেন। এ মানুষটি কিন্তু স্টেজপাগল মানুষ ছিলেন। ১৯৫৫ সাল থেকে টানা জীবদ্দশায় স্টার থিয়েটারেই ছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই বহু স্টেজে কাজ করেছেন। অভিনয়জীবনের শুরুতেই গোল বাধালেন। তখন ‘দুর্গেশনন্দিনী’ স্টেজ হচ্ছে। হাকিমের চরিত্রাভিনেতা অনুপস্থিত থাকায় থিয়েটারের কর্তাব্যক্তিরা তুলসীকে বললেন, ‘কী হে ছোকরা! খুব তো উইংসের ধারে বসে মন দিয়ে অভিনয় দেখো, হাকিমের পার্টটা করতে পারবে? ’ তুলসী সাহসের সঙ্গে বললেন, ‘পারব। ’ সেদিন নবাব ও দলনী বেগমের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন পালিতসাহেব ও তারাসুন্দরী। হাকিমের মুখের সংলাপ ছিল, ‘আর চিন্তা নাই বেগম সাহেবা, নবাব সাহেব এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। ’ কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘আর রক্ষা নাই বেগম সাহেবা, নবাব সাহেব এ যাত্রায় চিন্তা পেয়েছেন। ’ সংলাপ শেষ হতে না হতেই দর্শকদের সে কী হাসির রোল। তারাসুন্দরী সিন-থেকে বেরিয়ে এসেই বললেন, ‘দুটো কথাই যদি গোছ করে বলতে পারবে না, তো এখানে এসেছ কী জন্যে? ’
ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে নিজেকে গড়ে তুললেন তুলসী চক্রবর্তী। শেষ জীবনে হাওড়ায় ছোটখাটো একটা বাড়ি কিনেছিলেন। ছিলেন নিঃসন্তান। স্ত্রী ও বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী—এই নিয়ে তাঁর ছোট সংসার।
তুলসী চক্রবর্তী সবাইকে আপন করতে পারতেন বলে কম বয়সীরা প্রায়ই তাঁকে সম্বোধন করত ‘দাদু’ বলে। দেবনারায়ণ গুপ্ত একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওরা আপনার কী রকম নাতি? ’ তুলসী চক্রবর্তীর উত্তর, ‘ভাইপো ভাইঝি ভাগনে ভাগনি—এদেরই ছেলেপুলে হবে বোধ হয়। ’ দেবনারায়ণবাবু বললেন, ‘বোধ হয়’? তুলসী চক্রবর্তী বুঝিয়ে দিলেন, ‘ওদের মা-বাপকে কোনো দিন দেখিনি। জানিনেও। ওরা দাদু বললে আমিও ওদের নাতি পাতালাম। ’

পরশপাথরে তুলসী চক্রবর্তী
পরশপাথরে তুলসী চক্রবর্তী

তুলসী চক্রবর্তী স্টারের লবিতে যখন জমিয়ে রাখতেন আসর, তখন কেউ কেউ তাঁর কাছে জানতে চাইতেন যে তিনি কেন সস্ত্রীক তীর্থভ্রমণে বছরে একবার করে বেরিয়ে পড়েন না। উত্তরে তাঁর নির্মল হাসিভরা মুখে বলতেন, ‘যে থিয়েটারে একদা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের ধুলো পড়েছিল, এই স্টারে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বেলুড় মঠের প্রণম্য সন্ন্যাসীরা, গিরিশচন্দ্র ঘোষ এসে গেছেন, তার থেকে বড় তীর্থ আর কিছু হতে পারে? এই স্টেজই আমার পুণ্যতীর্থ। তুলসী চক্রবর্তীর ভক্তিমিশ্রিত কণ্ঠস্বর উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, তা বলাই বাহুল্য।

আসলে তুলসী চক্রবর্তীর মতো অিভনেতার গুণের কদর করার মতো গুণী লোক সেকাল–একাল কোনো কালেই ছিল না। আমরা ‘সাড়ে ৭৪’ দেখেছি, ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি; মনে আঁচড় কেটে গেছে বলে সিনেমাগুলোকে মনে রেখেছি, কিন্তু কতজন মনে রেখেছি তুলসী চক্রবর্তীর মতন তাবড় অভিনেতাকে? বাঙালি মানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, বাঙালি মানেই উত্তমকুমার! কিন্তু হায়! সেই বাঙালি বেমালুম ভুলে গেছে ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তীর মতো শিল্পীদের! কতজন মনে রেখেছেন তুলসী চক্রবর্তীর মতন অভিনেতাদের। যাঁরা প্রাণপাত করে, নিরলস পরিশ্রম আর অসম্ভব নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন প্রতিটি চরিত্রকে?
সত্যজিৎ রায় যখন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ পড়ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে চরিত্রগুলোকে জীবন্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন চোখ বুজে তুলসী চক্রবর্তীকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হিসেবে। যাঁরা প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের চরিত্র নিয়ে অবগত, তাঁরা পর্দায় তুলসী চক্রবর্তীকে প্রসন্ন গুরুমশাই ভেবে নিতে একদমই হোঁচট খাননি। উল্টো তাঁকেই তাঁরা প্রসন্ন গুরুমশাই হিসেবে পুরোপুরিভাবে এঁকে নিয়েছিলেন তাঁদের মনে। এমনই ছিল তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়। তিনি এমনই দক্ষ অভিনেতা ছিলেন যে তাঁকে ছবি বিশ্বাস বেশ সমঝে চলতেন। সেই ছবি বিশ্বাস, যিনি কিনা কোনো দিনও শুটিং করার সময় স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতেন না, শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন এবং তারপরই দুর্ধর্ষ অ্যাকশন! কিন্তু সহ-অভিনেতা যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন, সে দিন তাঁকে কোমর বেঁধে নামতে হতো। তাঁর কথা অনুযায়ী তিনি বলতেন, ‘কী জানি কী প্যাঁচ তুলসী কষবে! ’ ছবি বিশ্বাস খুব ভালো করে জানতেন যে সহ-অভিনেতা যখন তুলসী চক্রবর্তী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে বাজি রেখে, টক্কর দেওয়ার মতো।

তুলসী চক্রবর্তীর মতো শিল্পীকে কীভাবে দিনের পর দিন চরম অবহেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তার উদাহরণ আমরা পাই বিভু ভট্টাচার্যের এক স্মৃতিচারণা থেকে। সেখানে বিভু ভট্টাচার্য বলেছেন, একদিন শুটিং চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া শুটিং ফ্লোরে। তুলসী চক্রবর্তী তখন বিভু ভট্টাচার্যকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে কি গাড়ি দেওয়া হয়েছে বাড়ি যাওয়ার জন্য? ’

সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর ছবির পোস্টার
সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর ছবির পোস্টার

বিভু ভট্টাচার্য উত্তরে হ্যাঁ বলেন। তারপর তুলসী চক্রবর্তী সারা দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকেন সেখানে, যাতে তাঁর বাড়িতে ফেরত যাওয়ার টাকা যদি বেঁচে যায়, তবে তাঁর পরিবারের জন্য খুব উপকার হবে। মানুষটি প্রাপ্য সম্মান পাওয়া তো দূর, প্রাপ্য পারিশ্রমিকটুকুও পেতেন না। তাঁর তুলনায় তাঁর থেকে ছোট মাপের শিল্পী সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা পেতেন এবং পারিশ্রমিকও পেতেন কয়েক শ গুণ বেশি। বিভু ভট্টাচার্যকে সেই সময় দিন প্রতি ৭৫ টাকা করে দেওয়া হতো আর তুলসী চক্রবর্তীকে দেওয়া হতো মাত্র ১৫ টাকা আর বাড়তি সুযোগ–সুবিধা তো দূরের কথা।
এই পারিশ্রমিক নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়ে যখন সত্যজিৎ রায় ‘পরশপাথর’–এর মুখ্য চরিত্রটির প্রস্তাব রাখেন তুলসী চক্রবর্তীর কাছে, তখন নিষ্পাপ শিশু হৃদয় খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো দেখো. . . এত দিনে আমি জাতে উঠলাম। ’ তাঁর এই বাক্যের পেছনে না জানি কতটা ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট আর না পাওয়ার অভিমান জমে ছিল, কে জানে!
তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে তাঁর বিষয়ে বলতে গিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমার বলতেন, ‘তুলসীদার মতো অভিনয় তো কোনো দিনই করতে পারব না, ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। ওনাকে প্রণাম জানানোর মতো একটাই পথ আছে—পরিচালক, প্রযোজকদের বলে যখনই কাজ পাই, তুলসীদাকে ডেকে নিই। উনি থাকলে সিনটা দারুণভাবে উঠে যায়। ওনার ঋণ তো কোনো দিন শোধ করতে পারব না, যেভাবে যেটুকু পারি সাহায্য করি। ’ তুলসী চক্রবর্তী বলতেন, তিনি হলেন হেঁশেলবাড়ির হলুদ, যেখানে–সেখানে কাজে লেগে যায়।

একবার এক সিনেমার শুটিংয়ে অনাহুতের মতো হাজির হয়ে বৈষ্ণব সাজার অনুমতি পেয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। বৈষ্ণব সেজে শ্রীখোল হাতে পরিচালকের সামনে যেতেই পরিচালক তাঁকে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তুলসী চক্রবর্তী শট দিলেন, খোল বাজাচ্ছেন, মুখে হরিনাম, চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। পরিচালক এত খুশি হলেন যে দেড় মিনিটের শট তিনি চার মিনিট নিলেন এবং সিনেমায়ও রাখলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বড় দলের অভিনেতা তিনি। আরেকবার এক মুদির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তুলসী চক্রবর্তীকে নেওয়া হলে তাঁকে ডাকতে লোক যায় এবং ট্যাক্সি ভাড়াও দেওয়া হয়। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বক্তব্য, তিনি ট্রামে-বাসে যাতায়াত করেন। পরের দিন এক বেলা কাজ করে যখন উত্তমকুমারের কথামতো তাঁকে তিন শ টাকা দেওয়া হয়, তখনো তিনি তা নিতে অস্বীকার করেন। কারণ, তখন তার রেট ছিল দৈনিক ১২৫ টাকা।

১৯৫৩ সালের কথা, মুক্তি পেল নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে ৭৪’। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল, ছবিটির মাধ্যমে এক নতুন জুটি এসেছে পর্দায়। বয়স্করা মজে ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাঁদের দাবি, নায়ক-নায়িকা তো তুলসী-মলিনা। নতুন জুটি উত্তম-সুচিত্রা তো আসলে সাইড রোলে! টানা আট সপ্তাহ বক্স অফিসে চলল এই ছবি। তাঁর কণ্ঠে ‘কই, কোথায় গেলে গো? ’ সংলাপ ছড়িয়ে পড়েছিল সবার মুখে মুখে। প্রথাগত স্বীকৃতি হয়তো পাননি কিন্তু তাঁর অভিনয়ক্ষমতায় স্বল্প পরিসরে উপস্থিতিতেও দর্শকমন জয় করেছেন।
অভিনয়জীবনে তিনি সব থেকে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’-এ অভিনয় করে। দরজি তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছেন নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য, তিনি আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘উফ! এ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি! ’ সারা জীবনে ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টি মত হিন্দি সিনেমা করলেও দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী উষা রানী দেবী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন সাহায্যের আশায়। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সব কটি মেডেল বিক্রি করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। অভিনয়জীবনে অধিকাংশ কমেডিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করলেও বাঙালি দর্শকের অন্তরে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী।

তথ্যসূত্র:
১. Bengali Cinema: ‘An Other Nation' (Routledge Contemporary South Asia Series), Sharmistha Gooptu, Routledge (২০১০)।
২. Bengali Cinema, Sharmistha Gooptu, Lotus (২০১০)।
৩. বর্তমান পত্রিকা, ৩১ আগস্ট ২০১৯ সাল।)