এরনেস্তো কার্দেনালের কবিতা

>নিকারাগুয়ার বিপ্লবী, যাজক ও কবি এরনেস্তো কার্দেনাল মারা গেছেন ১ মার্চ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা

মেরিলিন মনরোর জন্য প্রার্থনা 
প্রভু,
গ্রহণ করো এই মেয়েটিকে, সারা দুনিয়া যাকে
মেরিলিন মনরো বলে ডাকে
যা ওর আসল নাম নয়
(কিন্তু তুমি জানো ওর আসল নাম, এতিম যে কিশোরীটি
ধর্ষিত হয়েছিল নয়-এ,
যে দোকানি মেয়ে নিজেকে খুন করতে চেয়েছিল
কেবল ষোলোয়)

সে এখন তোমার দরবারে যাচ্ছে প্রসাধনহীন
তথ্যসচিব বাদে
ওর কোনো ছবি বা সম্মতি-স্বাক্ষর ছাড়াই
মহাশূন্যের অন্ধকারের সামনে নভোচারীর মতো একা।
শৈশবে সে স্বপ্ন দেখেছিল গির্জার ভেতরে সে নগ্ন
(টাইম-এর ভাষ্য মোতাবেক)
দাঁড়িয়ে আছে—মাটিতে আনত—ন্যুব্জ জনতার সামনে,
আর ওই মাথাগুলো
বাঁচাতে ওকে হেঁটে যেতে হয়েছে আলতো পায়ে।
আমাদের স্বপ্নগুলো তুমি বোঝো মনোবিদের চেয়েও ভালো।
গির্জা, বাড়ি বা গুহা বোঝায় জরায়ুর আশ্রয়
কিন্তু তার চেয়ে আরও বেশি...
মাথাগুলো ভক্তদের, এ তো পরিষ্কার (পর্দায় ঠিকরানো
আলোকছটার নিচের অন্ধকারে মাথার ঝাঁক।
কিন্তু গির্জা তো টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের স্টুডিও নয়।
গির্জা—সোনার আর মর্মরের—ওর দেহমন্দির
যেখানে ঈশ্বরপুত্র চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে থেকে
তাড়িয়ে বেড়ান টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের অর্থকর্মীদের
তোমার উপাসনালয়কে যারা বানিয়েছে চোরের আস্তানা।  

প্রভু,
তেজস্ক্রিয়তা আর পাপে সয়লাব এই দুনিয়ায়
তুমি নিশ্চয়ই কোনো দোকানি মেয়েকে দুষবে না
(অন্য দোকানি মেয়েদের মতোই) যে তারকা হওয়ার
স্বপ্ন দেখেছিল।
আর ওর স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল ‘বাস্তবতা’ (টেকনিকালার বাস্তবতা)।
ও তো অনুসরণ করে গেছে ওর হাতে গুঁজে দেওয়া
আমাদেরই চিত্রনাট্য,
যা আসলে আমাদেরই জীবন, কিন্তু অর্থহীন,
ওকে ক্ষমা করো, প্রভু, ক্ষমা করো আমাদের সবাইকে
কারণ আমাদের এই টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি
আর ম্যামথ সুপার-প্রোডাকশন তো মিলেমিশে
গড়ে তুলেছি আমরাই। 

ও ছিল ভালোবাসার জন্য কাতর আর আমরা ওকে দিয়েছি
ঘুমের বড়ি।
আমরা সাধু না হওয়ার দুঃখে তারা সুপারিশ করেছে
মনোবিকলন।
ভেবে দ্যাখো, প্রভু, ক্যামেরা নিয়ে ওর বেড়ে ওঠা ভয়
আর প্রসাধনের প্রতি অরুচি (আবার প্রতিটি দৃশ্যের আগে
নতুন প্রসাধনের জন্য ওর ব্যাকুলতা) আর কীভাবে
বেড়ে উঠল ভয়
আর কীভাবে বেড়ে উঠল স্টুডিওতে ওর
সময়ানুবর্তিতার অভাব! 

অন্য যেকোনো দোকানি মেয়ের মতোই
ও দেখেছিল তারকা হওয়ার স্বপ্ন।
আর ওর জীবন ছিল স্বপ্নের মতো অবাস্তব, যা ব্যাখ্যা করে
মনোবিদেরা ফাইলে গেঁথে রাখেন।

ওর রোমান্স ছিল নিমীলিত চোখের চুমু
যা চোখ খোলার পর
দেখা যেত স্পটলাইটের তলায় কেবল এক অভিনয়দৃশ্য আর নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে স্পটলাইট
আর ঘরের দুই দেয়াল (আসলে ছিল সেট)
নেওয়া হয়েছে খুলে
পরিচালক তখন নোটবই হাতে অপসৃত, দৃশ্যগুলো
নিরাপদে কৌটাবদ্ধ।
কিংবা যেন ইয়াটে ভ্রমণ, সিঙ্গাপুরে চুমু, রিওতে নাচ,
সস্তা অ্যাপার্টমেন্টের বিষণ্ন চটকে দেখা উইন্ডসরের
ডিউক ও ডাচেসের প্রাসাদে অভ্যর্থনা। 

শেষ চুমু ছাড়াই সমাপ্ত হলো সিনেমা
ওকে তারা পেল বিছানায় মৃত, ফোনে হাত।
আর গোয়েন্দারা জানতেই পারেনি ও ফোন করতে
চেয়েছিল কাকে,
যেন-বা বন্ধুসুলভ কণ্ঠটি শুনতে চেয়ে ফোন করে কেউ
শুনেছে শুধু ফিতে-বন্দী গলার ‘রং নাম্বার’;
কিংবা যেন গুন্ডাদের হাতে আহত কেউ
খুঁজে পেয়েছে সংযোগছিন্ন ফোন।
প্রভু, যাকে
ও ফোন করতে চেয়েছিল কিন্তু করেনি
সে যে-ই হোক (হয়তো কেউই ছিল না
বা লস এঞ্জেলেসের ফোনবুকে তার নামই নেই)
প্রভু, ফোনটা তুমিই তুলে নিও।

নিকারাগুয়া হ্রদে

ধীর মালবাহী লঞ্চ, মধ্যরাত, হ্রদের মাঝার,
সান মিগেলিতো থেকে যাত্রা তার গ্রানাদার পথে।
এখনো সামনের আলো চোখেই পড়ে না,
পেছনের ম্লান আলো মিলেমিশে পুরো একাকার।
আছে শুধু তারা
(মাস্তুল আঙুল যেন সপ্তর্ষির দিকে তাক করা)
আর চাঁদ, চন্তালেসের শীর্ষে জেগে। 

আরেকটি লঞ্চ যায় (লাল আলো একা)
আর আঁধারে হারায়।
আমরা, তাদের জন্য:
আঁধারে হারিয়ে যাওয়া আরেকটি মৃদু লাল আলো।...
আর আমি, রাশি রাশি কলা আর চন্তালেস-পনিরের মাঝে,
ডেকে শুয়ে, তারা দেখে দেখে,
ভাবি: আমাদেরই মতো হয়তো পৃথিবী আছে আর—
অন্য লঞ্চ, অন্য রাত, অন্য হ্রদ থেকে
(তারা দেখে দেখে) কেউ চোখ রাখে আমার ওপর।