যে অনুবাদ অহংকার তৈরি করে

এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রায় চার হাজার নতুন বই এসেছিল বলে শুনেছি। এসবই মননশীলতার এক সম্মিলিত প্রকাশ। এর মধ্যে আলোচ্য বইটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গৌরবের বলে মনে করি।

২১ ফেব্রুয়ারি আমরা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও উদ্​যাপন করছি। বাংলাদেশে প্রায় সাত–আট লাখ মানুষের মাতৃভাষা উর্দু। সংখ্যার হিসাবে সামান্যই। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার আন্দোলন হয়েছিল একধরনের ভাষাভিত্তিক আধিপত্যবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে, কোনো বিশেষ ভাষার বিরুদ্ধে নয়। তারপরও উর্দু নিয়ে স্পর্শকাতরতা আছে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। কিন্তু বাংলাদেশ আজ অনায়াসে তার উর্দু কবিদের অনুবাদ প্রকাশ করছে বাংলায়। এটা একটা সাংস্কৃতিক অগ্রগতির স্মারক। সব ভাষার এ রকম বর্ণিল উদ্​যাপনই ছিল একুশের চেতনার লক্ষ্য।

বহুত্ববাদের পথে বাংলাদেশ যে একদম এগোল, ক্ষুদ্র আয়তনের এই বই তার বৃহৎ আলোকরেখা। কেবল অনুবাদক জাভেদ হুসেন বা প্রকাশক প্রথমাই নয়, বাংলা একাডেমিও এই উদ্​যাপনের হিস্যা দাবি করতে পারে। এ পথেই একদিন আমরা সান্তাল, তেলেগু, চাকমা, মারমা, মণিপুরিসহ সব স্থানীয় সাহিত্যের অনুবাদ দেখতে পাব। এ রকম সাহিত্য বাংলা একাডেমিসহ অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেরও আনুকূল্য পাবে বলে আশা করছি। এভাবেই কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্​যাপন ক্রমাগত অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।

স্বাধীন বাংলাদেশে উর্দু কবিদের অনুবাদগ্রন্থ বিরল। এর আগে নওশাদ নূরীর কবিতা অনূদিত হয়েছিল। তিনি বেঁচে নেই। আহমদ ইলিয়াস এখনো জীবিত। বাংলাদেশ তাঁকে নিয়ে অহংকার করতে পারে। বাংলাদেশে কম আলোচিত হলেও উপমহাদেশের অন্যান্য উর্দুভাষী জনপদে তিনি সুপরিচিত। একদা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর কবিতা কেবল কাব্যগুণেই নয়, সামাজিক অভিজ্ঞতার কাব্যিক নির্যাস হিসেবেও অনন্য সম্পদ হওয়ার দাবিদার।

কবি আহমদ ইলিয়াস দেশভাগ দেখেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এ অঞ্চলের ইতিহাসের প্রধান এ দুই ঘটনার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় কবিতা লেখা থামাননি তিনি। এই গ্রন্থে তার কাব্যিক ছাপ রয়েছে।

উপমহাদেশের সাহিত্যে ‘পার্টিশন সাহিত্য’ বলে একটা পৃথক শাখাই রয়েছে বর্তমানে। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের জন্য বহুকাল যাবৎ ‘দেশভাগ’ প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে আছে। এই তিন দেশের কবি ও কথাসাহিত্যিকেরা বিপুল লিখেছেন ‘পার্টিশন’ নিয়ে।

দেশভাগের মধ্যেই আহমদ ইলিয়াস বিহার থেকে এসে কলকাতা হয়ে থিতু হয়েছিলেন বাংলাদেশে। পুরোনো পরিচয় ফেলে এসে নতুন পরিচয় নির্মাণের প্রয়াস ছিল সেই অধ্যায়ে। তবে তাঁর মতো উর্দুভাষীদের জন্য আরেক কঠিন অভিজ্ঞতা ছিল পরবর্তী অধ্যায়। ১৯৪৭–পরবর্তী বাংলাদেশ প্রগতিশীল সাহিত্য ও সমাজ রূপান্তরের আন্দোলনে শরিক থাকার পরও রাজনীতির সূত্রে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আহমদ ইলিয়াসের মতো মননশীলদের। তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য ওই সময় ‘নাগরিক’ থেকে ‘বেনাগরিক’ হয়ে পড়ার কাল। আবার ক্রমে নাগরিকত্ব পেয়েছেন তাঁরা। অর্থাৎ একই জীবনে একাধিকবার নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলা এবং ফিরে পাওয়ার টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যে জীবন যাপন করে এসেছেন তিনি, সেটা অবশ্যই স্বাভাবিক জীবন ছিল না। 

ফলে আহমদ ইলিয়াসের কবিতায় এসেছে দেশভাগের অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবনযাপনের ছাপ। একই কবির লেখায় ইতিহাসের এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কাব্যিক বিবরণ বিরল ঘটনা এবং সে কারণেই তা অসাধারণ।

একটি শক্তিশালী ভাষার প্রতিনিধি হয়েও আহমদ ইলিয়াস দেখেছেন তাঁর সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেই ভাষার বিলীয়মানতা। জীবদ্দশায় তিনি বেদনার সঙ্গে জেনে যাচ্ছেন, তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে উর্দু কবিতার চর্চা হারিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে এ রকম কবিতার জন্য কোনো কাগজ নেই, শ্রোতা নেই, আবৃত্তিও নেই। যেকোনো ভাষার একজন সক্রিয় কবির জন্য এটা বেদনাময় অভিজ্ঞতা। জীবিত অবস্থায় জবানসুদ্ধ অচেনা হয়ে পড়ার এক বিশাল মনোজাগতিক ভার থাকে, যা এক জটিল অন্তর্গত টানাপোড়েন তৈরি করে। সেটাই আহমদ ইলিয়াসের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য।

তবে বিপুল সামাজিক অভিজ্ঞতার ফল হলেও ইলিয়াসের কবিতা কখনোই সমাজবিজ্ঞান হয়ে ওঠে না, সেটা কবিতা হওয়ার পথেই থাকে বরাবর।

এসব কবিতা মান্টোর ছোটগল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা উপমহাদেশের দেশভাগের সাহিত্যের আরেক অমূল্য সম্পদ। ব্যক্তিসত্তা বারবার বিভাজনের শিকার হলেও ইলিয়াসের কবিতা বিষণ্ন এক ঐকতানের সুর ছড়ায়। জাভেদ হুসেন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন অনুবাদে সেই সুর বাঁচিয়ে রাখতে। এক জায়গায় কবি লিখছেন— 

‘আমার পথ হারানোর ইতিহাসও 

কেউ লিখত যদি

অক্ষরে অক্ষরে ছিন্ন হয়ে 

আমি ছড়িয়ে আছি পথে!’

হ্যাঁ, কবি নিজেই লিখেছেন তাঁর নিয়তিকে। মহৎ কবিতায় কবিরা তা–ই করেন।