মন পড়শি

আজিকে খ্যাপ আছে রে বৌ।

খ্যাপের কথা শুনে ছটুর চোখ সরু হয়ে আসে। প্রায় সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলে, কোতায় খ্যাপ?
যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে গাউস বলে, খ্যাপ আর কোতায় হবি? গানবাজনার এহন কি আর দিন আছে? সবাই তো মোবাইল–টোবাইল নিয়ে ঘোরে। ওর মধ্যিই সব গানটান শোনে। এহন কি আর সেই দিন আছে? ধান-পান, নবান্ন-টবান্নের কোনো বালাই নেই গাঁও-গিরামে। পালা-টালা করতিও ডাহে না কেউ। ধান উঠলি তার দাম ওটে না, সেই দুঃখিতেই কিষাণ মরে, সে গান শোনবে কহন?
এত কতা তোমার কাছে কে শুনতি চাইছে? তোমার খ্যাপটা কোতায় তাই কও।
তুই তো জানিস বৌ, খ্যাপটা কোতায়!
কথা শেষ করার আগেই বঁটি নিয়ে তেড়ে আসে ছুটু। ওরে ভাদাইমে, রোজ রোজ খ্যাপের বায়না ধইরে ওই বানিশান্তায় নটি বাড়ি যাতি চাস? ফুর্তি করতি চাস? বউ তোর পুরানা হইয়ে গেইছে, আর মনে ধরে না?
ছুটুরে গাউস কথাটা কিছুতেই বুঝাতে পারে না। মন না মজলে যে শরীর টানে না তার!
তবে ওইখানে শিউলি বাঈর সাথে বেশ পড়ে। গপ্পগাছা হয় দুজনে। কিন্তু সেই ভাব রে তো দোস্তালি কওয়া যায়। শরীর নেই সেইখানে। আর বাকি বেটিরা! তার মতো গরিবরে দেহ দিতি তাগের বয়েই গেল!
এই মেয়ে মানুষটারে সে কতা সে কী করে বোঝায়! সে কী হাজারো দিন তারে এই কথা বলি নেই যে, মানষির শরীরে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিচরণ করা কতটা যাতনার! যে নিজে এর ভুক্তভোগী সে আরেকজনরে সেই কষ্ট কেন দেবে!
ছুটু জানে। তাও সে রেগে গেলি যা মনে আসে তাই বলবে। ছুটুরে সে রাগাতে চায় না। বানে ভাসা সহায় সম্বলহীন আত্মীয়-পরিজনহীন গাউসের জীবনে ছুটুই তো একমাত্র অবলম্বন। সে তো ভেসেই এসেছিল। সেই যে, সেইবার তুমুল ঘূর্ণিঝড় হলো। তাও তো প্রায় ২৭ বা ২৮ বছর আগের কথা। সেই ঝড়ে সে বাপ-মা, ভাইবোন সব হারাল। সে নিজেও ভেসে গিয়েছিল। সুন্দরবনের গা ঘেঁষে মিঠেখালি ছিল তার গ্রাম। এটুকুই মনে আছে। আর কিছু মনে করতে পারে না। তাকে নদীর তীর থেকে টেনে তুলেছিল বালির জাহাজের খালাসিরা। তখন তার বালক বয়স কত আর হবে, ছয় কি সাত। কিন্তু বালির জাহাজের খালসিরা তারে বেশি দিন রাখল না। তারে তুলে দিল খুলনা-মোংলা-ঢাকা রুটের একটা যাত্রীবাহী জাহাজে। বলল, ওইখানে অন্তত খেয়েপরে বাঁচতে পারবি। কাজ জুটাইয়ে নিতে পারবি।
কাজ তার জুটেছিল ঠিকই, খাওয়াও জুটেছিল। জাহাজের বাবুর্চির ফাইফরমাশ খাটত সে। আর রাতের বেলা জাহাজের খোলে ঢালাও বিছানায় এক কোনে শুয়ে পড়া। কিন্তু কোনো কোনো দিন অন্ধকারে খালাসিরা তার শরীর নিয়ে মেতে উঠত। গাউসের কাছে রাত আসতে লাগল বিভীষিকা হয়ে। ছোট্ট গাউস প্রাণপণ চেষ্টা করে যেত সেই তাণ্ডব থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সে জাহাজের খোলে শুয়ে–বসে যাওয়া যাত্রীদের আশেপাশে শুতে লাগল। তাও জাহাজ ছেড়ে যেতে তার মন কেমন করত। ওই যে ড্রেস পরা কেবিন বয়রা। গাউসের খুব ইচ্ছা করত, ও রকম কেবিন বয় হবে। একদিন সে বাবুর্চির প্রধান সহকারী ইরফানকে বলেছিলও সে কথা।
ইরফান বলল, আরে ব্যাটা, কেবিন বয় হতি হলি পেটে কিছু বিদ্যে থাহা লাগে। ল্যাহাপড়া জানিস কিছু? আবার ও শিখতি হলি তো এ জাহাজে থাহা চলবে না, তোর ডাঙ্গায় উঠতি হবে।
কিন্তু ডাঙ্গায় সে কার কাছে যাবে! আর এই জাহাজেই বা তার আপন কে আছে! রাত্রির হলেই তার খোঁজ পড়ে।
কোনো কোনো দিন যাত্রীদের পাশ থেকে পাকড়াও করে টেনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে ওই যন্ত্রণা কূপে।
এমনি একদিন তাকে খুঁজতে আসে ইরফান। ঘুমন্ত যাত্রীদের পাশে ঘুরে ঘুরে চাপা অথচ তীব্র স্বরে ডাকতে থাকে গাউস, গাউস এদিকে আয় দিনি! উস্তাদ তোরে ডাকতিসে!
গাউস কোনো সাড়া দেয় না। সে প্রাণপণে কাঁথাটা নিয়ে শুয়ে থাকা যাত্রীর প্রায় পেটের ভেতর সেধিয়ে যেতে থাকে।
ইরফানের হলো শকুনের চোখ, সে ঠিক গাউসের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। চল, ওঠ।
গাউস আরও শক্ত হয়ে যাত্রীর পেটের ভেতর সেধোতে থাকে। মনে মনে ভাবে, হায় আর একবার যদি মাতৃগব্বে ঢুকে যাওয়া যেত! এ রকম একটা পৃথিবী তার সহ্য করতে হতো না!
গাউসের অবস্থা দেখে শুয়ে থাকা যাত্রী এবার প্রায় হুংকার করে ওঠে। কিরে ব্যাটা? এরে কোতায় নিয়ে যাতি চাচ্ছ তুমি?
আপনি কিডা? এ হলো জাহাজের স্টাফ। জাহাজের স্টাফ যাত্রীদের পাশে শোবে কেন?
কিন্তু রাত দুফুরি জাহাজের এতটুকু স্টাফেরইবা কাজ কী? আজ সে এখানে শুক কাল আইসো।
তারপরও ইরফান নাছোড়বান্দা সে গাউসকে নেয়ার জন্য ঠায় দাঁড়ায়ে থাকে।
যাত্রী তখন জানতে চায়, আচ্ছা কও তো, এরে তুমরা নিয়ে যেয়ে কী করবানে? জবাই করবা নাকি?
এসব কী কতা বলেন আপনি? খেকিয়ে ওঠে ইরফান।
আমি কী বলতিছি তা বুঝতি পারতিছ না? কাটা পাঠার মতো কাঁপতিছে ছেলেটা। ফের যদি আর ওরে একবার ডাকো, তালি আমি তোমাগের সবার খবর কইরে দেব এই রাত্তিরে!
ইরফান আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না। তবে গাউস আর পাচু বেদে নামক এই ফেরেস্তার মতো মানুষটার পিছু ছাড়ল না।
চাল-চুলোহীন, ঘর গেরস্তালিহীন পাচু বেদেও তাকে নিয়ে চলল তার ডেরায়।

বেদেদের এই ডেরা সে জাহাজে থাকতেও দেখেছে। ডেরা থেকে ভেসে আসত নানা রকম গান। গান তারে বড় টানে। তার বাবাও একতারা বাজয়ে গান গাইত। সন্ধ্যা হলে তাদের বাড়ির উঠোনে গানের আসর বসত। ঢোল বাদ্যি ক্যানেস্তারা কত কী বাজানো হতো, বাঘ তাড়ানোর জন্যি। সন্ধ্যা নামলি গ্রামটাই হয়ে উঠত বাদ্যি–বাজনার। কিন্তু গ্রামি সে কার কাছে যাবে! গেছিল তো একবার! বাপ-মা কেউ নেই সেখানে। সব নাকি ঝড়ে উইড়ে গেইছে! নদীর পাড়ের ওই ডেরাটারে তার কেন যে এত আপন মনে হতো? সেদিন নিয়তি তারে সেখানে নিয়েই ফেলেছিল।
তবে সাপে তার ছিল ভয়। সাপের কথা ভাবলেই তার পেটের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে অনুভূতি হতো। সেই সাপ নিয়ে কারবার করা মানুষগুলোর সাথে থাকতে হবে এখন তারে! পাচুকে সে ভয়ে ভয়ে সুধালোও একসময়। তোমাগের সাপগুলো কুথায় থাকে উস্তাদ?
এ কথা শুনে গাঁজায় বুঁদ হয়ে থাকা পাচু বেদে ক্ষণক্ষণে গলায় বলে, সাপ কুতায় পাব রে বাপ? ও কি আর আছে নাকি? আদি পেশা ছিল। কবে বরবাদ হইয়ে গেইছে। এরপরে লোনাপানিতে মাছ ধইরে, কাঁকড়া ধইরে কাটত কিছুকাল, সেও এহন হাতছাড়া। জিনিসপত্তরের যে দাম! ও দিয়ে কি আর পেট চালানো যায়! এহন হাতের সামনে যে যা পায় তা–ই করে খায়। বেশির ভাগ তো খটিতি কাজ করে। তোরেও সেইখানে পাঠাই দেবানে। খেইয়ে পইরে বাঁচতি তো হবে তোর!

পাচু বেদের সুপারিশে তার কাজ জুটেছিল মাছের খটিতে। চিংড়ির মাথা খোলার কাজ। দলে দলে মহিলারা আর বেদে পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা যারা স্কুলে যায় না, তারাও করে এই কাজ। গোনের সময় খুলনা-মোংলা মহাসড়কের দুইধারে বসে মাছের কেনা বেচার মহড়া। ইন্ডাস্ট্রির লোক আসে মাছ কিনতে, লোকাল ফড়িয়া আসে। সে এক মহা যজ্ঞ যেন। খটিগুলোতে ধুমছে চলে মাথা খোলার কাজ। দুহাতে দুটো পলিথিনের ব্যাগ পেঁচিয়ে নিয়ে চলে বাগদা চিংড়ির মাথা খোলা। তারপরও চিংড়ির কাঁটার খোচায় ক্ষতবিক্ষত হয় হাত। তখন আবার কাজ বাদ দিতে হয়। আর সব সময় তো এ কাজ থাকেও না। শুধু গুনে গুনে মাসে দুবার হপ্তা দুয়েকের কাজ। ওইভাবে হয়তো তার দিন কেটে যেতে পারত। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ের মতো তার জীবনে এসে গেল ছুটু।

গাউসের তখন জোয়ান বয়স। মাঝে মাঝে খটির কাজ আর বেশি সময় পাচু বেদের সাথে গানের দলে কাটে তার। একদিন দুপুরবেলা গ্রামের মেজকত্তার জংলাজমির ওপর দিয়ে তড়িঘড়ি খটির দিকে যাচ্ছিল সে। সরু পথ দুপাশে ঘন বাগান। বড় বড় সব গাছ। রেনট্রি, সফেদা, আমঝুম, ক্যাবরা, খইফল, বুনো জাম, বুনো গাব, তেতুল আর বড় বড় পাতায় আকাশ ঢেকে দেওয়া কাঠবাদামগাছে দিনের বেলায়ও অন্ধকার থাকে জায়গাটা। নানা বুনো পাখির খাকখোক, সরসর শব্দও লেগে থাকে। এরই মধ্যে মড় মড় করে একটা ডাল ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনে চমকালো গাউস। ডাল ভাঙল কেন? তবে কি কেউ বুনো পাখি শিকার করে নিচ্ছে? হাতে কি রাউফেল আছে লোকগুলোর? এয়ারগান না কী যেন কয় বন্দুকটারে? থাকলি থাকপে! এ রকম কাউরে পালি সে আচ্ছামতো পেদানি দেবে। এগের খাওয়ার নোলা শেষ হয়ে না, এত খায়, এত খায় তারপর বুনো পাখপাখালিও খাতি মন চায়!
সে বাগানের ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। দু–একটা গাছে ইতিউতি তাকাতেই দেখে একটা বড় আমগাছের বেশ ওপরের দিকের একটা ডাল ধরে দাঁড়ায়ে আছে ছুটু।
ঘরামি এরফান চাচার ছোট মেয়ে সে। ওর বাবা ঘর বান্ধার মিস্ত্রি। আসা যাওয়ার পথে কতই তো এই মেয়ের সাথে তার দেখা হয়েছে। সেই মেয়েই তো! হলুদ ডুরে শাড়ি, এই আবছা আলোতেও চকচক করতিছে। কিন্তু ছুটু একটা দড়ি নিয়ে ওই গাছের ডালে কী করতিছে! গাউসের শিরদাঁড়া বেয়ে নিমেষে যেন হাজারটা লালপিপড়ে নেমে যায়। তবে কি ও মেয়ে গলায় ফাঁস নেয়ার চেষ্টা করতিছে নাকি!]]]]
গাউস দ্রুত গাছে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। যেন সে গাছে উঠে পড়ার আগেই ছুটু দড়িতে ঝুলে পড়তে না পারে!

সেই যে ছুটুরে সে বাঁচাল, সেই থেকে ছুটু তার হলো। গ্রামের মিস্ত্রির মেয়ের তার মতো চাল-চুলোহীন লোকের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা না, তাও কেন জানি হলো।
ছুটু কেন গলায় দড়ি দিতে গেছিল গাউস কখনো জানতে চায় নাই। মানুষের কত রকম নিজস্ব বেদনা থাকে। তারও কি নাই! তা নিয়ে আর খোঁচায়ে লাভ কী?
কিন্তু গ্রামের মানুষ কি আর ছাড়ে! তারা ফিসফাঁস না না কথা কয়। কেউ কেউ ইশারা ইঙ্গিতে কেউ সরাসরি বলতে চায়, ছুটুর নাকি হ্যামেল বাধিল! নাগর পালালি, সেই পেট খালাস করতি না পাইরেই গাছে ঝুলে পড়তি গেছিল। তুমার তিন কূলে কেউ নেই, তাই তুমার গলায় ঝোলাল আরকি!
গাউসের ওসব কথা বিশ্বাস হয় নাই। বলতে গেলে সে ওসব কথা গায়ে মাখে নাই কখনো। ছুটুর অতীতে যা–ই থাক, গাউসের তাতে কিছু যায় আসে না। ছুটু যেন তার কাছে বনদেবী। কানে বেগুনি কলকে ফুল গুঁজে দিয়ে, ডুরে শাড়ি পরা ছুটুরে আগে সে যখন ছুটে বেড়াতে দেখত, তখন তার কালো মুখখানাতে যেন রূপের জেল্লা ঠিকরে পড়ত। এখনো কি পড়ে না! ছুটু তার কাছে সেই একই রকম সুন্দর। তার ডাগর চোখ যেন পশুর নদী। সেই নদীতে আবার মানুষের মনগড়া পাপ জমে থাকে কী কইরে!
কিন্তু ছুটু? এত দিনের সংসার, দুই–তিনটে ছেলেপেলে বিইয়েও কি তারে এক দিনের তরেও বিশ্বাস করতি পারিছে? যদি পারত, তবে কতায় কতায় দা-বঁটি নিয়ে এমন তেড়ে আসা কেন? নাকি ছুটুর কোনো এককালের ভালোবাসার মানুষ তারে ফাঁকি দিয়ে চইলে গেছিল বলে সে আর কাউরে বিশ্বাস করতি পারে না!