লেখক হওয়ার পাঠ

>
সাদাত হোসাইন
সাদাত হোসাইন

সাদাত হোসাইন, পুরোদস্তুর লেখক হওয়ার আগে তিনি কিছুদিন আলোকচিত্রীর কাজ করেছেন। ‘গল্পছবি’ নামে একটি আলোকচিত্রের বই প্রকাশ করেন, ২০১৩ সালে। প্রশংসিত হওয়ার পর লেখালেখিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে। মাঝখানে সংবাদকর্মী হিসেবে পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘জানালার ওপাশে’ বইটি। আর ‘আরশিনগর’ (২০১৫) বের হওয়ার পর পাঠকের নজর কাড়েন। 

লেখালেখির পাশাপাশি সাদাত হোসাইনের চলচ্চিত্র নির্মাণেও আগ্রহ আছে। তাঁর পরিচালনায় তৈরি হয়েছে ‘গহীনের গান’ সংগীতনির্ভর চলচ্চিত্র।
এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার সুবৃহৎ উপন্যাস ‘অর্ধবৃত্ত’। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: রাসেল রায়হান

(প্রথম অংশ)
প্রশ্ন: আপনি এ সময়ের জনপ্রিয় লেখকদের একজন, খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা এসেছে?
সাদাত হোসাইন: এ বিষয়ে আমার উত্তর, চেতনে-অবচেতনে সব সৃজনশীল মানুষই মূলত চায় তার সৃষ্টি বহুসংখ্যক মানুষ কর্তৃক গৃহীত হোক, সমাদৃত হোক, জনপ্রিয় হোক। অর্থাৎ আমরা সবাই-ই মূলত জনপ্রিয় হতে চাই। জনপ্রিয় হতে চাই এই অর্থে যে আমরা চাই আমাদের সৃষ্টিশীল কনটেন্ট, যা নির্মাণ করছি সেটি ফিল্ম হোক, ফটোগ্রাফি হোক বা অন্য লেখালিখি হোক, তা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাক। মানুষ পড়ুক, মানুষ দেখুক, মানুষ এটা নিয়ে আলোচনা করুক, এটা আমরা সবাই চাই। আমি একটা কথা বলি, সিনেমা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনটা লাইন আছে—বিলো দ্য লাইন, অ্যাবভ দ্য লাইন এবং ইকুয়াল লাইন বা প্যারালাল লাইন।
এখানে আমাদের বেশির ভাগ সাহিত্যের কিংবা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আমি দুটো লাইন ফলো করতে দেখি। এক, অ্যাবভ দ্য লাইন। অ্যাবব দ্য লাইনের মানে হচ্ছে, যাঁরা আমাদের সাধারণ পাঠক, এই লাইনের কনটেন্ট তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। কারণ এ লাইনে তাঁরা যা লেখেন বা বানান, তা এত বেশি কঠিন, এত বেশি বিমূর্ত যে অডিয়েন্স সেটি আসলে ধরতেই পারেন না।
আরেকটা লাইন হচ্ছে বিলো দ্য লাইন। এটি হচ্ছে এতই মানহীন যে আমাদের পায়ের নিচ দিয়ে চলে যায়। মানে আমাদের রুচি ওই কাজ গ্রহণ করে না। ফলে এখানেও বিশাল একটি অডিয়েন্সকে তাঁরা যুক্ত করতে পারছেন না। আমার মতে সঠিক লাইনটি হচ্ছে প্যারালাল বা ইকুয়াল লাইন। এই লাইনের গল্প, উপন্যাস, ছবি আমাদের ভালোভাবেই স্পর্শ করতে পারে। এসব না অতি বিমূর্ত, না খটমটে, না একদম সস্তা। আর এটা যাঁরা ধরতে পারছেন, তাঁরাই জনপ্রিয় হন বলে আমার মনে হয়। তারপর এটাও বলব, আমি আদৌ জনপ্রিয় কি না! হলেও সেটি কতটুকু! আমি মনে করি, সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয়তা বলতে যা বোঝায়, আমি ঠিক তার কাছাকাছিও নেই। বাংলা সাহিত্যের রয়েছে বিরাট পাঠকগোষ্ঠী। তাই আমাকে আরও বহুদূর যেতে হবে। আমি পাঠকের ওই প্যারালাল লাইনটার সামান্য কিছুটা হয়তো আমি স্পর্শ করতে পেরেছি।

প্রশ্ন: আপনি অ্যাবভ দ্য লাইন যাকে বলছেন, তাকেই কি সিরিয়াস সাহিত্য বলা হয় না? তা-ই যদি হয়, আপনি নিজেকে কি ওই অ্যাবভ দ্য লাইনের সাহিত্যে দেখতে চান না কখনো?
সাদাত: আমি আসলে লেখার সময় অ্যাবভ দ্য লাইন, বিলো দ্য লাইন—এসব ভেবে লিখি না। সাহিত্য এভাবে টার্গেট করে বা পরিকল্পনামাফিক করা সম্ভব না বলে আমি মনে করি। ধরুন, আপনি একজন তুমুল জনপ্রিয় লেখক হতে চান বা ধরেন তথাকথিত ক্ল্যাসিক লেখক হতে চান বা ওই যে বলে না ‘কালজয়ী লেখক’ ও রকম কিছু হতে চান। এবং সেটা ভেবেই লেখালেখি শুরু করলেন, কিন্তু আদতে সেটা কি সেটা সম্ভব? এ রকম সম্ভব হলে সবাই কালজয়ী বা জনপ্রিয় লেখক বনে যেতেন। বিষয়টা আসলে নির্ভর করে ওই মানুষটার সহজাত ক্ষমতার ওপর। আমি নিজে যে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে লেখালেখি করতে এসেছি, অনেক ভাবনাচিন্তা করে বা পরিকল্পনা করে লেখালেখি করতে এসেছি, এমন না। আমি কখনো ভাবিওনি যে আমি জনপ্রিয় লেখক হব বা আমি ‘ধ্রুপদি’ লেখক হব, তা না। আমি আসলে তা-ই লিখতে চেয়েছি, যা লিখতে ভালো লেগেছে। যা লিখি তা একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠকে স্পর্শ করেছে। আমি জোর করে, আরোপিত কিছু লিখতে চাই না। আমি ভাবি না যে আমাকে অ্যাবভ দ্য লাইন বা বিলো দ্য লাইন যেতে হবে। আমি এটাও মনে করি না যে আমাকে আমার গল্পটা বলার জন্য এবং সেই গল্প দিয়ে কাউকে স্পর্শ করার জন্য আলাদা করে কোনো কিছু করতে হবে। আমি শুধু বুঝি আমার যে সহজাত ক্ষমতা, তা স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়ে অনুশীলন করে যেতে হবে। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত—পড়াশোনা, বোঝাপড়া। তবে মোদ্দা কথা এই, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি, স্বতঃস্ফূর্ততা! আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার গল্পটা বলে যেতে চাই।

প্রশ্ন: আপনি শুধু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনার গল্প বলে যেতে চান?
সাদাত: ঠিক তাই। আমি একটু পেছনে যাই। আমার জন্ম হচ্ছে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার কয়ারিয়া গ্রামে এবং আমি এসেছি খুবই মার্জিনাল একটা পরিবার থেকে। আমাদের চারপাশে বই পড়া বা চর্চা একেবারেই সেভাবে ছিল না বলা যায়। বরং ক্লাসের বাইরে বই পড়লে বন্ধুরা হাসাহাসি করত, বলত পণ্ডিত। ‘ক্লাসের বই পড়তে পারে না, আমার আউট বই পড়ে’, এ রকম বলত! যেহেতু স্কুলে রেজাল্ট খুবই খারাপ ছিল আমার। আমার মা ক্লাস নাইন-টেন পর্যন্ত পড়েছেন। মায়ের বই পড়ার একটা অভ্যাস ছিল। আমার নানা খুব বই পড়তেন, মামা খুব বই পড়তেন। মা তাই বই পড়ার অভ্যাসটা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে সেই পরিবেশ ছিল না। কেউ পড়াশোনার ধারেকাছেও যেত না। বাবা, চাচা, কাজিন কেউ না। কিন্তু আম্মা যখন এ বাড়িতে এসেও বই পড়তেন, আমার মনে আছে, আমরা যখন ছোট ছিলাম প্রথম খড়ি দিয়ে রান্না করছেন মাটির চুলায়, তখনো তাঁর হাতে গল্প-উপন্যাসের বই। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছেন। হয়তো ভাত-তরকারি পুড়ে যাচ্ছে। আমার দাদি তখন খুব খেপে যেতেন, বলতেন, ‘তুমি কি এহন জর্জ ব্যারিস্টার হইবা নাকি?’ এইটা নিয়ে আম্মার অনেক মন খারাপ হতো। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? আমাদের নিয়ে মায়ের অন্য রকম চিন্তা ছিল। আমার আম্মা খুব চাইতেন যে আমরা পড়াশোনা করি, চারপাশের সবার মতো যেন না হই। 

আমি নিজে গল্প শুনতে খুব পছন্দ করতাম। গল্প শোনার কিন্তু অনেক বিকল্প মাধ্যম আছে, একটা সিনেমা গল্প বলে, একটা ফটোগ্রাফি গল্প বলে। স্কাল্পচার বা ধরেন পেইন্টিং, গান কবিতা, উপন্যাস—সবই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে গল্প বলে। অর্থাৎ সৃজনশীল সব মাধ্যমের কাজ মূলত গল্প বলা। তো ছোটবেলায় আমার গল্প শোনার মাধ্যম ছিল আমার দাদি, নানি আর আমার মা। তাঁরা মুখে মুখে আমাকে গল্প বলতেন। আমাদের এলাকায় কোনো টেলিভিশন ছিল না। একদিন দেখা গেল হঠাৎ করে একটা টেলিভিশন এসে গেছে। তখন টেলিভিশনের মধ্য দিয়ে, বলি নাটক থেকেও গল্প শুনতে শুরু করলাম। নিয়মিত টেলিভিশন দেখা বারণ ছিল। তখন আম্মা গল্প বলতেন। গল্প বলার সময় যে ঘটনাটা ঘটত, সেটাকেই কল্পনা করার চেষ্টা করতাম। পরে আমি নিজেও ছোটদের গল্প বলা শুরু করি। তখন আবিষ্কার করলাম, মা-নানি-দাদির কাছে শোনা অনেক গল্প আমি ভুলে গেছি, কিন্তু গল্প তো আমাকে বলে যেতে হবে। তখন ভুলে যাওয়া গল্পগুলো আমি আবার আমার মতো করে তৈরি করে শোনাতে শুরু করলাম। গল্প বলার এই তাড়না থেকেই আমার মনে হয়, পরবর্তী সময়ে আমি লিখতে চেয়েছি, সিনেমা বানাতে চেয়েছি, ফটোগ্রাফি করতে চেয়েছি। আমি সম্ভাব্য সব মাধ্যমেই গল্প বলতে চেয়েছি।

প্রশ্ন: যত দূর জানি এখন আপনি দস্তুরমতো লেখক হলেও আপনার ওই গল্প বলার শুরু কিন্তু ফটোগ্রাফি দিয়ে। ব্যাপারটা কেমন না? আপনার প্রথম বইটা, ‘গল্পছবি’, সেটা মূলত একটা ছবির বই। আপনার তোলা আলোকচিত্র। সঙ্গে ১০-১২ লাইনের গল্প। সূচনা পর্বের আলোকচিত্রী সাদাত হোসেনের কথা শুনতে চাই।
সাদাত: আমি ছোটবেলায় গল্প পড়তে চাইতাম, কিন্তু পড়ার তেমন সুযোগ ছিল না। আমি এই তৃষ্ণা মেটাতে একটা অদ্ভুত জিনিস করতাম। আমার বাবা যখন আমার মায়ের জন্য শাড়ি আনতেন—আগের দিনে শাড়ি কিংবা লুঙ্গির ভেতর পত্রিকা থাকত—পত্রিকাগুলো আমি যত্ন করে সঞ্চয় করে রাখতাম, যাতে পত্রিকার লেখাগুলো আমি বারবার পড়তে পারি। যেহেতু ক্লাসের বইয়ের বাইরে পড়ার মতো তেমন কিছুই আমাদের ঘরে ছিল না। হঠাৎ আমি একদিন দেখলাম একটা পত্রিকার পাতার মধ্যে সম্ভবত রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের কচি-কাঁচার আসর নামে একটা পাতা, ইত্তেফাক-এ। সেই পাতার মধ্যে ছোট একটা কবিতা বা ছড়া ছাপা হয়েছে, লিখেছে চতুর্থ শ্রেণির একটা বাচ্চা ছেলে। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়তাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফরচুনেটলি বা আনফরচুনেটলি সেই ছেলেটার নাম সাদাত হোসাইন। জীবনের প্রথম নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ব্যাপারটা হলো ওই যে নিজের নাম দেখলাম, তাতে একটা দারুণ মন ভালো করা অনুভূতি হলো, আবার একই সঙ্গে মন খারাপ করা অনুভূতিও। কারণ ওই নামের পেছনের মানুষটা আমি না, অন্য একজন। তখন ভাবলাম, আমার বয়সী আমার নামের একটা ছেলের লেখা পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে! একটা জেদ চেপে গেল—আমার নামও আমি ছাপার অক্ষরে দেখতে চাই। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে এটা বাস্তব করা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ আমাদের সেই গ্রামে ইলেকট্রিসিটি নেই, কাঁচা রাস্তা, পোস্ট অফিস নেই, পত্রিকা আসে না—এ রকম একটা প্রায় বিচ্ছিন্ন জায়গায় বসে আপনি কীভাবে এই স্বপ্ন দেখবেন? আম্মার কড়া শাসনে আমরা দুই ভাই প্রতিদিন সকালে উঠানে পড়তে বসতাম। মায়ের হাতে একটা বেত থাকত। সব সময়ে পাঠ্য বইয়ে আমরা মলাট লাগিয়ে পড়তাম। পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতা বা সিমেন্টের বস্তার শক্ত কাগজ দিয়ে মলাট লাগানো হতো। এ রকম একদিন আম্মা যখন মলাট লাগাচ্ছিলেন, দেখলাম সুন্দর একটা ছবি ওই ক্যালেন্ডারের পাতার মলাটের ওপর। একটা আকাশের ছবি এবং সেখানে দুই লাইনের একটা কবিতা, লেখা জীবনানন্দ দাশের। আমরা তখন জীবনানন্দ দাশের নামও শুনিনি। তখন আমরা কবি বলতে জানতাম রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। এর বাইরে বলতে বলতাম জসীমউদ্‌দীনকে। তো আমি ছোটবেলায় কনফিউসড হয়ে যেতাম যে ‘পল্লিকবি’ আর ‘পল্লিবন্ধু’ একই মানুষ নাকি! হা হা হা। 

আমি সেদিন হঠাৎ আম্মাকে বললাম যে আমি কিন্তু এনার চেয়েও ভালো কবিতা লিখতে পারি। আম্মা তখন বললেন, ‘মানে কী?’ আমি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, আকাশ অনেক নীল, উড়ছে দেখ চিল—তখন আমি ছোট ক্লাস ফোরে পড়ি। তখন আমি ভাবলাম, বাহ আমি তো দুই লাইন লিখে ফেলেছি। এই দুই লাইন লিখে রাখি, না হলে পরে ভুলে যাব। কিন্তু লিখে রাখতে গিয়ে আমার তখন আচমকা মনে হলো যে আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার নাম ছাপার অক্ষরে দেখব, তো ছাপার অক্ষরে যদি আমি আমার নাম না দেখি, তখন পর্যন্ত আমি লিখব না। আমি আর লিখলাম না।

ভোরবেলা আমার মাথায় বুদ্ধি চলে এল। আমি গোপনে যে পত্রিকাগুলো জমিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো বের করলাম। বিভিন্ন খবর থেকে বিভিন্ন অক্ষর খুঁজে বের করলাম, যে অক্ষরগুলো আমার সেই দুই লাইনের কবিতায় আছে। ধরেন কোথাও আছে ‘আজ শুক্রবার’ সেখান থেকে ‘আ’ টা ব্লেড দিয়ে কেটে আলাদা করলাম, কোথাও হয়তো লেখা ‘কাল বৃষ্টি হবে’, সেখান থেকে ‘কা’ অক্ষরটা কাটলাম। এ রকম করে করে প্রতিটি অক্ষর আলাদা আলাদা করে কাটলাম। তারপর আমার নামের অক্ষরগুলোও বিভিন্ন খবরের ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে কেটে আলাদা করলাম। যেমন সা, দা, ত। তারপর হোসাইন। আমি দেখতাম, আম্মা আব্বাকে চিঠি লিখে চিঠির খাম বন্ধ করার জন্য ভাতকে আঠা হিসেবে ব্যবহার করতেন। আমি আঠা দিয়ে অক্ষরগুলোকে পাশাপাশি বসিয়ে গেলাম। দুই লাইনের কবিতা সেই প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের নামসহ দেখলাম। সে এক অ্যান আনবিলিভেবল ফিলিং কিংবা এক্সপেরিয়েন্স। আমি আমার মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম খুব এক্সাইটেড হয়ে। তবে মা খুব বিরক্ত হলেন।

আমাদের বাড়ির পাশে এক ভাই ছিলেন। উনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমি ওনাকেও এটা দেখালাম। হি ওয়াজ রিয়েলি এক্সাইটেড অ্যান্ড হি মোটিভেটেড মি। উনি আমাকে একটা লাল কালির কলম দিলেন। আমাদের সময় লাল কালির কলম ব্যবহার করাটা পারমিটেড ছিল না আমাদের জন্য। ওটা সাধারণত টিচাররা ব্যবহার করতেন। আমাদের সময় বইয়ের ছবি ছিল সাদা-কালো। সাদা-কালো ছবিতে জবা ফুল বা কোনো একটা ফুল লাল কালিটা ব্যবহার করার জন্য বা আমার ইমাজিশনটা কালার করার জন্য ওই লাল কালিটা দিয়ে হয়তো ফুলের মধ্যে কালার করে দিতাম। কিংবা কোনো গৃহবধূ কলসি কাঁখে নদী থেকে পানি নিয়ে ফিরছেন, তাঁর ঠোঁটে লাল কালি দিয়ে লিপস্টিক এঁকে দিতাম অথবা কপালে টিপ দিয়ে দিতাম। আপেলে লাল করে দিতাম। ওই কলমটা আমার নানান ইমাজিনেশন এক্সিকিউট করার সুযোগ দিত রিয়েলিটিতে। এবং লাল কলম দিয়ে লেখার নেশা থেকে আমি যখন কোনো গল্পের বই পড়তাম, প্রথম পৃষ্ঠা পড়ার পর ভাবতাম পরের পৃষ্ঠায় কী থাকতে পারে। আমি না পড়ে বাকি গল্পটুকু কলম দিয়ে পাশে লিখে রাখতাম। লিখে মিলাতাম যে আমার অনুমানের সঙ্গে গল্পের পরের পৃষ্ঠার অংশটুকু মিলেছে কি না? কিন্তু দেখতাম মেলেনি। এতে অবশ্য আমার একটা লাভ হতো, প্রতিবার আমার নিজের একটা গল্প তৈরি হয়ে যেত। অর্থাৎ গল্পের বাকি অংশ ভাবতে গিয়ে আমি মূলত ওই গল্পের বাকি অংশের জন্য একটা বিকল্প গল্প তৈরি করে ফেলেছি। আমি তখন ক্লাস সিক্স-সেভেন-এইট-নাইনে পড়ি, তখন এভাবেই আমার লেখালেখি শুরু। কিন্তু লেখালেখির বেলায় আমাদের স্কুলের টিচাররা উৎসাহ দিতেন না। বরং ডিমরালাইজ করতেন। ধরেন ক্রিকেট খেলছি, বলতেন, ‘তুই কি শচীন টেন্ডুলকার হবি? ইমরান খান হবি? যদি না হইতে পারস, তাহলে খেলাধুলা করে সময় নষ্ট করে লাভ কী? যা পড়তে যা, পড়লে কাজে লাগবে।’ টিচাররা আমার ওপর বিরক্ত ছিলেন। আমি খুবই খারাপ ফলাফল করতাম স্কুলে, ম্যাথে রেগুলার জিরো-টিরো পেতাম। আমি অঙ্ক একদমই বুঝি না। পরে সৌভাগ্যক্রমে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা সার্কেল তৈরি হলো, যারা তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে অভ্যস্ত। তারা প্রতি সপ্তাহে এক ধরনের পাঠচক্র করে। আমি ওদের পাঠচক্রে যোগ দিয়ে, ওদের কথা শুনতাম। আসলে ওরা কী লেখে, বুঝতে চাইতাম। ওদের ‘পোস্ট মডার্ন লেখা, এবস্ট্রাক্ট লিটারেচার’ আমি বুঝতাম না। আমার জন্য তা অ্যাবভ দ্য লাইন। তার পরও আমি একদিন ভাবলাম, আমি কি আমার লেখা তাদের দেখাব? আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখালাম। তারা খুব সিরিয়াসলি আমাকে ডিমোটিভেট করল, আসলে তোমার লেখালেখি...।

এই ডিমোটিভেশনটা আমি খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিলাম। আমার মনে হলো, লেখালেখি নিয়ে আমার সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই, আমি লেখালেখি করব না। সময় নষ্ট করব না। লেখালেখি বাদ। লেখালেখি ছেড়ে দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ৬ বছর এবং তারপর ২ বছর আমি একটা অক্ষরও আসলে লিখিনি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি একসময় লিখতাম। আমি পুরোপুরি লেখালেখি ছেড়ে দিলাম। তত দিনে আমি ফটোগ্রাফি শুরু করেছি। ফটোগ্রাফির সূত্রে আমার ছোট ছোট কিছু ছবির গল্প লেখা শুরু হয়। কথাসাহিত্যিক আবদুল্লাহ আল ইমরান, আলোকচিত্রী পিউ ভাই, কিংবদন্তি সিনেমাটোগ্রাফার, ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন, এঁরা তখন আমাকে লিখতে খুব উৎসাহ দিলেন: ‘তোমার ছবির গল্প লেখাটা তো দারুণ। তো এই ছবির গল্প লিখতে গিয়ে আমার মনে হলো, আচ্ছা আমি তো একটা সময় লিখতাম।
ছবি তোলা নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। একদিন একজনের ক্যামেরা নিয়ে একটা ছবি তুললাম। সেই ছবিটা ফ্লিকার নামে এক সাইটে জমা দিলাম। জমা দেওয়ার পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে পাবলিক কমপিটিশনে ভোটে আমার ছবিটাই সিলেক্ট হয়ে গেল। একটা পুরস্কারও পেয়ে গেল ছবিটা। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি তো লিখে গল্প বলতে পারি না, তাহলে নিশ্চয় আমি ছবি তুলে গল্প বলতে পারি। ছবি যেহেতু মানুষ পছন্দ করছে, ছবির মাধ্যমে স্টোরিটেলিং করা যাচ্ছে। সো আমি তো ছবির মাধ্যমে গল্প বলতে পারি। তখন আমি সিরিয়াসলি ছবি তোলা শুরু করলাম। এটা ২০০৯ সালের দিকে। কিছু এক্সিবিশনে আমার ছবি সিলেক্টও হলো। ফটোগ্রাফি শুরু হলো। এবং এই ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়েই পরবর্তী সময়ে আবার আমি লেখালেখিতে চলে এলাম। আলোকচিত্রের বই ‘গল্পছবি’ লেখা হলো। ‘গল্পছবি’র ছোট ছোট গল্প যখন ফেসবুকে শেয়ার করা শুরু করলাম, আমি দেখলাম যে অসংখ্য মানুষ সেটা গ্রহণ করছে, তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তখন আমার কাছে মনে হলো লেটস ট্রাই টু রাইট এগেইন। এখন আমি ফ্রাংকলি বলি, আমার লেখালেখি নিয়ে বড় কোনো ভাবনা ছিল না, আমার কাছে কেন জানি মনে হয় ইটস লাইক এ মিরাকল। যেখানে আমি লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি ৮ বছর, এ সময়ে একটা অক্ষরও লিখিনি। ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে লেখালেখিতে ফিরলাম।

(বাকি অংশ আগামীকাল)