হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো উপন্যাস

দারিদ্র্য, হতাশা, অবহেলা, বঞ্চনার কাছে জাতশিল্পী মাথা হেঁট করেন না। পদমর্যাদা, ক্ষুৎপিপাসার কারণে শিল্পের পথে অন্তরায় হয়, এ নজির হয়তো আছে, কিন্তু সে সংখ্যাটার হিসাব আঙুল গুনে গুনে দেওয়া যাবে, মহাকালের হিসাবের খাতা ঢুঁড়ে-ফুঁড়ে খানতল্লাশ করে। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে দারুণ সফল ও জাতশিল্পী, এই দুয়ের মেলবন্ধনে আঁকা প্রতিকৃতি কল্পনা করতে হলে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয় সাহিত্য কিংবা শিল্পরসিককে।

জীবনানন্দ দাশ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দারিদ্র্যপীড়িত, বিষণ্ন ও ‘বিভীষিকা’ হয়ে ওঠার জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই পাবেন এর সত্যতা।

জীবন সংগ্রামের ব্যর্থ হলেও মহাকালের সোনার তরিতে তাঁদের সোনার ধান জায়গা করে নিয়েছে পোক্তভাবে। অন্য দিকে একের পর এক সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করে জীবনানন্দ দাশের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিলেন যিনি, সেই সজনীকান্ত দাসেরাও মহাকালের বুকে ঠাঁই করে নিয়েছেন—তবে সেটা তাঁদের শিল্পসত্তার জন্য নয়, জীবনানন্দ দাশের সমালোচক কিংবা পথের পাঁচালীর প্রকাশক হিসেবে। অথচ গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে সজনীদের অঙ্গুলিহেলনেই সেকালে শিল্প-সাহিত্যের ঝান্ডা উড়েছে। তেমনি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবন মহাকালের কষ্টিপাথরে বিচার করলে দেখা যাবে, বাংলার জীবনানন্দ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহাকালের বুকে আঁচড় কেটেছে তাঁর শিল্পকর্ম। সেগুলোর মূল্য টাকার অঙ্কে জীবদ্দশায় বাতিল কাগজের চেয়ে কম হলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে! আর শৈল্পিক মূল্যের কথা নাই–বা বললাম।

একটুখানি ভালোবাসার জন্য, দুমুঠো অন্নের জন্য জীবনের সঙ্গে যিনি যুদ্ধ করেছেন, ভাইয়ের বিয়ের খবর শুনে হতাশ হয়ে যিনি নিজের কান পর্যন্ত কেটে ফেলেছিলেন, তিনিই বিষণ্ণতা কাটাতে কিংবা বিষণ্ণতার চোরাবালিতে ডুবে ডুবেই রং–তুলির আঁচড়ে মহাকালের ক্যানভাসে এঁকেছেন কালজয়ী সব ছবি।

>

জীবন-তৃষা
আরভিং স্টোন
অনুবাদ: অদ্বৈত মল্লবর্মণ
প্রকাশ: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০,
৪০০ পৃষ্ঠা
দাম: ৬৫০ টাকা। 

ভ্যান গঘের জটিল দুর্বিষহ জীবনের ছবি উপন্যাসে ক্যানভাসে তুলে আনার কাজটা সহজ ছিল না। সাধারণের দৃষ্টিতে অনেক সস্তা চটুল ছবিও যেমন মনে হতে পারে দামি-কালজয়ী শিল্পকর্ম, ততটাই মূল্যহীন হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের সেরা ছবি। কিন্তু সত্যিকারের শিল্পীই কেবল আরেকজন জাত শিল্পীর শিল্পের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেন। মার্কিন লেখক সেই জাতের কথাশিল্পী, যিনি কলমকে রং-তুলি বানিয়ে উপন্যাসের ক্যানভাসে যথার্থভাবেই আঁকতে সক্ষম হয়েছিলেন ভ্যান গঘের বিচিত্র দুর্বিষহ জীবনের ছবি। ভ্যান গঘেরর মতো আরভিং স্টোনের সাহিত্যাঙ্গনে চলা শুরু হয়েছিল কাঁটা বিছানো পথে। লাস্ট ফর লাইফ নামের উপন্যাসটির খসড়া পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, একে একে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন ১৭ জন প্রকাশকের কাছ থেকে। দমে যাননি স্টোন, দমে গেলে মহাকাল বঞ্চিত হতো উপন্যাসের আদলে গড়ে ওঠা এক কালজয়ী শিল্পকর্মের সৌন্দর্য থেকে। ১৮তম প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল লাস্ট ফর লাইফ। ভাগ্যাহত এক শিল্পীর জীবনের করুণ কাহিনি পাঠকের চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু যেমন ঝরিয়েছিল সেকালেও, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিল্প ও সাহিত্যরসিকের হৃদয়কে সমানভাবে আর্দ্র করে চলেছে নিরন্তর।

এমন এক মহাকাব্যিক ইংরেজি উপন্যাসের বাংলা অনুবাদের কাজটাও সহজ ছিল না। ঝরঝরে অনুবাদ তো বাড়তি পাওনা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ, যাঁকে আমরা ‘নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব’ করা সাহিত্যিক বলে মনে করি, যিনি নিজে জীবনের সঙ্গে লড়ছেন, প্রতিকূল পরিবেশে করে গেছেন শিল্পের চর্চা, তাঁর হাতেই যথার্থ রূপান্তর হয়েছে লাস্ট ফর লাইফ-এর। দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁর সরকারি মল্লবর্মণকে দিয়ে ধারাবাহিকভাবে লাস্ট ফর লাইফ-এর অনুবাদ করেছিলেন জীবন-তৃষা শিরোনামের মোড়কে। ভিনসেন্টের মতো মল্লবর্মণের জীবনও ছিল বঞ্চনা আর অবহেলার মলাটে বন্দী। শিল্পীর মতো তিনিও অকালে চুকিয়েছেন জীবনের লেনাদেনা। কালজয়ী উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম তাঁর জীবদ্দশায় মর্যাদা পায়নি। এমনকি যে দেশ পত্রিকায় তিনি নিজের জীবন নিংড়ে দিয়েছেন, সেখানেও ছিলেন অবহেলিত। অনাদর আর অবহেলার মধ্যেই বিদেশি ক্যানভাসে আঁকা এক মহাশিল্পকে তিনি রূপান্তর করেছেন বাংলা ভাষার ক্যানভাসে।

পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর জীবন-তৃষা উপন্যাসটিকে বই আকারে বের হতে অর্ধশতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তাতে এর উজ্জ্বলতা ফিকে হয়নি বরং বেড়েই চলেছে দিন দিন। বাংলাদেশি সাহিত্যরসিকের কথা ভেবেই প্রথমা অদ্বৈত মল্লবর্মণের সেই সহজ সাবলীল অনুবাদ পুনর্মুদ্রিত করেছে ২০২০ সালের বইমেলায়। শিল্পরসিক তো বটেই, জীবন-তৃষা সাধারণ উপন্যাসপ্রেমিককেও একটানে ভ্যান গঘের বিচিত্র, বিষণ্ন, দুর্বিষহ জীবনের স্বাদ পাইয়ে দেবে।