নভেম্বর রেইন

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘তোর বউরে আমি একটা লাল শাড়ি গিফট করব, দেখিস’— মাথার ঠিক উল্টা দিকে ঘুইরা দেয়ালে পা তুইলা দিতে দিতে বললাম বাপ্পিকে। তার মাথাটা আমার মাথার সাথে প্রায় লাগানোই ছিল। আলতো কইরা গুঁতা দিয়া কোনো বাক্য ছাড়াই প্রতিবাদ ছুইড়া দিল যেন। ‘চুপ কইরা আছিস যে?’—তাতেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই দেইখা আমি উপুড় হইয়া চুল ধইরা টান মারলাম ওর। বাপ্পির মাথায় চুলের অভাব নাই। মাথাভর্তি কোঁকড়া কালো চুলগুলোর প্রতি আমার একধরনের বাড়তি মায়া আছে। চুলে হাত বোলাতেই বইলা উঠল, ‘বিয়া মানুষের কয়টা হয় রে? আমি কি চাইরটা বিয়া করার ব্রত নিছি নাকি?’ বুকের ভিতর চাপা একটা যন্ত্রণা বমির মতো বাইর হইয়া আসতে চাইল আমার। তারপরেও জোর কইরা কইলাম, ‘করতেই পারিস। একজনরেই আর কতদিন ভালো লাগতে পারে কারও।’ আরও সাবধানে গোপনে জাইনা নেওয়ার ভাব লুকায়ে বললাম, ‘কিংবা ধর, বৃষ্টিই যদি ফেরত আসে তখনই–বা তুই কী করবি?’ কোনো উত্তর আসে না আমার পিঠের ওই পাশ থেইকা। আমি অপেক্ষায় থাকি।

বাপ্পির সাথে পরিচয়ের দিনটা প্রায়ই মনে করি। ভালো লাগে মনে করতে। কোনো এক সরকারি ছুটির দিন ছিল, তা–ও ভুলবশত আমি ক্লাসে চইলা গেছিলাম। মাত্র তখন আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হইছি। ক্লাস চলত সারা সপ্তাহ, কিন্তু কিছুতেই আমার মন ঢাকায় টিকত না। টানা সপ্তাহ দুয়েকের বেশি থাকতে পারতাম না। অন্তত বাড়ির ঘ্রাণটা নিতে হইলেও ছুইটা যাইতাম কদিন পরপরেই। বাড়ির প্রতি টানটাও আমার কইমা যাইতে শুরু হইছিল আমাদের প্রেম চলার পর থেইকা।

‘তুই কি আর সবার মতোই হবি?’

‘মানে?’

‘মানে ধর, আমি যদি তোরে কোনো দিন ছাইড়া চইলা যাই বা মইরা যাই, তুই কি সঙ্গে সঙ্গেই তোর আগের প্রেমিকার সাথে বা নতুন কারও সাথে আবার জমাইতে শুরু করবি?’

‘তোমার কেন এই সব মনে হইতেছে বাবুন?’ এইবার ঠিকঠাক উইঠা বইসা আমার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাইল বাপ্পি। ‘তুমি’ সম্বোধনে তার সিরিয়াস হওয়ার মাত্রা বুইঝা সমস্তই আবার নিজের মধ্যে গুটায়ে নিলাম। বর্তমানরে স্কিপ করতে ২৫ আগস্টের কথা ভাবতে লাগলাম আবার, আমাদের পরিচয়ের দিনটা। আর্ট ইনস্টিটিউটের লম্বা করিডোর। একজোড়া ঠোঁট আমার দিকে তাকায়ে মিটমিটায়ে হাসতেছিল, সবটুকুই আমার ভেতর দৃশ্য হিসেবে উপস্থিত হইয়া আছে। বুকের ভেতর কোনো উত্তেজনা ছিল না তখন। বরং হাসিটা আমার ভ্রু কুঁচকায়ে দিছিল। তখন থেইকাই যে আমার জীবনের সবকিছু বদলায়ে যাবে, তা আমি বুঝতে পারি নাই।

আমার দুনিয়াটা হঠাৎ কইরাই কেমন স্থির হইয়া গেল। নিজেরে কোনোভাবেই দমায়ে রাখতে পারি না। বুকের ভিতর প্রশ্নগুলা যেন পানি ছাড়া মাছের মতো ছটফটায়ে মরতেছে। কান্নার দমক থামাইতে থামাইতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বাপ্পি অফিস থেইকা ফিরলে আগে যেমন নিজ থেইকাই চা বানায়ে নিয়া বসত কিংবা ইউটিউব ঘাঁইটা নতুন নাস্তার রেসিপি বানাইতে লাইগা পড়ত, তেমন আর নাই এখন। সবই স্তিমিত হইয়া পড়ছে। আমি সারাটাক্ষণ ওর চেহারার বদলায়ে যাইতে থাকা ভাঁজগুলা আর চলাফেরা লক্ষ করতে থাকি। এই যে এখন সন্ধ্যা। ইলেকট্রিসিটি নাই। তারপরেও যেন আমি ওর ভেতরের ছটফটানি দেখতে পাইতেছিলাম। অনেকক্ষণ ধইরা চুপচাপ বইসা আছি আমরা। না চাইতেও আবার ওরে জিগ্যেস কইরা ফেলাইলাম। ‘বৃষ্টির সাথে কি তোমার যোগাযোগ আছে?’ এইবার খুব সিরিয়াসভাবে বিরক্ত হইয়া আমার দিকে ঘুইরা বসল। ‘আজেবাজে কথা বলবা না আমারে তনু। তোমার সন্দেহ মাত্রা ছাড়ায় যাইতেছে ইদানীং।’ বইলাই হাঁটা দিল। ছাদে গেল নিশ্চয়ই। আমাদের এই ছাদবাড়িটা আমরা ভাড়া নিছিলাম বিয়ার চার মাসের মাথায়। বাড়িটা প্রথমে বাপ্পিই দেখছিল। দেইখা পছন্দ হওয়ায় আমারে ছবি তুইলা মেসেঞ্জারে দিছিল। চিলেকোঠায় বাসা পাওয়ায় আমাদের খুশি ছিল সীমাহীন। কত প্ল্যান করছিলাম আমরা ছাদ নিয়া। তৎক্ষণাৎ অ্যাডভান্স কইরা আগের বাড়িওয়ালারে জানায় দিছিলাম। কিন্তু তখন কোনোভাবেই বুঝতে পারি নাই আমার এই সুখ বেশি দিনের না। মানুষের সুখের স্থায়িত্বকাল যে এত কম হইতে পারে, কখনো বুঝি নাই। অনেক আগে বাপ্পি আমারে বলছিল, ওর কাছে প্রেম হইল প্রতিফলিত হওয়ার মতো ব্যাপার। মানে যে ওরে যত বেশি ভালোবাসা দিতে পারবে, বিনিময়ে ও ততটাই ফেরত দিতে পারবে। কিন্তু আমি হয়তো সেই মানুষই ওর কাছে না, যার ভালোবাসা প্রতিফলিত হইতে পারে। আমি এখন জানি, কী ঘইটা যাইতেছে আমার অলক্ষ্যে। এ–ও বুঝি বাপ্পি চাইয়াও আমারে কিছু বলতে পারতেছে না। আমি কষ্ট পাব, এই ভাইবাই হয়তো। জানালা দিয়া চাঁদ দেখা যাইতেছে। অথচ এই চাঁদের আলো আমার ভিতর পর্যন্ত পৌঁছাইতে পারতেছে না। আমি আরেক দুনিয়ার মধ্যে খাবি খাইতেছি—যেই দুনিয়ায় কোনো আলো নাই, পানি নাই, নিশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনটুকুও নাই।

আমাদের বাড়িটা বর্ষাকালে ভয়াবহ সুন্দর হয়ে ওঠে। মানে উঠত। বাড়ির সামনে দুই পাশে একটা জায়গার মতন ছিল। সেইখানে বর্ষাকালে হলুদ ঘাসফুলে ভইরা থাকত। ঘুমের মধ্যে আমি সেই হলুদ ফুলগুলা স্বপ্নে দেখতেছিলাম। শুধু ফুল না, ফুল হাতে নিয়া ধইরা দাঁড়ায়ে থাকা দুইটা মেয়ে দেখলাম। তারা আমার সাথে কোনো কথা বলল না। চুপচাপ দাঁড়ায়ে ছিল ফুল হাতে। এরপরে একটা ছেলেরেও দেখতে পাইলাম, বয়স কম, হাফপ্যান্ট পরনে। ছেলেটার বুকপকেটে অনেকগুলা সাপের বাচ্চা উঁকি মারতেছে মাঝেমধ্যে। আমি কলতলায় শুইয়া এই সব দেখতেছিলাম। আকাশে কালো রঙের ছোপ ছোপ মেঘ, বৃষ্টি হবে হবে করে কিন্তু হয় না। আমার শরীরের আশপাশ দিয়া ঘুইরা বেড়াইতেছিল অসংখ্য কেঁচো। ছোটবেলায় অবাক হইয়া দেখতাম, কেঁচোর শরীর একবার কাইটা গেলে তারা আলাদা আলাদা দুইটা শরীর হইয়াই ঘুইরা বেড়ায়।

‘আচ্ছা, কেঁচোর শরীর ভাগ হয়ে যাওয়ার সাথে কি তার মনও আলাদা ভাগ হয়ে যায়? ’—বাপ্পিরে স্বপ্নের গল্পটা করতে করতে জানতে চাইলাম।

অনেকক্ষণ চুপ থাইকা সে জিগ্যেস করল, ‘আমারে তোর কেঁচো মনে হয়?’

আমি একটু বিব্রত হইয়া পড়ি। বাপ্পিরে আমার আসলেই কেঁচো মনে হয়। মনে হয়, তার শরীরটা দুই ভাগে ভাগ হইয়া গেছে। তার মনের ভাগও দুইটা। একটা ভাগ আমার কাছে, আরেকটা ভাগের হদিস আমি জানি না কিংবা জানি। বৃষ্টির গল্প বাপ্পি আমাকে প্রথম বলছিল আমাদের সম্পর্কের প্রায় মাস তিনেক পর। এরপর আমিই খুঁচায়ে তারে কয়েকবার জিগ্যেস করছিলাম। সংক্ষেপে উত্তর দেওয়ার বাইরে আর কিছুই সে বলে নাই আমারে। বাপ্পির ছোট ভাইসহ মা–বাবা গ্রামের বাড়িতে বেড়াইতে গেলে আমরা পুরা দুই দিন একসাথে কাটানোর সুযোগ পাইছিলাম বিয়ার আগে। তখনই প্রথম সে আমাকে বৃষ্টির গল্প বলে। ছোট্ট যত্ন কইরা রাখা বছর কয়েকের পুরোনো একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখায় আমারে। স্কুলড্রেস পরা একটা মেয়ে। ছবিতে চেহারা খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না, অনেক দিনের পুরোনো হওয়ায় ছবির জায়গায় জায়গায় সাদা হয়ে গেছিল। আমার ইচ্ছা হইতেছিল খুঁটায়ে খুঁটায়ে সবগুলা পিক্সেল আলাদা কইরা দেখি, কিন্তু ভালোমতো দেখার আগেই একটা ডায়েরিসহ ছবিটা বাড়ির পেছনের ডোবায় ছুইড়া ফেলায় দিল সে। তখন থেইকাই আমার ভিতরের কী যেন একটা বদলায় যাইতে শুরু করল। যেই মানুষটা কোথাও নাই, চারপাশের কোনো কিছুতেই তার একজিস্টেন্স নাই, অথচ আমার মনে হইতে শুরু হইছিল, সে সবকিছুতেই আছে। একটা মানুষ যারে কোথাও দেখতে পাওয়ার ভয় নাই, তারে আমার এত ভয় কেন আমি কিছুতেই বুইঝা উঠতে পারতেছিলাম না।

সকালবেলার সেই অসহ্য স্বপ্নটা দিনভর আমারে জ্বালাইতে লাগল। বিবমিষার মতো লাগে। বাপ্পি অফিসে চইলা যাওয়ার পর কাজ বলতে আমার তেমন কিছু থাকে না। বিয়ার পর চাকরিটা ছাইড়া দিছিলাম। ভাবছিলাম সংসারের সুখ গায়ে লাগাব আরও কতদিন। ক্যারিয়ার আমারে কোনো দিন টানে নাই। নিজের থাকা–খাওয়ার খরচ চালাইতেই চাকরি দরকার ছিল। অলস সময় চারপাশে গড়াগড়ি খাইতেছে। বিছানা, বালিশ, কাঁথারা পইড়া থাকে। ওদের দেইখাও বোঝা যায়, আমার মতো অলসতা জাঁইকা ধরছে ওদেরও। বাইরের রোদ আমারে স্পর্শ করে না। জানালায় দাঁড়ায়ে নারকেল গাছের পাতাদের বাতাসে দুলতে দেখি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ক্লান্তি লাগে না আমার। সকালের দিকে বৃষ্টি হইছিল। নারকেল গাছের পাতাগুলার মাঝখানগুলাতে এখনো অল্প অল্প পানি জইমা আছে। রোদের তাপে পুরোপুরি শুকায়ে উঠতে পারে নাই এখনো। পৃথিবীতে কিছুই চিরস্থায়ী না। গাছের পাতার উপরের পানিগুলা দেইখা মনে হইল আমার, এই পানিগুলা উইড়া গিয়া আরেক রকমের জীবনের মধ্যে ঢুইকা পড়বে। তাদের চরিত্র বদলাবে। জীবনের ধরন বদলায় যাবে।

কম্পিউটারের মনিটরে ফেসবুক খুইলা রাখি বাপ্পি অফিসে যাওয়ার পর থেইকাই। মেসেঞ্জার বাক্সে ওর নামের পাশে সবুজ বাতিটা সারাক্ষণ জ্বলতে থাকে। আমারে পীড়া দেয় সেই বাতি। সারাক্ষণ ওইটা দেখার জন্যই ফেসবুক খুইলা রাখি যেন। যন্ত্রণা বাড়ে, অথচ তারপরেও আমি বন্ধ কইরা দিতে পারি না। 

বৃষ্টির সাথে বাপ্পির প্রেম শুরু হইছিল ওরা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে। খুব নাকি আলোচিত প্রেম ছিল স্কুলে। ল্যান্ডফোনের যুগের প্রেম। এত প্রেম ছিল যে মেয়ের বাবা বাপ্পিরে স্কুলের সামনে পিটাইছিলেন এবং ওই এলাকা ছাইড়া মেয়েরে নিয়া আরেক স্কুলে ভর্তি কইরা দিছিলেন। তাতেও তাদের প্রেমে ভাটা পড়ে নাই। বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় সেই প্রেম টিকে ছিল কলেজের শেষ পর্যন্ত। বিকালের দিকে বৃষ্টি বান্ধবীর বাড়িতে গিয়া ল্যান্ডফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেম করত। বাপ্পির বাড়িতে ফোন ছিল না। আরেক বন্ধুর বাড়িতে গিয়া সে কথা বলত। দিস্তা দিস্তা চিঠি জমা ছিল বাপ্পির কাছে। সেই সব চিঠির অল্প কিছুই সে আমারে পড়তে দিছিল। আমার সাথে প্রেম হওয়ার পর সেই সব চিঠি বাপ্পি কই লুকাইছিল কিংবা কী করছিল, তা কখনো আমি জানতে পারি নাই। কলেজের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বৃষ্টির বাবা মেয়েরে এক প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়া দিয়া দেশের বাইরে পাঠায়ে নিশ্চিন্ত হইছিলেন। বাপ্পির জীবন একেবারেই বদলায় গেছিল সেই ঘটনার পর থেইকা। পড়াশোনায় সে আর আগায় নাই। দুইবার সুইসাইড করতে গিয়া ব্যর্থ হইলে ওর পরিবার ওরে রিহ্যাবে দিয়া দেয়। রিহ্যাব থেইকা বাইর হওয়ার পর সে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করে। আমার সাথে বাপ্পির পরিচয় আমার ক্যাম্পাসেই। বৃষ্টির পর আর কারও সাথেই বাপ্পির তেমন প্রেম জমছিল না। চেষ্টা নাকি করছিল কয়েকবার কিন্তু সফল হয় নাই। কিন্তু আমার সাথে তার প্রেমটা যে কেন হয়ে গেছিল, সেইটা আমার কাছেই এক বিরাট বিস্ময়। সেই বৃষ্টি ফিরা আসছে, ডিভোর্স নিয়া দেশে ফিরছে। অসতর্কতাবশত বাপ্পি একদিন ফেসবুক খুইলাই অফিস চইলা যাওয়ায় এই সব জানতে পারি আমি। ওদের কনভার্সেশনে বৃষ্টির মধ্যে যেই আকুলতা আমি দেখছিলাম, তাতে আমার শিরদাঁড়া বাইয়া একটা ঠান্ডা সাপের মতো কিছু বয়ে যাওয়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না।

সব জানার পরেও আমি নিজ থেইকা কিছুই জানতে চাই নাই তার কাছে। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা কইরা আসতেছিলাম প্রতিটা মুহূর্ত। সারাটা দিন ভারী শরীর আর মনের বোঝা বয়ে বেড়াই। আমি জানি না ওদের এখন কী কথা হয়। আমি জানি না ওরা দেখা করে কি না। কিছুই আমি জানতে পারি না। বাপ্পির মনের ভিতরটা আমার দেখতে ইচ্ছা হয়, পড়তে ইচ্ছা হয়। ওদের প্রেমের আকুলতাও জানতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় যেন এই প্রেমের মাঝখানে আমি একটা তৃতীয় পক্ষ। আমি যদি বাপ্পিরে ছাইড়া দেই তা হইলে নিশ্চয়ই ওরা একসাথে হইতে পারবে। কিন্তু আমি জানি, সেইটারে নৈতিক জায়গা থেইকাই বাপ্পি দেখে বইলা আমারে কিছু বলতে পারে না। আমার মাঝে মাঝে নাটকীয়তা কইরা ইচ্ছা করে একটা লাল রঙের শাড়ি সুন্দর কইরা প্যাক কইরা আর একটা চিঠি রাইখা এই বাসা থেইকা বাইর হয়ে পড়ি। সেইটাও আমি পারি না। যারে আমি ভালোবাসি, তারে আমি কীভাবে ছাড়তে পারি, সেই ক্ষমতা আমার শরীর আর মনের নাই—আমি জানি।

দিন যত যায়, আমার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। আমাদের মধ্যকার কথাগুলা ফুরায় আসতে শুরু করে। এই সংসার আর সংসার লাগে না আমার কাছে। মনে হয়, চারটা দেয়ালের একটা বাক্সের মধ্যে আটকা পইড়া যাওয়া দুইটা মানুষ। কেউ কারও ভিতরের কষ্টগুলা, চাওয়াগুলা জানে না। কেউ কারও প্রতিটা দিনের গল্প জানে না। বাড়ি থেইকা কোথাও যাই না আমি। আমার জানালার পাশের বিল্ডিংয়ের সানসেটে একটা চড়ুই পাখি এসে বসে প্রায়ই। ওরে দেখে নিজের মতো লাগে। আশপাশের জীবন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া একটা জীবন। যোগাযোগবিহীন একটা আত্মা যেন আমি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিকাল হইলে ছাদে গিয়া বসি। ছাদের উপর আরেকটা ছাদ আছে এই বাড়িটাতে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে মনেই থাকে না যে কখন আমি এতটা উপরে উইঠা আসলাম। বিকালের কমলা রঙের আলো সিমেন্টের ঢালাই করা পানির ট্যাংকির গায়ে আইসা পড়ে। নিজের ছায়া সেইখানে নিয়া তার দিকে তাকায়ে থাকি আমি অফুরন্ত সময় ধইরা।

শীতকাল চইলা আসছে প্রায়। আলমারি থেইকা গায়ে দেওয়ার পুরোনো চাদর বাইর করলে তাতে গত বছরের বাপ্পির গায়ের গন্ধ পাই আমি। এই গন্ধটাই আমার কাছে পরিচিত, চেনা। এখনকার এই মানুষটার সাথে যার কোনো যোগাযোগ নাই। বাপ্পি আমার সাথে সব রকমের আত্মিক যোগাযোগ বন্ধ কইরা দিছে ধীরে ধীরে। হয়তো সে নিজেই চাইতেছে, আমি নিজ থেইকাই জাইনা–বুইঝা যেন চইলা যাই। মাঝে মাঝে কেমন আছি বুঝতে চেষ্টা করি আমি। নিজের কাছে কোনো উত্তর খুঁইজা পাই না। মনে হয়, আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। ওদের কনভার্সেশনের এক জায়গায় বৃষ্টি লিখছিল, নিজেরে তার খুব অসহায় লাগে। এই পৃথিবীতে বাপ্পি ছাড়া পরিচিত আর কাছের যেন আর কেউ নাই, সুইসাইডাল লাগে তার। হইতে পারে ওরাই ওদের সবচেয়ে আপন। বৃষ্টির বিয়া না হয়ে গিয়া থাকলে আমিই–বা কে ছিলাম বাপ্পির জীবনে।

এর মধ্যে একদিন রাতে খাইতে বইসা বাপ্পি অনেক দ্বিধা নিয়া আমারে জানাইল, বৃষ্টি ফেরত আসছে। ওর বর্তমান অবস্থাও আমারে জানাইল। এতে সে খুব অসহায় ফিল করতেছে এবং সে জানে না তার কী করা উচিত। আমি চুপচাপ শুইনা গেলাম শুধু। খাওয়া শেষে টেবিল গুছাইতে গুছাইতে বললাম, মানুষের মন যা চায়, তা–ই করা উচিত, মনের বাইরে গিয়া কিছুই হয় না। এতে বাপ্পির কোনো উত্তর ছিল না।

নভেম্বরের বৃষ্টি খুব রোমান্টিক হয় জানতাম। আজকে সারা দিন শীতল বাতাস আর টিপটিপ বৃষ্টিতে জানালার পাশেই বইসা ছিলাম। বিকাল হইতেই যেন সন্ধ্যা নাইমা আসলো পৃথিবীতে। চারপাশের দুনিয়ার লাল টকটকে আভার মধ্যে নিজেরে ঘোরগ্রস্ত মনে হইতে থাকল। বাপ্পি খুব কিছু না বইলাও অনেক কিছুই বইলা দিছে আমারে। সেই না বলতে পারা দ্বিধায় আক্রান্ত বাপ্পিরে আমি কীভাবে মুক্তি দিতে পারি, আমার জানা নাই। এমন এক ভাবনা সারা দিন আমারে পোড়াইতে লাগল। এমন এক সন্ধ্যায় নিজেরে আমি কোথায় নিয়া যাইতে পারি, তেমন কোনো ধারণা ছিল না আমার। কিন্তু তারপরেও মনে হইতেছিল, আমার বাইর হওয়া উচিত। এমন বৃষ্টি আর শূন্য হয়ে আসা পৃথিবীর বুকে আমার নাইমা যাওয়া উচিত। নিজের ঘোরগ্রস্ততা নিয়ে আমি সিঁড়ি বাইয়া নামতে থাকলাম আর বাইর হইতেই চেনা দুনিয়ার দেখা পাইলাম। যেন বহু বছর বাদে আমি নিশ্বাস নেওয়ার মতো কিছু খুঁইজা পাইছি, যেন এখন আর আমার কোথাও যাইতে কোনো বাধা নাই। যেন আমার নিয়তি নাই কোনো। হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টির ভিতরে আমি মিশা যাইতে লাগলাম, মিলায়ে যাইতে লাগলাম। আমার পেছনে ফেইলা আসা সংসার, আমার আটকে পড়া বাক্সের দুনিয়া রাইখা আমি বাতাসের দমকে হারায়ে যাইতে লাগলাম।