মামুনের ক্যামেরায় বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্রমালা

বাংলাদেশ িবমানবাহিনীর িদ্বতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,  ২৮ নভেম্বর ১৯৭৩। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
বাংলাদেশ িবমানবাহিনীর িদ্বতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৮ নভেম্বর ১৯৭৩। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বাংলাদেশে এ বছর পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। সরকারি, বেসরকারি, সাংগঠনিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়েও চলছে নানান আয়োজন। ঢাকার ফরাসি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক বিভাগ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে এখন চলছে নাসির আলী মামুনের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।

নাসির আলী মামুন এমন এক ঘরানা বা ধারার আলোকচিত্রশিল্পী, যে ধারায় দ্বিতীয় শিল্পীর নাম মনে করা একটু কঠিনই হবে। আলোকচিত্রশিল্পী কিংবা প্রতিকৃতি শিকারি তিনি। ঢাকায় জন্মেছেন, কিন্তু তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুরে। মার্কিন মুলুকে থেকেছেন জীবনের একটা সময়। এখন পৃথিবীর নানান দেশেই ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন ঢাকায়। বর্তমানে ঢাকার অদূরে, হেমায়েতপুরের পাশে আস্তানা গেঁড়েছেন। আস্তানা বলতে ফটোগ্রাফির আর্কাইভ। আলোকচিত্রের মহাফেজখানা করেছেন তিনি, নাম দিয়েছেন ফটোজিয়াম।

ছাত্র ইউনিয়নের ১৪তম জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু, ১ নভেম্বর ১৯৭৩। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
ছাত্র ইউনিয়নের ১৪তম জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু, ১ নভেম্বর ১৯৭৩। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ক্যামেরায় তিনি সাবজেক্ট ঠিক করে নিয়েছেন সেই কৈশোর-বয়ঃসন্ধিকালেই, যখন তিনি মানুষের পোর্ট্রেট ধরে রাখতে শুরু করলেন। মানুষের পোট্রের্ট বলতে সরাসরি গণমানুষের প্রতিকৃতি নয়—এককথায় স্বগুণে, স্বপ্রতিভায় বিকশিত যেসব বিখ্যাত মানুষ, তাঁদের মুখ। সেই তালিকায় কে আছেন, কে নেই? আছেন পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ গোলার্ধের সৃষ্টিশীল সহস্র ব্যক্তিত্ব, অজস্র প্রতিভা। ডজনখানেকের বেশি নোবেল লরিয়েট থেকে অস্কারজয়ী বা নানান মাত্রায় স্বীকৃত গুণীজনের মুখের স্থিরচিত্র ধরে রেখেছেন নাসির আলী মামুন। তাঁর ক্যামেরার লেন্সে ধরে রেখেছেন শত শত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীকে। সত্যি, এ রকম পোর্ট্রেট শিকারি দ্বিতীয়জন আর কে আছেন, জানি না। কিন্তু বাংলাদেশে আছেন একজন—নাসীর আলী মামুন। হতে পারে, প্রতিকৃতি ধারণে মামুন নিজেই একজন আর্কাইভাল আলোকচিত্রী হয়ে গেছেন। আলোকচিত্রশিল্পী—এই পরিচয় ছাড়াও তিনি এমন একজন বিনয়ী মানুষ, যেমনটি আজ আর মেলে না।

মামুনের প্রদর্শনীটি যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তাই লা গ্যালারির দেয়ালে টাঙানো কেবল বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর ছবি—যেসব ছবি নাসির আলী মামুন তুলেছেন তাঁর প্রায় বয়ঃসন্ধিকালে, ১৭-১৮ বছর বয়সে। গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকেই ক্যামেরা হাতে নিজের ভ্রমণ শুরু করেন মামুন। ফলে বঙ্গবন্ধুকে তিনি ক্যামেরায় ধরেছেন নানান ভঙ্গিতে, নানান স্পটে। ৭ মার্চে যেমন ধরেছেন বঙ্গবন্ধুকে, ধরেছেন স্বাধীন দেশের মাটিতেও। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন ১৯৭৫-এ। মামুনের ক্যামেরায় বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যাবে সে পর্যন্তই। প্রতিটি ছবিতেই পাই আমাদের চেনা চিত্রের বাইরে বঙ্গবন্ধুর অন্য রকম এক অভিব্যক্তি! আর সাদাকালো সব ছবির পেছনে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন সেই সময়ের স্বপ্নাকুল বয়ঃসন্ধির অখ্যাত মামুন—আজকের বাংলাদেশের বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন—আগেই বলেছি, যাঁর লেন্সের সামনে পোজ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন পৃথিবীর লিজেন্ডারি সব মানুষ। প্রেস ফটোগ্রাফি বা ল্যান্ডস্কেপ করেন না মামুন, সময়ের গুণী মানুষের মুখ অনিন্দ্য নান্দনিকতায় তিনি ধরে রাখেন তাঁর ক্যামেরাকৌশলে। এটাই তাঁকে আলাদা করে দেয় অন্য আলোকচিত্রীদের থেকে।

বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ঢাকা স্টেডিয়াম, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ঢাকা স্টেডিয়াম, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে নাসির আলী মামুনের চলতি প্রদর্শনী দেখতে দেখতে দর্শক হিসেবে হঠাৎই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বয়ঃসন্ধির সেই সময়েই একজন মামুন ক্যামেরা হাতে কী করে একজন রাষ্ট্রনায়কের এতটা কাছাকাছি পৌঁছলেন? বিশেষত তিনি যখন কোনো প্রেস ফটোগ্রাফার নন, নন কোনো এজেন্সি ফটোগ্রাফার! সেই সময়ের প্রায় সব আলোকচিত্রীই তো বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলেছেন, মামুনও তুলেছেন। কথায় কথায় মামুনই বললেন, ‘দেশের প্রধান হলেও তাঁর কাছে যাওয়া যেত। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন।’

বঙ্গবন্ধুর কীর্তির মহিমাতুল্য ব্যক্তিত্ব এ দেশে আর কে আছেন? স্বাধীনতা, বাঙালি ও বাংলাদেশ—এখন বঙ্গবন্ধুর সমার্থক হয়ে গেছে। এ বছর এই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে হলেও আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ প্রদর্শনী বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। ছবিগুলো দেখতে গিয়ে মনে হলো, মামুনের তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবিমালার মধ্যে আছে বাংলাদেশের জন্মমুহূর্ত এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রতিটি ছবির পেছনেই রয়েছে গল্প, ছবিগুলো দেখতে দেখতে যে গল্প নিজের মতো ভেবে নিতে পারবেন দর্শকেরা।

এ মাসের ৬ তারিখে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ২৪ মার্চ অব্দি।