উর্দু কবি-লেখকদের চোখে ১৯৭১

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
>১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাঙালির জনযুদ্ধ ছিল না, এটা ছিল বিশ্বের নিপীড়িত জনগণেরও যুদ্ধ। এই সংগ্রামে আমাদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন অনেক প্রগতিশীল উর্দু কবি–সাহিত্যিকও। স্বাধীনতার মাসে এবারের প্রচ্ছদে তাঁদের সম্পর্কে জানাচ্ছেন জাভেদ হুসেন।

১৯৭১ সালের শুরুর দিক। বুদ্ধদেব বসু বা সমরেশ বসুর ঢাকা তখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। উঁচু ইমারত আর যানবাহনের কয়েদে বাতাস তখনো রুদ্ধ হয়নি। ওয়ারীতে মূল সড়ক থেকে একটু দূরে তাই শীত তখনো প্রবল। শহরে থমথমে অবস্থা। চারদিকে কেমন অন্ধকার। জায়গাটায় বিদ্যুৎবাতি এসেছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। বেশ খোলা জায়গায় একটা ঝুপড়িমতো ঘর। ঘরের পলকা দরজায় হঠাৎ টোকা পড়ল। ঘরের ভেতরে ছিলেন যিনি, একটু চমকে উঠলেন, তাঁর নাম আহমদ ইলিয়াস। উর্দু কবি, প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী। তাঁর মনে পড়ল, আজ একজনের আসার কথা। সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ বলেছিলেন বটে। দরজা খোলা হলো। আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা একজন দাঁড়িয়ে আছেন। আবছা আলোয় তাঁর ভারী কাচের মোটা চশমা নজরে পড়ল। একটু বিব্রত স্বরে ওই চাদরে ঢাকা মানুষটি বললেন, আমার আপনার এখানে আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আরেকটা ভালো জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে। এরপর সেই ‘ভালো জায়গার’ উদ্দেশে বিদায় নিলেন তিনি। ওই বিদায় নেওয়া মানুষটি ছিলেন কমরেড মণি সিংহ।

এই আহমদ ইলিয়াস বাংলার বুকে পাকিস্তানি সৈনিকদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার নাম ‘কালবৈশাখী’। উর্দু কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা খুব জায়গা পায় না। মানুষের মনের মৌসুম এর প্রধান উপজীব্য। ইলিয়াসের কবিতা বাংলার মাটি আর প্রকৃতিকে ধারণ করে তৈরি হচ্ছিল। এই মাটিতে তাই সৈনিকদের তাণ্ডবকে তিনি শান্ত জনপদের বুকে কালবৈশাখীর কালো ঝড় বলে বর্ণনা করলেন: 

আমি জানি, তবু আমি জানি

কালো ঝড়, এই কালো লস্কর

দুইয়েরই নিয়তি পরাজয়

আমি জানি, আমি জানি

প্রদীপ নিভেছে যে ঘরে

সূর্য সেখানে উঠবেই।

আহমদ ইলিয়াসের কাছে আন্ডারগ্রাউন্ডের আশ্রয়ের জন্য ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকে যিনি মণি সিংকে পাঠিয়েছিলেন, সেই সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল উর্দু লেখকদের মাথা। নিজে ছিলেন চীনপন্থি কমিউনিস্ট। কিন্তু গভীর সখ্য ছিল মস্কোপন্থী কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে। নিজে নাটক করতেন। তাঁর দুই বোন ছিলেন বেশ নামজাদা কবি। তাঁর বন্ধু ছিলেন উর্দু কবি আরিফ হোশিয়ারপুরি। পাঞ্জাবের লোক। কট্টর কমিউনিস্ট। ছিলেন আরেক শায়ের আজহার কাদরি। তখন প্রায়ই গুলিস্তানে বাটার দোকানের কাছে আনজুমানে তরক্কিয়ে উর্দুর অফিসে সাহিত্য সভা জমত। এই আনজুমান মানে উর্দু উন্নয়ন সভা। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মৌলভি আবদুল হক। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা আর সিলেটে এর অফিস ছিল। ১৯৫২ সালে আবদুল হক উর্দু ভাষার সমর্থন করেন। ফলে আনজুমানের পূর্ব পাকিস্তান শাখা অবিলম্বে বাংলার দাবির সমর্থনে পশ্চিম পাকিস্তান আনজুমানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে।

আহমদ ইলিয়াসের আগে থেকেই বাংলার মানুষের অধিকারের পক্ষে খোলাখুলি দাঁড়িয়েছিলেন নওশাদ নুরী। তাঁর জন্ম বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলায়। ছিলেন প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের বিহার শাখার সাধারণ সম্পাদক। এখানে মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির পরপরই বাংলা ভাষার পক্ষে ‘মহেঞ্জোদারো’ কবিতা লিখে চাকরি হারান। ছয় দফার উর্দু অনুবাদ করে প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের পর লেখেন ‘টুঙ্গিপাড়া’ শিরোনামে কবিতা। ২০০০ সালে ঢাকায় মারা যান এই উর্দু কবি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় এ কবির প্রথম কবিতার বই রাহো রসমে আশনায়ি (চেনাজানার পথ ও প্রথা)। এটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালি রাজনীতিক ও লেখক রণেশ দাশগুপ্তকে। 

১৯৭০ সালে নওশাদ নুরী যারিদা নামে একটি উর্দু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেখানে বড় অংশ ছিল বাংলার তরুণ কবি–সাহিত্যিকদের লেখার উর্দু অনুবাদ। ওই পত্রিকার নামের ওপরে লেখা থাকত ‘তেরা নাজাত মেরা নাজাত—ছে নিকাত ছে নিকাত’। মানে ‘তোমার মুক্তি আমার মুক্তি—ছয় দফা ছয় দফা’। গত শতকের ষাট দশকে প্রচারমাধ্যমে রবীন্দ্রসাহিত্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে নওশাদ নুরী, সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ, আহমদ ইলিয়াসরা উর্দু সাহিত্যিকদের স্বাক্ষর সংগ্রহের প্রচারণা চালান। সেই প্রচারণার বিবৃতি নামসহ ছাপা হয় যারিদা পত্রিকায়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ ১৯৭১–এ নওশাদ নুরী লেখেন কবিতা ‘লোহু মেঁ শারাবোর দিন’। মানে ‘রক্তে ভেজা দিন’। সেই কবিতায় আছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগাম বার্তা। সে সময় চারিদিকে স্তব্ধ জিবের মৃত্যুর মতো নীরবতা কাগমারি, সন্তোষ অথবা টুঙ্গিপাড়ায় ফিসফিস করে। তখন দোহাজারী, সিলেট বা ঝালকাঠিতে বুটের নিশানে নওশাদ নুরী শুনতে পাচ্ছিলেন ভবিষ্যতের স্বর:

তীক্ষ্ণ ক্ষতের মতো ঢাকায় এখন করাচির কথা

কাগান থেকে রাঙামাটি এখন অনেক দূর

এ প্রেমের ভাঙন ছাড়া পথ নেই আর

যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ নেই বাকি

আর কিছু নেই দেওয়ার শুধু ঘৃণা ছাড়া।

পাকিস্তানি ফৌজি নীতির সমালোচনা করে ১৯৭১ সালে আরেকটি কবিতা লেখেন নওশাদ—‘মাসসালাহ ফৌজ’ নামে, মানে সশস্ত্র সৈনিকেরা। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র যা দেখতে পায়নি, এই কবিতায় তাঁর দৃষ্টি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে:

অন্ধ তোমার চোখেও পড়ে না

লাশেরা এখন তুলছে দেয়াল।

উর্দু সাহিত্যিকদের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস মনিরুল ইসলাম
উর্দু সাহিত্যিকদের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস মনিরুল ইসলাম

বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯৭১ সালে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রখ্যাত কবি–সাহিত্যিকেরা এর প্রতিবাদ করেছেন। অবশ্য এই সংবেদনশীলতা এরও আগে থেকেই দেখিয়েছেন তাঁরা। ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষে লেখেন রিয়ায আনওয়ার। মুলতানের মানুষ এই কবি ১৯৭০ সালে বাংলার স্বাধিকারের পক্ষে লেখা একটি সম্পূর্ণ কবিতার বই ছেপে বের করেন। সেই বইয়ের নাম আওয়াজোঁ কা ভঁওর। মানে শব্দের ঘূর্ণিপাক। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা সংগঠনের নাম ‘বজমে সাকাফত’ বা সংস্কৃতি আসর। পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রতিনিধি ছিলেন আহমদ ইলিয়াস।

বাংলার মানুষদের সমর্থন করার ‘অপরাধে’ পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কবি-সাহিত্যিক নির্যাতন, জেল, জুলুমও সহ্য করেছেন। কেননা, সেনাশাসকদের পশ্চিম পাকিস্তানে এটা ছিল ওই রাষ্ট্রের বিরোধিতার শামিল। এই কবি-লেখকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক আর সাধারণ জনতার ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করা কবি হাবিব জালিব। ১৯৯৩ সালে গত হয়েছেন পাকিস্তানের দুর্দান্ত সাহসী এই কবি। জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের হোশিয়ারপুরে। যেখানে শ্রমিক সমাবেশ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সেখানে এই সাধারণ বেশধারী নরম চেহারার মানুষটি থাকবেনই। আর জেলখানায় যতবার গেছেন, ততবার সন্ধ্যাবেলা বাড়িও ফেরেননি। 

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মানতে অস্বীকার করলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। আবার জারি হলো মার্শাল ল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ। এ পরিস্থিতিতে হাবিব জালিব তাঁর কবিতা নিয়েই প্রতিবাদ করলেন: 

গুলির বীজ দিয়ে প্রেম বপন করছ 

মাটির বুক রক্ত দিয়ে ধুতে চাইছ 

তুমি ভাবছ বানিয়ে নিচ্ছ পথ 

আমি জানি লক্ষ্য হারাচ্ছ তুমি।

এবারে পুরোদস্তুর মুক্তিসংগ্রাম শুরু করল বাংলার মানুষ। ওদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের সব জায়গায় নির্দ্বিধায় বাংলার মানুষের পক্ষে এবং সামরিক আগ্রাসনের বিপক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন জালিব। রাষ্ট্র তাঁকে ‘গাদ্দার’ ছাপ্পা সেঁটে দিতে দেরি করেনি। কবি এবার জবাব দিলেন: 

ওরা বলে দেশের জন্য নেই কোনো প্রেম আমার 

তাই মেশিনগান চালিয়ে আমাকে ভালোবাসা শেখাচ্ছে ওরা 

আমি বোকা তাই আগ্রাসনকে বলি না আশির্বাদ 

বিনিময়ে এমন খেতাব পেয়েছি, মন্দ নয়! 

জেলখানায় হাবিব জালিবকে কাগজ-কলম দেওয়া বন্ধ করা হলো। কবি জবাব দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের পাহারাদারদের কানে কানে কবিতা পড়ব আমি, এই কবিতা সে পড়বে শহরের মাঝখানে, আর এমনি করে ঠিকই পৌঁছে যাবে লাহোরে।’

এমনকি বাংলাদেশের জন্মের বহু পরে জালিব পাকিস্তানের জনবিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কথা। ‘জাগ মেরা পাঞ্জাব’ নামের এ কবিতাটি ওই দেশের বঞ্চিত জাতিগোষ্ঠীর কাছে এখনো অনেকটা স্লোগানের মতো। কবিতার শেষ অংশে তিনি বলছেন: 

তোমাদের এই আচরণের ফলে 

নিজেদের আলাদা করেছে বাংলা।

হাবিব জালিবকে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বলেছিলেন মানুষের কবি। সরকার বদলেছে। একসময়ের বিরোধী কবিরা সরকারি কবি হয়েছেন। কিন্তু জালিব চিরকাল মানুষের পক্ষেই ছিলেন। ফলে সরকারে যিনিই আসুন, জালিবের জায়গা হয়েছে জেলখানায়। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঢালাও অমানবিকতার উত্তরে তিনি লিখেছিলেন আরও একটি কবিতা, ‘রক্তে ডুবেছে ফুলবাগান’। 

সবুজের জন্য তৃষ্ণার্ত চোখ রক্তে ডুবেছে ফুলবাগান 

প্রেমের গান শোনাব কাকে শহর হয়েছে বিরান 

রক্তে ডুবেছে ফুলবাগান

দংশন করে সূর্যকিরণ চাঁদ পোড়াচ্ছে প্রাণ 

পদে পদে মৃত্যুর গহিন ছায়া জীবন-মৃত্যু সমান 

ধনুক বাণ নিয়ে চারদিকে ফেরে হাওয়া 

রক্তে ডুবেছে ফুলবাগান 

রক্তে আলুথালু কলির বুক শতচ্ছিন্ন 

কী জানি আর কত দিন চলবে এই অশ্রুর বরিষণ 

জগজ্জন, কবে কাটবে এই দুঃখের দিনরাত 

রক্ত দিয়ে হোলি খেলে ধরিত্রির বলবান 

রক্তে ডুবেছে ফুলবাগান। 

আহমদ ইলিয়াস, নওশাদ নুরীদের সঙ্গে খুব সখ্য ছিল রণেশ দাশগুপ্তর। নিয়মিত তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে সবাই যেতেন বংশালের সংবাদ অফিসে। সংবাদ-এর সম্পাদক আহমেদুল কবীর ছিলেন লেনিন পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের অনুরাগী। ফয়েজ তখন পত্রিকা বের করেন ল্যায়ল–ও–নাহার নামে। মানে দিনরাত্রি। এ পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ঘটমান রাজনৈতিক আর আর্থসামাজিক ঘটনাবলি সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে আসল খবর জানানো। পত্রিকাটির মাধ্যমে ফয়েজ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করেছিলেন, যদি মার্চের ৩ তারিখ সংসদ না বসে, তাহলে পাকিস্তানের ইতিহাস চিরদিনের মতো বদলে যাবে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই শাসক ও রাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়েন ফয়েজ। তাঁকে বলা হতে থাকে, সৈনিকদের মনোবল বাড়ানোর মতো কবিতা–গান লিখতে হবে। কিছু সূত্রমতে, এ সময় তিনি সিন্ধ প্রদেশে অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন। বাংলায় হত্যাকাণ্ড শুরুর পর প্রতিবাদে দুটো কবিতা লেখেন এ কবি। তখন তিনি ষাটোর্ধ্ব, বেদনাহত, অসহায় যেন। ১৯৭১-এর মার্চে লেখা তাঁর প্রথম কবিতা, ‘আমার শরীর থেকে দূরে থাকো’–তে (হজর করো মেরে তন সে) তিনি লিখছেন: 

এই গণহত্যার উৎসব কী করে সাজবে বলো

আমার রক্তের বিলাপ কাকে আনবে টেনে 

আমার চোখ, শরীরে রক্ত আছেই কতটা বাকি 

তাতে জ্বলবে না কোনো প্রদীপ, না পূর্ণ হবে পানপাত্র। 

অমিয় তরফদারের মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র
অমিয় তরফদারের মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র

উর্দু গদ্যসাহিত্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে আসেনি। খানিকটা সময় লেগেছে। তবে সময়ের ব্যবধানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উর্দুতে যেসব সাহিত্য লেখা হয়েছে, সেগুলো সাহিত্য হিসেবেই অসাধারণ। এ ক্ষেত্রে প্রথমে আসবে কুররাতুলাইন হায়দারের আখিরে শব কা হামসফর (১৯৭৮) উপন্যাসের নাম। এর কাহিনির শুরু ১৯৩০-এর দশকে। একদিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, আরেক দিকে সাম্যবাদী বিপ্লবের স্বপ্ন। উপন্যাসটি যেন এক সামাজিক ইতিহাস। মুসলিম হাওয়েলি থেকে হিন্দু মন্দির আর শান্তিনিকেতন হয়ে সুন্দরবন। বিশাল ক্যানভাসে আঁকা বাংলার ছবি। ১৯৪৭-এর দেশভাগ থেকে ১৯৭১-এর যুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের জন্মে এর পরিণতি।

এরপর বলতে হবে প্রভাবশালী উর্দু কথাশিল্পী ইনতিযার হুসেইনের কথা। এই কথাকার দেশভাগের পরিণতি, এর অনিবার্যতা আর ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। দেশভাগ নিয়ে তাঁর ট্রিলোজিতে (বস্তি, আগে সমন্দর হ্যায় ও নয়া ঘর) তিনি পাকিস্তানকে এক ভাঙনের গাথা হিসেবে দেখছেন। বলছেন যে ১৯৭১-এর ঘটনার জন্য যত আক্ষেপ, দোষারোপ হচ্ছে হোক, এর জন্য পুবের বাসিন্দাদের দায়ী করার কোনো উপায় নেই। ১৯৭১ সালের বাস্তবতাকে তিনি ১৯৪৭-এর অসমাপ্ত জের হিসেবে দেখেন।

বস্তি উপন্যাসে ১৯৭১ মিশে যায় ১৮৫৭-এর সঙ্গে। ১৯৭১ সালকে ইনতিযার হুসেইন দেখেছেন এক দীর্ঘ ঘটনাপ্রবাহের সূত্র হিসেবে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিজে দেশভাগের শিকার। যখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু হলো, সে ডায়েরি লেখা শুরু করে। তার ডায়েরির লেখাগুলোতে মিথ, অতীত ও বর্তমান এক স্রোতে ভেসে যেতে থাকে। 

ইনতিযারের ‘আসির’ (বন্দী) নামের আরেক গল্পে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা জাভেদ দেখা করে তার পুরোনো বন্ধু আনওয়ারের সঙ্গে। আনওয়ার জানতে চায়, পূর্ব পাকিস্তানে আসলে ঘটছে কী? আশ্চর্য ব্যাপার হলো, নরহত্যার চোখে দেখা ঘটনা বলতে চেয়েও জাভেদ বলতে পারে না। সে তখন বরং জানতে চায় আরেক বন্ধু মির্জার কথা। আনওয়ার জানায় যে বেচারা এক মিছিলে গিয়ে গুলিতে নিহত হয়েছে। এই হত্যার কোনো কারণ কেউ জানে না। সেই হত্যার কোনো প্রতিবাদও হয়নি। এ বাস্তবতায় জাভেদ বলে, ওখানে যা ঘটছে, তার তো কারণ জানা যেত! 

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইনতিযার হুসেইন তাঁর নিজ দেশের স্বরূপ দেখার চেষ্টা করেন—যে দেশে কে, কিসের বিরুদ্ধে লড়ছে, কে কার শত্রু, তা অজানা।

কামিলা শামসি ২০০১ সালে প্রকাশ করেন ইংরেজি উপন্যাস কার্টোগ্রাফি। বিভাজন যে একসময় সমগ্রের অংশ ছিল, আর সে যে এখনো ফিরে ফিরে আসে। সেই প্রসঙ্গ থেকে এখানে এসেছে পূর্ব বাংলা আর সেই সময়ের কথা। 

ইনতিযারের উপন্যাসের জীবন বাস্তবে কাটিয়ে গেছেন বাংলাদেশের একজন উর্দু ছোটগল্প লেখক, সাংবাদিক, সিনেমার চিত্রনাট্য লেখক জয়নুল আবেদিন। ১৯৩৬ সালে ভারতের এলাহাবাদে জন্মেছিলেন মানুষটি। অর্জন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তিনি সাংবাদিকতা করেছেন দৈনিক পাসবান, সাপ্তাহিক জারিদা, সবরং, সাপ্তাহিক চিত্রালী এবং ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ ও পরে বাংলাদেশ টাইমস-এ । স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর লেখা গল্পে নির্মিত বেশ কিছু চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

পরিজনহীন মানুষটি থাকতেন ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে। ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন অনবদ্য গল্প ‘নয়ি টোকরি’, ‘সাত ভাই চম্পা’। তবে বহুজনের অনুরোধেও কখনো নিজের গল্পের কোনো গল্পসংকলন বের করেননি। জীবনের শেষ সময় ব্যয় করেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস খোয়াবনামার উর্দু অনুবাদে। ২০১৭ সালে মৃত্যুর আগে অনুবাদ শেষ করে গিয়েছিলেন। হ্যাঁ, একটা খোয়াব তো জয়নুল আবেদিনদেরও ছিল। ভাষা, বর্ণ, সম্প্রদায়ের বিভাজন পার হয়ে মানুষের জন্য এক পৃথিবীর খোয়াব। সেই খোয়াবই তাঁদের নিয়ে এসেছিল বাঙালির বন্ধু করে। তবে সেই স্বপ্নের পথ এখন ক্রমে দুর্গমই মনে হচ্ছে। কিন্তু অন্য কোনো পথও তো নেই। 

 ১৯৭১ সালে এই মাটিতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ বানিয়েছে, তখন প্রগতিশীল শুভবুদ্ধির উর্দু লেখকেরা জীবন বাজি রেখে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশ ও বাঙালির পক্ষে। আর কবিতা–গল্প তো সৃষ্টিকর্ম। কে না জানে, যেকোনো শুভ সৃষ্টি সত্যের পক্ষেই থাকে সব সময়।