পল্লিকবির বিবাহ!

মেয়েটির নাম মমতাজ, তখন ক্লাস নাইনে পড়েন। নানা-নানির কাছে থাকেন। তাঁর নানা মৌলভি ইদ্রিস সাহেবকে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিকসের লেকচারার শফিউল্লাহ সাহেব বললেন, ‘আপনার বাড়িতে আগামীকাল একজন গুণী মানুষকে নিয়ে আসব, যদি অনুমতি দেন। ভদ্রলোক একজন কবি।’ 

অতিথি একজন কবি শুনে ইদ্রিস সাহেব খুব খুশি হলেন। কারণ, তিনি নিজেও কবিতা লেখেন!
শফিউল্লাহ সাহেবের বর্ণিত কবির নাম জসীমউদ্‌দীন। নির্দিষ্ট দিনে তাঁকে নিয়ে হাজির হলেন শফিউল্লাহ সাহেব। খানাপিনার সঙ্গে অনেক গল্প হলো। কবি জসীমউদ্‌দীনের বেশ ভালো লেগে গেল এই সরল, কবিতামুগ্ধ বৃদ্ধকে।

পনেরো-ষোলো দিন পর জসীমউদ্‌দীন আবার এলেন মৌলভি ইদ্রিস সাহেবের বাড়িতে।
নিজের ঘরে বসে নাতনি মমতাজ তখন টেবিলে ছড়ানো বই-খাতা গুছাচ্ছিলেন, তখনই প্রথমবার কবি জসীমউদ্‌দীনকে দেখেন মমতাজ।
পরে এই দিনের কথা স্মরণ করে মমতাজ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘দেখি এক ভদ্রলোক এই ঘরের সামনে দিয়া আমার দিকে চাইতে চাইতে বারান্দা পার হইল। আমিও চাইয়া রইলাম।’

মমতাজের রূপে মুগ্ধ কবি আবার এলেন কুড়ি-পঁচিশ দিন পরেই। এবার এসে সোজা ঢুকে পড়লেন সেই কিশোরীর পড়ার ঘরে।
চেয়ারে বসে একটা খাতা টান দিয়ে নিয়ে বললেন, ‘খুকি, তুমি এই খাতাটা আমাকে দিবা, আমি তোমাকে একটা কবিতা লেইখা দেই?’
মমতাজ মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন। কবি কিছুক্ষণ বেশ কাটাকুটি করে এক পৃষ্ঠায় কবিতা, অন্য এক পৃষ্ঠায় গান লিখলেন। কবিতাটি ছিল—
আমারে করিও ক্ষমা
সুন্দরী অনুপমা
তোমার শান্ত নিভৃত আলয়ে
হয়তো তোমার খেলার বাসরে
অপরাধ রবে জমা
আমারে করিও ক্ষমা।

নবম শ্রেণির ছাত্রী মমতাজ তখনো জানতেন না, তাঁদের বাংলা পাঠ্যতালিকায় ‘রাখাল ছেলে’ যে কবিতাটি আছে, যে কবিতাটি তাঁর খুবই প্রিয়, সেই কবিতা লিখেছেন তাঁর সামনে বসা কবি জসীমউদ্‌দীন স্বয়ং!
‘ভদ্রলোক তো আমারে দেখার পর নানা দিক থেইকা আমার নানাভাইকে হাত করার জন্য লাইগা গেল। অনেককে দিয়া সুপারিশ করতে লাগল। ওই যে আমারে দেখল, আমার রূপ তার মনে ধইরা নিল। কবি তো!’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বেগম মমতাজ জসীমউদ্‌দীন। ওরফে ‘মণিমালা’।
এদিকে ভেতরে বেতরে মণিমালার অগোচরে অনেক ঘটনা ঘটে যেতে লাগল।

কবি সাহেব আরেক দিন এলেন। মমতাজকে গান গাওয়ার জন্য পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে অনুরোধ করছেন। কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই গান গাইবে না।
শেষ পর্যন্ত তার নানির জোর ধমকে গান ধরল মেয়েটি, তার খুব প্রিয় গান—‘নিশীথে যাইও ফুলবনে।’
কী আশ্চর্য, মেয়েটি জানত না এই গানটিরও রচয়িতা কবি জসীমউদ্‌দীন!
পরে যখন মণিমালা জেনেছিলেন এ তথ্য, লজ্জা পেয়ে ছিলেন। তাঁকে এ কথা জানিয়েছিলেন তাঁরই এক বোন। সেই বোন বলেছিলেন, ‘কবির সঙ্গে তোমার নানা তোমার বিয়া ঠিক করতে চায়। তুমি রাজি আছ?’
‘আমি ছেলেমানুষির ছলে বইলা ফালাইলাম, আমার মত আছে। তারপর দৌড় দিয়া দিদির সামনে থেইকা পলাইয়া গেলাম। ...তখন মনে হয় নাই একটা কালো লম্বা মানুষ, আবার কবি, তার সাথে আমার বিয়া হইতে যাইতেছে। ...কালো, এ জন্য আমার কোনো অসুবিধা ছিল না। বয়সটাও আমার কাছে কোনো বাধা মনে হয় নাই। সবচেয়ে পছন্দ হইছিল—তিনি হাইসা যখন কথা কন, সামনের দিকে দুইটা সোনা দিয়া বান্ধানো দাঁত চকচক কইরা উঠত। সোনার দাঁত দেখার জন্য তাঁর দিকে বারে বারে তাকাইছি।’ আরও পরে বলেছিলেন মমতাজ।

ইদ্রিস সাহেবের কবিকে মনে ধরেছিল, মনে মনে তিনি স্থিরও করে ফেলেছিলেন যে নাতনি মমতাজের সঙ্গে কবি জসীমউদ্‌দীনের বিয়ে দেবেন। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন স্বয়ং মেয়ের মা আর বাবা। মৌলভির ইদ্রিস সাহেবের মেয়েজামাই তখন ফরিদপুর জেলা হাইস্কুলের মাস্টার। মেয়ে থাকতেন শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। ওখানেই বড় হওয়া মমতাজের।
নানা-নানি সংকটে পড়লেন, কিন্তু মেয়ে রাজি হলেই তো আর হলো না! তাঁর বাবা-মা আছেন। তাঁরা জসীমউদ্‌দীনের মতো পাত্রকে জামাই করার ব্যাপারে একেবারেই রাজি না। মমতাজের বাবা মোহসেনউদ্দিন এক কথায় প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।
শ্বশুরকে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়ে সাত পৃষ্ঠা দীর্ঘ এক চিঠি লিখেছিলেন তিনি! চিঠির মূল বক্তব্য ছিল—
‘আপনি কি পাগল হইয়া গেলেন! এই লোকটা (জসীমউদ্‌দীন) পাগল। চরে ঘুরে বেড়ায়। গান গেয়ে বেড়ায়। ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান, মুর্শিদি গান। গানের মজলিশে সারা রাত কান্নাকাটি করে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। এই রকম ছেলের সাথে বিয়া দেবেন? তার চাইতে নাতিনকে পদ্মায় ফালাইয়া দেন।’
জামাইয়ের চিঠি পেয়ে হতভম্ব মৌলভি ঠিক করলেন জসীমউদ্‌দীনের খোঁজখবর করবেন, প্রয়োজনে নজরদারিও শুরু করবেন। অভিযোগ সত্য কি না নিজে যাচাই করে দেখবেন।
জসীমউদ্‌দীন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার লেকচারার। থাকেন নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের উত্তর দিকে হলুদরঙা একতলা বাড়িতে।
মৌলভি সাহেব খুব সকালে উঠে নিউমার্কেট এলাকায় যাতায়াত শুরু করলেন।
একদিন জসীমউদ্‌দীন দেখে ফেললেন তাঁকে। ঘরে ডেকে এনে চা-নাশতা খাইয়ে অনেক যত্ন করলেন।
তারপর বললেন, ‘আমার কাছে নাতিন বিয়া দিবেন কি না, কথা দিয়া যাইতে হইব। নইলে আইজকা আপনাকে ছাড়ুম না।’

মৌলভি ইদ্রিস মিয়াকে জসীমউদ্‌দীন আটকে রেখেছিলেন পুরো সকাল। জসীমউদ্‌দীনের কথা ছিল মৌলভি সাহেব তাঁকে কথা দেবেন যে তাঁর নাতনির সঙ্গেই তাঁর বিয়ে দেবেন, তারপর ছাড়া পাবেন।
শেষ পর্যন্ত বিয়ের কথা দিয়ে কবির হাত থেকে ‘মুক্তি’ পেয়েছিলেন বৃদ্ধ মৌলভি!
জসীমউদ্‌দীনের সঙ্গে মমতাজের বয়সের ফারাক ছিল বছর কুড়ির মতো।
মমতাজের মা-বাবার আপত্তির এটাও অন্যতম একটা কারণ ছিল। কিন্তু জসীমউদ্‌দীন যে নাছোড় ছিলেন!
তাঁর ধনুকভাঙা পণ ছিল, মমতাজকেই শাদি করবেন তিনি। তাঁর চোখের রেখায়, বুকের লেখায় শুধুই ছিলেন মমতাজ।

শেষে কবি জসীমউদ্‌দীনেরই জয় হলো। খুব ঘটা করেই বিয়ে হলো তাঁর মমতাজের সঙ্গে।
বিয়েতে কলকাতা থেকে কেনা হয়েছিল আকাশনীল রঙের বেনারসি, শেরওয়ানি, টুপি, পাগড়ি। সাত-আটটা ঘোড়ার গাড়ি, নানা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল। সারা নারায়ণগঞ্জ শহর ঘুরেছিল সেই গাড়িগুলো।
রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠিয়েছিলেন সুন্দর একটা চিঠি আর নিজের হাতে আঁকা ছবি, ডালে বসা দুটো পায়রা। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন তিন পৃষ্ঠার একটা চিঠি, তাতে জীবন সম্পর্কে নানা উপদেশ ছিল। প্রায় এক হাজার অতিথি এসেছিলেন বিয়েতে।

শুধু আসেননি মমতাজের বাবা এবং মা!

তথ্যসূত্র:
১-মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্‌দীন, আদর্শ (২০১৩)।
২-আমার কবি, বেগম মমতাজ জসীমউদ্‌দীন, আদর্শ (২০১৭)।
৩-জসীমউদ্‌দীন: জীবন ও সাহিত্য।