কবির অনন্ত মৃত্যুতে জন্ম যে ক্রিটিকের!

সুমন রহমান লিখতে শুরু করেছিলেন ঈশান জয়দ্রথ নামে। ১৯৯৪ সালে এই নামেই প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ঝিঁঝিট’। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে সুমন রহমান স্বনামেই বের করেন দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ কবিতার বই ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’। এরপর তাঁর আর কোনো কবিতার বই প্রকাশ পায়নি। কেন পায়নি, তা এক প্রশ্ন।

দীর্ঘ বিরতি শেষে ২০২০ সালে ওই দুটি বইয়ের সঙ্গে সাতটি অগ্রন্থিত কবিতা জুড়ে দিয়ে এ কবি বের করেছেন নির্বাচিত কবিতার বই। এটিকে ছদ্মবেশী ‘সমগ্র’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন তিনি। এই বইয়ের ভূমিকাতেই কবি ইশারা দিচ্ছেন, কেন দ্বিতীয় বইয়ের পর আর সেভাবে কবিতা লেখেননি তিনি। কেন দূরে সরে গেছেন কবিতার ভাষাব্যবস্থা থেকে।

সুমন রহমান জানাচ্ছেন, আমার ক্ষেত্রে যেটি ঘটল ‘দুজন কবি (ঈশান জয়দ্রথ ও সুমন রহমান) তাদের মর্মছেঁড়া দ্বৈরথে ক্রমাগত রক্তাক্ত ও নিহত হতে থাকল, কিন্তু লড়াইয়ে জিতল তৃতীয়জন। ইতিহাসের শিক্ষা সেখানে কোনোই কাজে আসলো না। অমরতার ভ্রুকুটি দিয়েও তাদের প্রলুব্ধ করা গেল না।’

এই বিজয়ী তৃতীয়জন হলেন একজন ক্রিটিক। ক্রিটিক সুমন রহমান। কবিকে অনন্ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে জন্ম হয়েছে এই সুমনের এবং ক্রিটিক সুমন নিজেকে ‘বিজয়ী’ বলেই জানেন। কবিতার ভাষাব্যবস্থার চেয়ে ক্রিটিকের প্রতিই পক্ষপাত তাঁর।

ব্যক্তি সুমন রহমানের এই প্রবণতা তাঁর কবিতারও প্রবণতা। এই প্রবণতাকে আমরা কী নামে ডাকতে পারি! এ কি সেই পোস্টমডার্ন প্রবণতা, যার বিশেষ কোনো কেন্দ্র থাকবে না, লিনিয়ারিটি থাকবে না? যে কোনোখানেই যার শুরু কিংবা শেষ হতে পারে? আপাত তা-ই মনে হয়।

সুমন রহমানের দুই বই আর অগ্রন্থিত কবিতাগুলোতে এই পোস্টমডার্ন প্রবণতাগুলোরই সাক্ষাৎ পাই। তাঁর কবিতার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রধানতম মেটাফিকশন, যেখানে পৌঁছাতে হয় ম্যাজিক রিয়ালের জুড়িগাড়িতে। এটি দিয়ে তিনি কখনো কখনো কবিতা আর গল্পের প্রথাগত ফারাকও ঘোচাতে চেয়েছেন। গল্পকার সুমন রহমানের জন্মের উৎসমুখ হিসেবেও দেখা যায় এই মেটাফিকশন প্রবণতাকে।

পোস্টমডার্ন প্রবণতার মতোই সুমন রহমান তাঁর এই মেটাফিকশনকে সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক আর্টিকুলেশনের ক্ষেত্রে কাজে লাগান। সেই ফিকশনে পাঠককেও এক চরিত্র হিসেবে ঢুকে যেতে হয়, চিন্তাশীলতা বাহিত হয়ে অর্থোদ্ধার করতে হয় টেক্সটের। কবি বারবার মনে করিয়ে দেন, এটি কেবলই রূপকথা নয়, হে পাঠক মর্মোদ্ধার করো।

...নগরায়ণের ল্যাবে বানানো দানবীয় এই বর্ষা বিরহেরও নয়, বেদনারও নয়...বানভাসি মানুষ ঠাঁই নিচ্ছে ইউটিউবে, ফেসবুকে থইথই করছে পানি। ইমোটিকন ছাড়া আপাতত আর কোনো ত্রাণসামগ্রী নাই।...দাঁতকপাটি খুলছে ফারাক্কা, ধেয়ে আসছে মমতা ব্যানার্জি।...

(বর্ষাবন্দনা)

বিলবোর্ড-নির্বাসিনী...‘তোমার গল্প থেকে এমন মোহময় সাবানের গন্ধ ছড়াচ্ছে...
তবু কোনো দিন ভোরবেলা জেগে আমি অবাক দেখব শাদা বিলবোর্ড
অচেনা রূপসী, নতুন কমোডিটি
তোমার শ্রান্ত ডানাজোড়া আর খুঁজেও পাব না
যাদের আমি চোখের জলে এতকাল লুকিয়ে রেখেছিলাম!

(বিলবোর্ড-নির্বাসিনী)

পাখি উড়ে চলে গেছে; পাখির পালকসম দেহ
সিমেন্টের বস্তার ভারে ডুবে আছে অথই নদীতে
মাথার ভেতরে আজ সাঁতরায় অলস বুলেট...

...প্রেমিক মিলছে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কেন
নিহত হারাল নিহত থাকার অধিকার?...

(নিহত থাকার অধিকার)

...মৃত্যুর সঙ্গী ছিল না। ওকে জুটিয়ে দেয়া হলো ‘ঈর্ষা’ নাম্নী পাহাড়ি ছাগলের সাথে।...কিন্তু ঈর্ষা মূলত ছিল নিজের ছায়ারই বাগ্‌দত্তা, ফলে ওর হাতে অবিশ্বাসের যে অঙ্গুরী ছিল সেটা সে রেখে দিল পিতাপুত্র থেকে সমান দূরত্বে।...

...ধাঁধা ওর কুমারী মায়ের গর্ভপাতের ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়া সন্তান। প্রবাদের সাথেও সখ্যতা হয়নি, না-হওয়াটাই তখন প্রথা। সেই আমার প্রথম শরসন্ধান, অশ্বমেধের শুরু। তারপর কত যুদ্ধ, যুদ্ধবন্দী হয়ে এল ‘কল্পনা’—ঘুমন্ত স্তনস্পর্শের শিহরণ থেকে ওর জন্ম...

(মাতৃপুরাণ)

হে পাঠক...আমাদের প্রতিটি পরিচয় ফলত নির্ভার নতুন যোগাযোগ
পূর্বপ্রণয়ের দাবি কোনো দিনই সামনে দাঁড়াবে না
আবারও আনন্দ হবে কিছু, আবারও ভুলে যাওয়ার আগে...

(মেঘমেদুর মেটান্যারেটিভ)

২.

কবি সুমন রহমানের কোন উচ্চাভিলাষ তাঁকে ক্রিটিকের পথে নিয়ে গেল? কবিতা, যা ‘নামকরণের’ ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয় এবং ফর্ম হিসেবে যুক্তি যেখানে পৌঁছায়, তার ওপর বহুদূর পর্যন্ত নিজের বিস্তার ঘটায়, ক্রিটিক সুমন রহমান কি তারও অধিক কোনো দিকচক্রবালের সন্ধান পেয়েছেন?

নাকি কবি সুমন রহমান কোনো দার্শনিক অবস্থান থেকে কবিতাকে উপেক্ষা করে ক্রিটিকের দিকে চলে গেছেন? আমরা তা বুঝে উঠতে পারি না।

যখন তিনি বলেন, ‘আমাদের কারোরই নাই মতাদর্শের মহাজনি ঋণ...’, তখন মনে হয় তিনি তথাকথিত আদর্শবাদ, বিশুদ্ধতাবাদে অনাস্থার কারণে এসব থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। তাঁর পরিপার্শ্বে কবিতাও হয়তো মূল্যায়িত হয়েছে বিশুদ্ধতাবাদ নামে। ফলে এর প্রতি তাঁর অনীহা। বিশুদ্ধতাবাদ, আশাবাদকে তিনি ফাঁদ ভেবেছেন। ফলে দূরে সরে গেছেন। কিন্তু দূরে গিয়েও তো সন্তুষ্ট করার মতো কোনো ইশারা দিতে পারেননি তিনি। তাঁর ক্রিটিক সত্তা কি শেষমেশ আমাদের সার্ত্রে বা বেকেটের অস্তিত্ববাদের মতোই নিহিলিস্ট এক কানাগলি উপহার দেয় না? তাঁর ক্রিটিক সত্তা কি কেবলই পরিস্থিতির বিবরণ তুলে ধরে না?

পাঠক নজর বোলাই—

...আমাদের স্মৃতি ডিসপোজেবল, আমাদের মুখছবি নাই।...

(ফ্ল্যাশমব)


কবিতা লিখি না বহুকাল...সামনে লগবই আর পেছনে ইরেজার নিয়ে
নিরর্থক ইতিহাসে মুখস্থ হতে যাওয়ার ভয়ে আমি কাঁপতে চাইনি...

...ফলে হে পাঠক শুধু কিছু আনন্দ হয়েছিল, কিন্তু এই সামান্য যৌথতা
অনিবার্য হয়ে ওঠেনি কখনো
এই ডিসপোজেবল সম্পর্কের দুনিয়ায়।...

আমার ভেতর আমি যখন নামি
কেবলই মেটাফোর পাই
যারা দুষ্টুমি করে আমার একটা আত্মাভিমান বানিয়ে দিয়েছে
ফলে হে পাঠক যাকে তুমি কবিরূপে শনাক্ত করছ
সে জাস্ট একটুকরো ঝকঝকে আত্মাভিমান মাত্র
কিছু স্বায়ত্তশাসিত মেটাফোর এই মনোরম ফাঁদে ফেলেছে তোমাকে
কিন্তু এই মেঘমেদুর মেটান্যারেটিভ কখনোই আমার হবে না
আমি আত্মঘাতী বোমারুর মতো ওকে ধ্বংস করেছি
আমার অনন্ত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে...

আমাদের প্রতিটি পরিচয় ফলত নির্ভার নতুন যোগাযোগ
পূর্বপ্রণয়ের দাবি কোনো দিনই সামনে দাঁড়াবে না
আবারও আনন্দ হবে কিছু, আবারও ভুলে যাওয়ার আগে...

(মেঘমেদুর মেটান্যারেটিভ)

এখানেই শেষ নয়, ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’ কবিতার বইটিতে সাক্ষাৎকারভিত্তিক ‘ঝিঁঝিট ও তার যাবতীয় হাস্যকর কিংবদন্তীপনা’ লেখাটিতে ঈষান জয়দ্রথকে ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকেন সুমন রহমান। কবি ঈশান বলেন, স্পষ্ট বুঝতে পারি আমায় ঈর্ষা করছ। ক্রিটিক সুমন বলেন, ঈর্ষা করি ঠিক। বিশাল এক অপচয়ের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি যে!...সঙ্গী হিসেবে তোমার কথা ভেবেছি, কিন্তু তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে একটি অপার্থিব শুদ্ধতার মধ্যে।

আরেক জায়গায় সুমন ঈশানকে বলেন, স্রষ্টার (সুমন রহমান) অবিশুদ্ধতায় লালিত হয়ে সৃষ্টি (ঈশান) বিশুদ্ধতার ধ্যান ধরছে।

বোঝা যায়, ক্রিটিক সুমন রহমান অপার্থিবতা, বিশুদ্ধতা, মতাদর্শ উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু তার বিনিময়ে তুলে ধরেছেন নৈরাশ্য, মৃত্যু আর অপচয়ের দুনিয়া। শুধু তুলেই ধরেননি, তিনি নিজেও তা-ই অনুধাবন করেন বলে জানাচ্ছেন। কিন্তু এই অনুধাবন আমাদের সার্ত্রে বা বেকেটের নিরর্থক অস্তিত্ববাদিতার জগৎ ছাড়া আর কী উপহার দেয়!


...তোমারই খাঁচার ভেতর পোষ্য হতে হতে
ওরা তোমায় ঠিক পোষ মানিয়ে ফেলবে!...

(এমন বাদল দিনে)

নিজের যুক্তিপরম্পরায় ক্রিটিক সুমনের পরিণতিও কি তাই?

আমরা কি ক্রিটিক সুমন রহমানকে কবি সুমন রহমানের ওপর ‘বিজয়ী’ ঘোষণা করব, যেমনটা তিনি এরই মধ্যে করে ফেলেছেন? আমরা কি এখনই তাঁর মতো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাব, নাকি প্রবাবিলিটি নিয়ে প্যাসকেলের সেই বাজিটি ধরব?

প্যাসকেল যখন বলেন, মানুষ একটা নলখাগড়ার চেয়ে উৎকৃষ্টতর কিছুই নয়। একটি ক্ষুদ্র বিন্দুও তাকে ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু সমগ্র জগৎও যদি তাকে ধ্বংস করতে উন্মুখ হয়, তারপরও সে সমগ্র পৃথিবী অপেক্ষা মহত্তর। পৃথিবী মানুষকে ধ্বংস করার সময় অসচেতন থেকে যায়, কিন্তু মানুষ তার ধ্বংসকে অনুধাবন করে। সচেতনতা সেই বস্তু, যা অস্তিত্বশীলতার চেয়ে উৎকৃষ্টতর।

মানুষের এই আলট্রা-রিয়ালিটি, এই সচেতনতা লালন করার জন্য অপার্থিবতায় বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই।
কবি সুমন যে সে কথা জানেন না, তা নয়। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করতে চান।

অথচ একদিন কবি সুমন ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন—‘...অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া...’

ক্রিটিক সুমন অমরতাকে বুড়ো আঙুল দেখাক। কিন্তু কোনো দার্শনিক অবস্থান থেকেই অমরতার দিকে যাওয়াকে হেয় করতে পারেন না। আমরা এই বৃহৎ সত্যের দিকে হেঁটে যেতে চাই। আর এই পথে চলতে থাকলে ক্রিটিক সুমন রহমানের চেয়ে কবি সুমন রহমান আমাদের আরও নিকটবর্তী হন। অস্তিত্বশীলতার সমান্তরালে কবিতা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

...ছোট্ট খাড়ি, তোমার উদ্যম এখনো মেশেনি বঙ্গোপাসগরে...

(লালাবাই)

উর্দু কথাসাহিত্যিক ইন্তেজার হুসেনের ‘হলুদ কুকুর’ গল্পে এমন একটা অংশ আছে—আহমদ হুজরি ছিলেন তাঁর সময়ের এক বিখ্যাত প্রবীণ কবি। কিন্তু একবার শহরে কবির সংখ্যা বেড়ে গেল। কবিতা আর অকবিতার ফারাক মুছে গেল। অভিমান করে আহমদ কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে মদের ব্যবসা ধরলেন। শহরে শহরে মদ বয়ে নিতে একটা গাধাও কিনলেন। সবাই বলল, আহমদ বিপথগামী হয়ে গেছে। একজন কবি হয়ে গেছে মদের ব্যবসায়ী। আহমদ এসব কথায় কান না দিয়ে ব্যবসায় মনোযোগী হলেন। একদিন আরেক শহরে মদ নিয়ে যাওয়ার জন্য গাধার পিঠে বোঝা চাপালেন তিনি। কিন্তু যাওয়ার পথে একটি মোড়ে গিয়ে গাধাটি থমকে দাঁড়াল। আহমদ গাধাটিকে চাবকাতে লাগলেন, কিন্তু গাধাটি ঘাড় ঘুরিয়ে আহমদকে দেখে নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল। কবিতাটি ছিল দ্ব্যর্থক—আমি রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছি, আহমদ বলে চলো, কিন্তু অন্যজন বলে এক পা-ও নড়ো না। আহমদ গাধার কবিতা শুনে নিজের কলার ছিঁড়ে ফেললেন। আর বললেন, সর্বনাশ হোক সে সময়ের, যেখানে গাধা কবি হয়ে উঠেছে, আর আহমদের মুখে তালা লেগেছে।

আমাদের এই সময়ের সঙ্গে গল্পটা কী প্রাসঙ্গিক! আমরা চাই, কবি সুমন রহমানের মুখে তালা না লাগুক। ক্রিটিক সুমনকে ডিঙিয়ে অবিরাম কবিতা লিখতে থাকুন এই কবি।


নির্বাচিত কবিতা
সুমন রহমান
প্রকাশক: উড়কি
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
মূল্য: ২০০ টাকা